LIVE
Loading latest headlines...

রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৯

ইসলামিক সঙ্গীত

রবিবার, অক্টোবর ২০, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
আযান




মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর জন্ম ও বংশ পরিচয়

রবিবার, অক্টোবর ২০, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর জন্ম ও বংশ পরিচয়
রাসূলের মাক্কী জীবন :
নবী জীবনকে আমরা প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করে নেব- মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মক্কায় তাঁর জন্ম, বৃদ্ধি ও নবুঅত  লাভ  এবং  মদীনায়  তাঁর  হিজরত,  ইসলামের বাস্তবায়ন ও ওফাত লাভ। অতঃপর প্রথমেই তাঁর বংশ পরিচয় ও জন্ম বৃত্তান্ত।
বংশ পরিচয় :
ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্র ছিলেন ইসমাঈল ও ইসহাক্ব। ইসমাঈলের মা ছিলেন বিবি হাজেরা এবং ইসহাকের মা ছিলেন বিবি সারা। দুই ছেলেই ‘নবী’ হয়েছিলেন। ছোট ছেলে ইসহাক্বের পুত্র ইয়াকূব ও ‘নবী’ ছিলেন এবং তার অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। তাঁর বারোটি পুত্রের বংশধরগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে হাযার হাযার নবীর জন্ম হয়। ইউসুফ, মূসা, হারূণ, দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) ছিলেন এই বংশের সেরা নবী ও রাসূল। বলা চলে যে, আদম (আলাইহিস সালাম) হ’তে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত হযরত নূহ ও ইদরীস (আঃ) সহ ৮/৯ জন নবী ছাড়া এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধর অর্থাৎ বনু ইস্রাঈল। যাদের সর্বশেষ নবী ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। অন্যদিকে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে একজন মাত্র নবীর জন্ম হয় এবং তিনিই হ’লেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। ফলে আদম (আঃ) যেমন ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা, নূহ (আঃ) ছিলেন মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা, তেমনি ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সকল নবী ও তাঁদের অনুসারী উম্মতে মুসলিমাহর পিতা (হজ্জ ২২/৭৮)। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন ও মাঝে-মধ্যে গিয়ে তাদের দেখাশুনা করতেন। তাঁরা সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন। অন্যদিকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ও তার পুত্র ইসহাক্ব ও অন্যদের নিয়ে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীনে) বসবাস করতেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে মক্কা ও ফিলিস্তীন দুই এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটে।
কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর মধ্যে আদম, নূহ, ইদরীস ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) বাদে বাকী ২১ জন নবী ছিলেন বনু ইস্রাঈল এবং একমাত্র মুহাম্মাদ হ’লেন বনু ইসমাঈল। বলা চলে যে, এই বৈমাত্রেয় পার্থক্য উম্মতে মুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে ইহুদী-নাছারাদের বিদ্বেষের অন্যতম কারণ ছিল। সেজন্যে তারা চিনতে পেরেও শেষনবীকে মানেনি (বাক্বারাহ ২/১৪৬; আন‘আম ৬/২০)
এক্ষণে আমরা ইবরাহীম বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মানবজাতির গৌরব মুকুট, বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম ও বংশ পরিচয় তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
জন্ম ও মৃত্যু :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১ হিজরী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবার সকালে ৯/১০টার দিকে চান্দ্র বর্ষের হিসাবে ৬৩ বছর ৪দিন বয়সে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। সৌরবর্ষ হিসাবে জন্ম ৫৭১ খৃষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল সোমবার এবং মৃত্যু ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ৬ই জুন সোমবার। বয়স ৬১ বছর ১ মাস ১৪ দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আবরাহা কর্তৃক কা‘বা আক্রমণের ৫০ অথবা ৫৫ দিন পরে। এটা ছিল ইবরাহীম (আঃ) থেকে ২৫৮৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন পরের এবং নূহের তূফানের ৩৬৭৫ বছর পরের ঘটনা। রাসূল (ছাঃ) দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন মোট ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘণ্টা। তন্মধ্যে তাঁর নবুঅত কাল ছিল ৮১৫৬ দিন। এ হিসাব হ’ল সুলায়মান মানছূরপুরীর। সঠিক হিসাব আল্লাহ জানেন।
বংশ : তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা, দাদার নাম আব্দুল মুত্ত্বালিব, দাদীর নাম ফাতেমা। নানার নাম ওয়াহাব, নানীর নাম বাররাহ। নানার বংশসূত্র রাসূলের ঊর্ধ্বতন দাদা কিলাব-এর সাথে এবং নানীর বংশসূত্র কুছাই-এর সাথে যুক্ত হয়েছে। নানা ওয়াহাব বনু যোহরা গোত্রের সরদার ছিলেন। দাদার হাশেমী গোত্র ও নানার যোহরা গোত্র কুরায়েশ বংশের দুই বৃহৎ ও সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল।
বংশধারা (শাজারাহ) :
তাঁর বংশধারাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ১ম ভাগে মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’তে ঊর্ধ্বতন পুরুষ আদনান পর্যন্ত ২২টি স্তর। যে ব্যাপারে কারু কোন মতভেদ নেই। এর উপরে ২য় ভাগে আদনান থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ৪১টি স্তর এবং তার উপরে তৃতীয় ভাগে ইবরাহীম (আঃ) হ’তে আদম (আঃ) পর্যন্ত ১৯টি স্তর। যেখানে নাম ও স্তরের ব্যাপারে বিদ্বানগণের মতভেদ রয়েছে। আমরা নিম্নে আদনান পর্যন্ত বংশধারা উল্লেখ করলাম।-
(১) মুহাম্মাদ বিন (২) আব্দুল্লাহ বিন (৩) আব্দুল মুত্ত্বালিব বিন (৪) হাশেম বিন (৫) আবদে মানাফ বিন (৬) কুছাই বিন (৭) কিলাব বিন (৮) মুররাহ বিন (৯) কা‘ব বিন (১০) লুওয়াই বিন (১১) গালিব বিন (১২) ফিহর (লকব কুরায়েশ) বিন (১৩) মালেক বিন (১৪) নাযার বিন (১৫) কানানাহ বিন (১৬) খুযায়মা বিন (১৭) মুদরেকাহ বিন (১৮) ইলিয়াস বিন (১৯) মুযার বিন (২০) নাযার বিন (২১) মা‘দ বিন (২২) আদনান। এর মধ্যে পরদাদা হাশেম-এর নামে হাশেমী গোত্র এবং দ্বাদশতম পুরুষ ফিহর যার উপাধি ছিল কুরায়েশ, তার নামানুসারে কুরায়েশ বংশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। কুরায়েশ অর্থ সাগরের তিমি মাছ। ইয়ামনের বাদশাহ হাসসান মক্কা আক্রমণ করে কা‘বা উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ফিহর তাকে যুদ্ধে হারিয়ে তিন বছর বন্দী করে রাখেন। অতঃপর তাকে মুক্তি দেন। হাসসান ইয়ামনে ফেরার পথে রাস্তায় মারা যায়। এই ঘটনার পর থেকে ফিহর ‘আরবের কুরায়েশ’ বলে খ্যাতি লাভ করেন’।  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় বংশ সম্পর্কে বলেন,
إن الله اصطفى من ولد إبراهيم إسماعيل واصطفى من ولد إسماعيل بني كنانة واصطفى من بني كنانة قريشا واصطفى من قريش بني هاشمٍ واصطفاني من بني هاشم، رواه مسلم عن واثلة بن الأسقع.
‘আল্লাহ ইবরাহীমের সন্তানগণের মধ্য থেকে ইসমাঈলকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য থেকে বনু কানানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বনু কানানাহ থেকে কুরায়েশ বংশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন।[1]
শুধু তাই নয়, তিনি বলতেন, আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো‘আ ও ঈসার সুসংবাদ (এর ফসল)’।[2]কেননা ইবরাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহ নির্মাণের সময় দো‘আ করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়-
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি তাদের মধ্য হ’তে একজনকে তাদের মধ্যে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করুন, যিনি তাদের নিকটে আপনার আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)
পিতা-পুত্রের এই মিলিত দো‘আ দুই হাযারের অধিক বছর পরে  শেষনবী  মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর  আগমনের  মাধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করে।
একইভাবে ঈসা (আঃ) স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে শেষনবী আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেন, যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّراً بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ-
‘স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যয়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম আহমাদ…’ (ছফ ৬১/৬)
পিতা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে পিতার হুকুমে ইয়াছরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ও সেখানে নাবেগা জা‘দীর গোত্রে সমাধিস্থ হন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়।
খাৎনা ও নামকরণ :
প্রচলিত প্রথা মোতাবেক সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়। পিতৃহীন নবজাতককে কোলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব কা‘বা গৃহে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দো‘আ করেন। আক্বীক্বার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, ‘মুহাম্মাদ’। এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে, আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হৌক। ওদিকে স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং ‘সর্বাধিক প্রশংসিত’। উভয় নামই কুরআনে এসেছে। যেমন ‘মুহাম্মাদ’ নাম এসেছে চার জায়গায়। যথাক্রমে- সূরা আলে ইমরান ৩/১৪৪, আহযাব ৩৩/৪০; মুহাম্মাদ ৪৭/২ এবং ফাৎহ ৪৮/২৯। তাছাড়া ‘মুহাম্মাদ’ নামেই একটি সূরা নাযিল হয়েছে সূরা মুহাম্মাদ (৪৭ নং)। অনুরূপভাবে ‘আহমাদ’ নাম এসেছে এক জায়গায় (ছফ ৬১/৬)
কথিত আছে যে, (১) রাসূল খাৎনা করা অবস্থায় জামা-পাজামা পরে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন, যাতে কেউ তার লজ্জাস্থান দেখতে না পায়। (২) এছাড়াও কথিত আছে যে, জান্নাত থেকে আসিয়া ও মারিয়াম নেমে এসে ধাত্রীর কাজ করেন। (৩) আরও কথিত আছে যে, রাসূলের জন্মের সংবাদ শুনে চাচা আবু লাহাব আনন্দে আত্মহারা হয়ে মক্কার অলি-গলিতে এই সুসংবাদ শুনানোর জন্য দৌড়ে যান এবং তাকে প্রথম সংবাদ দানকারিণী দাসী ছুওয়াইবাকে খুশীর নিদর্শন স্বরূপ মুক্ত করে দেন। মীলাদের মজলিসে আরও বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল জন্মের সংবাদ দেবার সময় আবু লাহাবের শাহাদাত অঙ্গুলী উঁচু ছিল বিধায় খুশীতে সেটি জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদ থাকবে। বলা বাহুল্য, এসবই ভিত্তিহীন কল্প কথা মাত্র। (৪) বিশ্বসেরা জীবনীগ্রন্থ হিসাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত আর-রাহীকুল মাখতূমেও কিছু অশুদ্ধ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, যা উক্ত গ্রন্থের উচ্চ মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। যেমন (ক) রাসূল জন্মের সময় তার মা বলছেন যে, আমার গুপ্তাঙ্গ দিয়ে ‘নূর’ অর্থাৎ জ্যোতি বিকশিত হয়েছিল। যা সিরিয়ার প্রাসাদ সমূহকে আলোকিত করেছিল (খ) পারস্যের কিসরা রাজপ্রাসাদের ১৪টি চূড়া ভেঙ্গে পড়েছিল (গ) অগ্নি উপাসক মজূসীদের পূজার আগুন নিভে গিয়েছিল (ঘ) বাহীরাহর পার্শ্ববর্তী গীর্জাসমূহ ধ্বসে পড়েছিল ইত্যাদি (পৃঃ ৫৪)। উল্লেখ্য যে, অনুবাদক তার অগণিত ভুল অনুবাদের মধ্যে ঐ সাথে এটাও যোগ করেছেন যে, (ঙ) ঐ সময় কা‘বা গৃহের ৩৬০টি মূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে’ (পৃঃ ৭৬), প্রকাশক: তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ঢাকা সেপ্টেম্বর ২০০৯)
রাসূলের নাম সমূহ :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إن لى أسماء أنا محمد وأنا أحمد وأنا الماحي الذي محا الله بي الكفر وأنا الحاشر الذي يحشر الناس على قدمي وأنا العاقب الذي لا نبي بعدي، رواه مسلم عن جبير بن مطعم- ‘আমার কয়েকটি নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি ‘মাহী’ (বিদূরিতকারী) আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের’ (জমাকারী) কেননা সমস্ত লোক ক্বিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফা‘আতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘আক্বেব’ (সর্বশেষে আগমনকারী) আমার পরে আর কোন নবী নেই’।[3]
সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, উক্ত নাম সমূহের মধ্যে মুহাম্মাদ ও আহমাদ হ’ল তাঁর মূল নাম এবং বাকীগুলো হ’ল তাঁর গুণবাচক নাম। সেজন্য তিনি সেগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। এই গুণবাচক নামের সংখ্যা মানছূরপুরী গণনা করেছেন ৫৪টি। তিনি ৯২টি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
(ক) রাসূলের মৃত্যুর পরে কন্যা ফাতেমার শোকগাথাতেও ‘আহমাদ’ নাম এসেছে। যেমন-
صُبَّتْ عَلَيَّ مَصَائِبُ لَوْ أنَّهَا * صُبَّتْ عَلَى الْأَيَّامِ صِرنَ لَيَالِيَا
مَاذَا عَلَى مَنْ شَمَّ تُرْبَةَ أحْمَدَ * أنْ لاَ يَشَمَّ مُدَى الزَّمَانِ غَوَالِيَا
(১) আমার উপরে এমন বিপদ আপতিত হয়েছে, যদি তা দিনের উপরে পড়ত, তবে তা রাতে পরিণত হয়ে যেত।
(২) যে কেউ আহমাদের কবরের মাটি শুঁকবে, তার উপরে ওয়াজিব হবে যে সে সারাটি জীবনে আর কোন সুগন্ধি শুঁকবে না’।
এমনি ভাবে কট্টরপন্থী খারেজীরা যখন আলী (রাঃ)-কে নতুনভাবে তাদের সামনে ঈমান আনতে ও ইসলামে দাখিল হ’তে বলে, তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন,
يا شاهد الخير عليَّ فاشهد * إني على دين النبي أحمد
مَنْ شَكَّ في الله فإني مهتدي-
‘আমার উপরে হে কল্যাণের সাক্ষী সাক্ষী থাক, নিশ্চয়ই আমি নবী আহমাদের দ্বীনের উপরে রয়েছি, আল্লাহর ব্যাপারে যে সন্দেহ পোষণ করে সে জেনে রাখুক যে, আমি হেদায়াত প্রাপ্ত’। উল্লেখ্য যে, চরমপন্থী খারেজীরা আলী (রাঃ)-কে ‘কাফের’ ফৎওয়া দিয়ে তাঁকে ফজরের জামা‘আতে মসজিদে যাওয়ার সময় মর্মান্তিকভাবে হত্যা করেছিল এবং হত্যাকারী আব্দুর রহমান নির্বিকারভাবে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘আমি খুবই আনন্দিত এজন্য যে, আমি আজ ‘আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি’-কে হত্যা করেছি’।
(খ) ওদিকে ‘মুহাম্মাদ’ নামের প্রশংসায় কবি হাসসান বিন ছাবেত আনছারী (রাঃ) গেয়েছেন-
وَشقَّ له من اسمه لِيُجِلَّهُ * فذو العرش محمود وهذا محمد
‘তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করেছেন। তাই আরশের মালিক হ’লেন মাহমূদ এবং ইনি হ’লেন মুহাম্মাদ’।
উল্লেখ্য যে, ক্বিয়ামতের দিন রাসূলের শাফা‘আতের স্থানের নাম হবে ‘মাক্বামে মাহমূদ’।



আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা)

রবিবার, অক্টোবর ২০, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে

আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রা)

আবদুল্লাহ নাম। কুনিয়াত বা উপনামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। যথাঃ আবু মুহাম্মদ, আবু রাওয়াহা অথবা আবু ’আমর। ‘শায়িরু রাসূলিল্লাহ’- ‘রাসূলুল্লাহর সা. কবি’ তাঁর উপাধি। মদীনার খাযরাজ গোত্রের বনী আল-হারিস শাখার সন্তান। পিতা রাওয়াহা ইবন সা’লাবা এবং মাতা কাবশা বিনতু ওয়াকিদ। সাহাবিয়্যা ’আমরাহ বিনতু রাওয়াহা তাঁর বোন এবং কবি সাহাবী নু’মান ইবন বাশীর তাঁর ভাগ্নে। ইতিহাসে তাঁর জন্মের সময়কাল সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি জাহিলী ও ইসলামী উভয় জীবনে অতি মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। (তাবাকাত- ৩/৫২৫, আল-আ’লাম- ৪/২১৭, তাহজীবুল আসমা ওয়াললুগাত- ১/২৬৫)
তিনি তৃতীয় আকাবায় সত্তর জন (৭০) মদীনাবাসীর সাথে অংশগ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত করেন এবং সা’দ ইবনুর রাবূর’র সাথে তিনিও বনু আল-হারিসার ‘নাকীব’ (দায়িত্বশীল) মনোনীত হন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৪৩, ৪৫৮, তাবাকাত- ৩/৫২৬, আনসাবুল আশরাফ- ১/২৫২, তারীখুল ইসলাম ও তাবাকাতুল মাশাহীর- ১/১৮১)
তবে সম্ভবতঃ তিনি এই তৃতীয় ’আকাবার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায় তিনি প্রথম আকাবায় ছয়জনের সাথে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/১০৫)
ইসলাম গ্রহণের পর মদীনায় ইসলামের তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। রাসূলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে হিজরাত করে কুবায় উপস্থিত হলেন। তিনি যে দিন কুবা থেকে সর্বপ্রথম মদীনায় পদার্পণ করেন, সেদিন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা, সা’দ ইবনুর রাবী ও খারিজা ইবন যায়িদ তাদের গোত্র বনু আল-হারিসার লোকদের সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. উটনীর পথরোধ করে দৌঁড়ান এবং তাঁকে তাদের গোত্রে অবতরণের বিনীত আবেদন জানান। হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁদের বলেন, উটনীর পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর নির্দেশমত চলছে, আল্লাহর যেখানে ইচ্ছা সেখানেই থামবে। তাঁরা পথ ছেড়ে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৯৫) হযরত রাসূলে কারীম সা. মিকদাদ ইবন আসওয়াদ আল-কিন্দীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।
বদর, উহুদ, খন্দক, হুদাইবিয়া, খাইবার, ’উমরাতুল কাদা- প্রত্যেকটি অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। কেবল হিজরী চতুর্থ সনে সংঘটিত ‘বদর আস-সুগরা’ অভিযানে যোগদান করতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে মদীনায় স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করে যান। (তাবাকাত- ৩/৫২৬, সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৪৫৮) উল্লেখ্য যে, উহুদ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় কুরাইশ নেতা আবু সুফইয়ান ইবন হারব ঘোষণা দেয় যে, এখন থেকে ঠিক এক বছরের মাথায় ‘বদর আস-সুগরা’ তে আবার তোমাদের মুখোমুখি হব। রাসূলুল্লাহ সা. ও মুসলমানরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হন। কিন্তু কুরাইশরা অঙ্গীকার পালনের ব্যর্থ হয়। এই বদর আস-সুগরা- তে রাসূল সা. বাহিনীসহ আট দিন অপেক্ষা করেন। এটা হিজরী চতুর্থ সনের জ্বিলকা’দ মাসের ঘটনা। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩৯-৩৪০)
বদর যুদ্ধের সূচনা পর্বে কুরাইশ পক্ষের বাহাদুর ’উতবা ইবন রাবীয়া’ তার ভাই শাইবা ইবন রাবীয়া ও ছেলে আল-ওয়ালীদ ইবন উতবাকে সংগে করে প্রতিপক্ষ মুসলিম বাহিনীকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে ’আউফ, মুয়াওয়াজ ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা সর্বপ্রথম এগিয়ে যান। ’উতবা তাঁদের জিজ্ঞেস করেঃ তোমরা কারা? তাঁরা জবাব দেনঃ আনসারদের একটি দল। ’উতবা বলল, তোমাদের সাথে আমরা লড়তে চাইনা। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬২৫)
বদরের বিজয় বার্তা দিয়ে হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনার চতুর্দিকে লোক পাঠান। তিনি ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে পাঠান মদীনার উঁচু অঞ্চলের দিকে। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৬৪২)
রাসূলুল্লাহ সা. বদর যুদ্ধেল পর মুসলমানদের হাতে বন্দী কুরাইশদের সম্পর্কে সাহাবীদের মতামত জানতে চান। তাঁদের সম্পর্কে নানাজন নানা মত প্রকাশ করেন। ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা বলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ প্রচুর জ্বালানী কাঠে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকায় তাদেরকে জড় করে তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হোক। তারপর আমিই সেই কাঠে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলবো। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪২)
খন্দক যুদ্ধের সময় হযরত রাসূলে কারীম সা. আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার রচিত কবিতা বার বার আবৃত্তি করেছিলেন। তার কিছু অংশ নিম্নরূপঃ
‘‘হে আল্লাহ, তোমার সাহায্য না হলে আমরা হিদায়াত পেতাম না,
আমরা যাকাত দিতাম না, সালাত আদায় করতাম না
তুমি আমাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল কর,
যুদ্ধে আমাদেরকে অটল রাখ।
যারা আমাদের ওপর জুলুম করেছে,
তারা বিপর্যয় সৃষ্টি করলে, আমরা অস্বীকার করবো।’’
(সীয়ারে আনসার- ২/৫৯)
এই খন্দক যুদ্ধের সময় মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজার নেতা কাব ইবন আসাদ রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সম্পাদিত তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। খবরটি রাসূলুল্লাহর সা. কানে পৌঁছে। তিনি খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কয়েকজন লোককে কা’বের নিকট পাঠান। তাদের মধ্যে ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও ছিলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/২২১, আসাহ আস-সীয়ার- ১৯০)
খন্দক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহর সা. একটি মু’জিযা বা অলৌকিক কর্মকান্ডের কথা সীরাত গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আর তার সাথে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার নামটি উচ্চারিত হয়েছে। ঘটনাটি সংক্ষেপে এইরূপঃ
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার ভাগ্নী তথা নু’মান ইবন বাশীরের বোন বলেনঃ একদিন আমার মা ’উমরাহ বিনতু রাওয়াহা আমাকে ডেকে আমার কাপড়ে কিছু খেজুর বেঁধে দিয়ে বললেনঃ এগুলি তোমার বাবা বাশীর ও মামা ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে দিয়ে এস, তাঁরা দুপুরে খাবেন। আমি সেগুলি নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. পাশ দিয়ে যাচ্ছি, আর আমার বাবা ও মামাকে খোঁজ করছি। রাসূল সা. আমাকে দেখে ডাক দিলেনঃ এই মেয়ে, এদিকে এস। তোমার কাছে কি? বললামঃ খেজুর। আমার মা আমার বাবা বাশীর ইবন সা’দ ও মামা ’আবদুল্লাহর দুপুরের খাবারের জন্য পাঠিয়েছেন। বললেনঃ আমার কাছে দাও। আমি খেজুরগুলি রাসূলুল্লাহর সা. দুই হাতে ঢেলে দিলাম, কিন্তু হাত ভরলো না। তিনি কাপড় বিছাতে বললেন এবং খেজুরগুলি কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে দিলেন; তারপর পাশের লেকটিকে বললেনঃ যাও, খন্দকবাসীদের দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে বল। ঘোষণার পর, সবাই চেল এল এবং খাবার খেতে শুরু কর। তাঁরা খাচ্ছে, আর খেজুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকলো। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/১১৮, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬৩১)
ষষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার সন্ধি ও বাই’য়াতে রিদওয়ানেও ’আবদুল্লাহ যোগদান করেন।
আবু রাফে’র পরে উসাইর ইবন রাযিম ইহুদীকে খাইবারের শাসক নিয়োগ করা হয়েছিল। ইসলামের শত্রুতায় সে ছিল উপযুক্ত উত্তরাধিকারী। সে গাতফান গোত্রে ঘুরাঘুরি করে তাদেরকে বিদ্রাহী করে তোলে। হযরত রাসূলে কারীম সা. খবর পেয়ে ষষ্ঠ হিজরীর রমাদান মাসে তিরিশ সদস্যের একটি দলের সাথে ’আবদুল্লাহকে খাইবারে পাঠান। তিনি গোপনে উসাইর ইবন রাযিমের সকল তথ্য সংগ্রহ করে রাসূলুল্লাহকে সা. অবহিত করেন। রাসূল সা. তিরিশ সদস্যের একটি বাহিনী ’আবদুল্লাহর অধীনে ন্যস্ত করে উসাইরকে হত্যার নির্দেশ দেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৭৮)
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা উসাইরের সাথে দেখা করে বলেন, যদি আপনি নিরাপত্তার আশ্বাস দেন তাহলে একটি কথা বলি। সে আশ্বাস দিল। ’আবদুল্লাহ বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। আপনাকে খাইবারের নেতা বানানো তাঁর ইচ্ছা। তবে আপনাকে একবার মদীনায় যেতে হবে। সে প্রলোভনে পড়ে এবং তিরিশজন ইহুদীকে সংগে করে ’আবদুল্লাহর বাহিনীর সাথে চলতে শুরু করলো। পথে ’আবদুল্লাহ প্রত্যেক ইহুদীর প্রতি নজর রাখার জন্য একজন করে মুসলমান নির্দিষ্ট করে দিলেন। এতে উসাইরের মনে সন্দেহের উদ্রেক হল এবং ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। ধোঁকা ও প্রতারণার অপরাধে মুসলিম মুজাহিদরা খুব দ্রুত আক্রমণ চালিয়ে তাদের সকলকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর খাইবারের মাথাচাড়া দেওয়া বিদ্রোহ দমিত হয়। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৬১৮, সীয়ারে আনসার- ২/৬০)
পরে হযরত রাসূলুল্লাহ সা. ’আবদুল্লাহকে খাইবারে উৎপাদিত খেজুর পরিমাপকারী হিসাবে আবারও সেখানে পাঠান। কিছু লোক রাসূলুল্লাহর সা. নিকট ’আবদুল্লাহর কঠোরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো। এক পর্যায়ে তারা ঘুষও দিতে চাইল। ইবন রাওয়াহা তাদেরকে বললেনঃ ওহে আল্লাহর দুশমনরা। তোমরা আমাকে হারাম খাওয়াতে চাও? আমার প্রিয় ব্যক্তির পক্ষ থেকে আমি এসেছি। আমার নিকট তোমরা বানর ও শুকর থেকেও ঘৃণিত। তোমাদের প্রতি ঘৃণা এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা তোমাদের ওপর কোন রকম জুলুমের দিকে নিয়ে যাবে না। একথা শুনে তারা বললঃ এমন ন্যায়পরায়ণতার ওপরই আসমান ও যমীন প্রতিষ্ঠিত। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১০৮, আল বিদায়া- ৪/১৯৯)
হুদাইবিয়ার সন্ধি অনুযায়ী সে বছরের মূলতবী ’উমরাহ রাসূল সা. পরের বছর হিজরী সপ্তম সনে আদায় করেন। একে ‘উমরাতুল কাদা’ বা কাজা ’উমরা বলে। এই সফরে রাসূলে কারীম সা. যখন মক্কায় প্রবেশ করেন এবং উটের পিঠে বসে ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করেন তখন মক্কায় প্রবেশ করেন এবং উটের পিঠে বসে ‘হাজলে আসওয়াদ’ চুম্বন করেন তখন আবদুল্লাহ তার বাহনের লাগাম ধরে একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। কবিতাটির কিছু অংশের মর্ম নিম্নরূপঃ
ওরে কাফিরের সন্তানরা! তোরা তাঁর পথ থেকে সরে যা, তোরা পথ ছেড়ে দে। কারণ, সকল সৎকাজ তো তাঁরই সাথে। আমরা তোদের মেরেছি কুরআনের ব্যাখ্যার ওপর, যেমন মেরেছি তাঁর নাযিলের ওপর। এমন মার দিয়েছি যে, তোদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্ধু ভুলে ফেলে গেছে তাঁর বন্ধুকে। প্রভু আমি তাঁর কথার ওপর ঈমান এনেছি। (তাবাকাত- ৩/৫২৬, আল ইসাবা- ২/৩০৭)
এক সময় হযরত উমার রা. ধমক দিয়ে বলেনঃ আল্লাহর হারামে ও রাসূলুল্লাহর সা. সামনে এভাবে কবিতা পাঠ? রাসূল সা. তাঁকে শান্ত করে বলেনঃ ’উমার! আমি তার কথা শুনছি। আল্লাহর কসম! কাফিরদের ওপর তার কথা তীর বর্শর চেয়েও বেশী ক্রিয়াশীল। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭) তিনি আবদুল্লাহকে বলেনঃ তুমি এভাবে বলঃ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, নাসারা ’আবদাহ ওয়া আ’য়ায্যা জুনদাহ, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহ’- এক আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, তাঁর সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছেন এবং একাই প্রতিপক্ষের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেছেন।
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা উপরোক্ত বাক্যগুলি আবৃত্তি করছিলেন, আর তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করছিলেন সমবেত মুসলিম জনমন্ডলী। তখন মক্কার উপত্যকা সমূহে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছিল। (সীয়ারে আনসার- ২/৬১)
হিজরী অষ্টম সনের জামাদি-ইল-আওয়াল মাসে মূতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাসূলুল্লাহ সা. বসরার শাসকের নিকট দূত মারফত একটি চিঠি পাঠান। পথে মূতা নামক স্থানে এক গাসসানী ব্যক্তির হাতে দূত নিহত হয়। দূতের হত্যা মূলতঃ যুদ্ধ ঘোষণার ইঙ্গিত। রাসূল সা. খবর পেয়ে যায়িদ ইবন হারিসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী মূতায় পাঠান। যাত্রার প্রাক্কালে হযরত রাসূলে কারীম সা. বলেনঃ যায়িদ হবে এ বাহিনীর প্রধান। সে নিহত হলে জা’ফর ইবন আবী তালিব তার স্থলাভিষিক্ত হবে। জা’ফরের পর হবে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। আর সেও যদি নিহত হয় তাহলে মুসলমানরা আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের আমীর বানিয়ে নেবে।
বাহিনী মদীনা থেকে যাত্রার সময় হযরত রাসূলে কারীম সা. ‘সানিয়্যাতুল বিদা’ পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে তাদের বিদায় জানান। বিদায় বেলা মদীনাবাসীরা তাদেরকে বললঃ তোমরা নিরাপদে থাক এবং কামিয়াব হয়ে ফিরে এসো। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা কাঁদতে লাগলেন। লোকেরা বললঃ কাঁদার কী আছে? তিনি বললেন, দুনিয়ার মুহাব্বতে আমি কাঁদছিনা। তিনি সূরা মারিইয়াম এর ৭১ নং আয়াত- ‘তোমাদের প্রত্যেককেই তা (পুলসিরাত) অতিক্রম করতে হবে। এটা তোমার রব-এ অনিবার্য সিদ্ধান্ত’- পাঠ করেন। তারপর তিনি বলেন, আমি কি সেই পুলসিরাত পার হতে পারবো? লোকরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললঃ আল্লাহ তোমাকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে আবার মিলিত করবেন। তখন তিনি স্বরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটির অর্থ নিম্নরূপ। ‘তবে আমি রহমানের কাছে মাগফিরাত কামনা করি, আর কামনা করি অসির অন্তরভেদী একটি আঘাত, অথবা কলিজা ও নাড়িতে পৌঁছে যায় নিযার এমন একটি খোঁচা, আমার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী যেন বলে- হায় আল্লাহ, সে কত ভালো যোদ্ধা ও গাজী ছিল।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৭৪, ৩৭৭ হায়াতুস সাহাবা- ১/৫২৯, ৫৩০)
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, যায়িদ ও জা’ফর বাহিনীসহ সকালে মদীনা ত্যাগ করলেন। ঘটনাক্রমে সেটা ছিল জুময়ার দিন। ’আবদুল্লাহ বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে জুময়ার নামায আদায় করে রওয়াহা হব। তিনি নামায আদায় করলে। রাসূল সা. নামায শেষে তাঁকে দেখে বললেনঃ সকালে তোমার সংগীদের সাথে যাওনি কেন? ’আবদুল্লাহ বললেন, আমি ইচ্ছা করেছি, আপনার সাথে জুম’য়া আদায় করে তাদের সাথে মিলিত হব। রাসূল সা. বললেন, তুমি যদি দুনিয়ার সবকিছু খরচ কর তবুও তাদের সকালে যাত্রার সাওয়াবের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারবে না। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৬৩)
মদীনা থেকে শামের ‘মা’য়ান’ নামক স্থানে পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেন যে, রোমান সম্রাট হিরাকল এক লাখ রোমান সৈন্যসহ ‘বালকা’-র ‘মাব’ নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছে। আর তাদের সাথে যোগ দিয়েছে লাখম, জুজাম, কায়ন, বাহরা, বালী-সহ বিভিন্ন গোত্রের আরও এক লাখ লোক। এ খবর পেয়ে তাঁরা মায়ানে দুই দিন ধরে চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শ করেন। মুসলিম সৈনিকদের কেউ কেউ মত প্রকাশ করে যে, আমরা শত্রুপক্ষের সৈন্যসংখ্যা ও প্রস্তুতির সব খবর রাসূলকে সা. অবহিত করি। তারপর তিনি আমাদেরকে অতিরিক্ত সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবেন অথবা অন্য কোন নির্দেশ দেবেন এবং আমরা সেই মোতাবিক কাজ করব।
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তখন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ওহে জনমন্ডলী, এখন তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হতে পসন্দ করছো না; অথচ তোমার সবাই শাহাদাত লাভের উদ্দেশ্যে বের হয়েছো। আমরা তো শত্রুর সাথে সংখ্যা, শক্তি ও আধিক্যের দ্বারা লড়বো না। আমরা লড়বো দ্বীনের বলে বলীয়ান হয়ে- যে দ্বীনের দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। তোমরা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়। তোমাদের সামনে আছে দুইটি কল্যানের যে কোন একটি হয় বিজয়ী হবে নতুবা শাহাদাত লাভ করবে। সৈনিকরা তাঁর কথায় সায় দিয়ে বললঃ আল্লাহর কসম! ইবন রাওয়াহা ঠিক কথাই বলেছেন। তারা তাদের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে তাদের সাথে চলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৭৫, আসাহ আস-সীয়ার- ২৮০)
তাঁরা ‘মা’য়ান’ ত্যাগ করে মূতায় পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। এখানে অমুসলিমদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘মূতার যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা মাত্র তিনহাজার আর শত্রুবাহিনীর সংখ্যা অগণিত। (সীয়ারে আনসার- ২/৬২)
প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হল। সেনাপতি যায়িদ ইবন হারিসা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলেন। জা’ফর তাঁর পতাকাটি তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনিও শাহাদাত বরণ করলেন। এবার আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ঝান্ডা হাতে তুলে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি ছিলেন ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার মুহূর্তে তাঁর মনে একটু দ্বিধার ভাব দেখা দিল। তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আপন মনে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। তার কিছু অংশ নিম্নরূপঃ
‘হে আমার প্রাণ! আমি কসম করেছি, তুমি অবশ্যই নামবে, তুমি স্বেচ্ছায় নামবে অথবা নামতে বাধ্য করা হবে। মানুষের চিৎকার ও ক্রন্দন ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে, তোমার কী হয়েছে যে, এখনও জান্নাতকে অবজ্ঞা করছো? সেই কত দিন থেকে না এই জান্নাতের প্রত্যাশা করে আসছো, পুরানো ফুটো মশকের এক বিন্দু পানি ছাড়া তো তুমি আর কিছু নও। হে আমার প্রাণ, আজ তুমি নহত না হলেও একদিন তুমি মরবে, এই মৃত্যুর হাম্মাম এখানে উত্তপ্ত করা হচ্ছে। তুমি যা কামনা করতে এখন তোমাকে তাই দেওয়া হয়েছে, তুমি তোমার সঙ্গীদ্বয়ের কর্মপন্থা অনুসরণ করলে হিদায়াত পাবে।’
উপরোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করতে করতে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন। তখন তাঁর এক চাচাতো ভাই গোশতসহ একটুকরো হাড় নিয়ে এসে তার হাতে দেন। তিনি সেটা হাতে নিয়ে যেই না একটু চাটা দিয়েছেন, ঠিক তখনই প্রচণ্ড যুদ্ধের শোরগোল ভেসে এলো। ‘তুমি এখনও বেঁচে আছ’- এ কথা বলে হাতের হাড়টি ছুড়ে ফেলে দিয়ে তরবারি হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শত্রুপক্ষের এক সৈনিক এমন জোরে তীর নিক্ষেপ করে যে, মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। একটি তীর তাঁর দেহে বিদ্ধ হয়। তিনি রক্তরঞ্জিত অবস্থায় সাথীদের আহবন জানান। সাথীরা ছুটে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলে এবং শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। (তাবাকাত- ৩/৫২৯, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৭৯, হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৩৩, সীয়ারে আনসার- ২/৬৩, আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৮০, ২৪৪)
মূতায় অবস্থানকালে শাহাদাতের পূর্বে একদিন রাতে তিনি একটি মর্মস্পর্শী কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। আবৃত্তি শুনে যায়িদ ইবন আরকাম কাঁদতে শুরু করেন। তিনি যায়িদের মাথার ওপর দুররা উঁচু করে ধরে বলেনঃ তোমার কী হয়েছে? আল্লাহ আমাকে শাহাদাত দান করলে তোমরা নিশ্চিন্তে ধরে ফিরে যাবে। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭)
হযরত রাসূলে কালীম সা. ওহীর মাধ্যমে মূতার প্রতি মুহূর্তের খবর লাভ করে মদীনায় উপস্থিত লোকদের সামনে বর্ণনা করছিলেন। সহীহ বুখারীতে আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, মূতার খবর আসার পূর্বেই রাসূল সা. মদীনায় যায়িদ, জা’ফর ও আব্দুল্লাহর শাহাদাতের খবর দান করেন। তিনি বলেনঃ যায়িদ ঝান্ডা হাতে নেয় এবং শহীদ হয়। তারপর জা’ফর তুলে নেয়, সেও শহীদ হয়। অতঃপর আবদুল্লাহ তুলে নেয় এবং সেও শহীদ হয়। তিনি একথা বলছিলেন আর তাঁর দুই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। (আসাহ আস-সীয়ার- ২৮১) কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, যায়িদ ও জা’ফরের শাহাদাতের খবর দেওয়ার পর রাসূল সা. একটু চুপ থাকেন। এতে আনসারদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তারা ধারণা করে যে, ’আবদুল্লাহর এমন কিছু ঘটেছে যা তাদের মনঃপূত নয়। তারপর রাসূল সা. বলেনঃ অতঃপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা পতাকা উঠিয়ে নেয় এবং যুদ্ধ করে শহীদ হয়। তিনি আরও বলেন, তাদের সকলকে জান্নাতে আমার কাছে আনা হয়েছে। আমি দেখলাম, তারা সোনার পালঙ্কে শুয়ে আছে। তবে ’আবদুল্লাহর পালঙ্কটি তার অন্য দুই সঙ্গীর থেকে একটু বাঁকা। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এটা এমন কেন? বলা হলঃ তারা দুইজন দ্বিধাহীন চিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু আবদুল্লাহর চিত্ত দ্বিধা-সংকোচ একটি দোল খায়। তারপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৮০)
মূতার তিন সেনাপতির মৃত্যুর খবর রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পৌঁছলে তিনি উঠে দাঁড়ান এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করে এই বলে দুআ করেনঃ আল্লাহ তুমি যায়িদকে ক্ষমা করে দাও। একথা তিনবার বলেন, তারপর বলেনঃ আল্লাহ তুমি জাফর ও আবদুল্লাহ ইবন রাওযাহাকে ক্ষমা করে দাও। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৩৪৪)
মূতায় যাওয়ার পূর্বে একবার মদীনায় অসুস্থ অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়েন। তখন তাঁর বোন ’উমরাহ নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে আরবদের প্রথা অনুযায়ী বিলাপ শুরু করেন। চেতনা ফিরে পেয়ে তিনি বোনকে বলেন, তুমি আমার সম্পর্কে অতিরঞ্জন করে যা কিছু বলছিলে, তার সবই আমার কাছ থেকে সত্যায়িত করা হচ্ছিল। এই কারণে তাঁর মৃত্যুর সময় তারই উপদেশ মত সকলে ‘সবা’ (ধৈর্য্য) অবলম্বন করে। সহীহ বুখারীতে এসেছে- তিনি যখন মারা যান তাঁর জন্য কান্নাকাটি বা বিলাপ করা হয়নি। (উসুদুল গাবা- ৩/১৪৭-১৫৯, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৮০)
মূতা রওয়ানা হওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী ও সন্তান ছিল। কিন্তু উসুদুল গাবা গ্রন্থকার বলেছেন, তিনি নিহত হন এবং কোন সন্তান রেখে যাননি। (উসুদুল গাবা- ৩/১৫৯, সীয়ারে আনসার- ২/২৬৫)
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার স্ত্রী সম্পর্কে আল-ইসতীয়াব গ্রন্থে একটি কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলেন, তুমি যদি পাক অবস্থায় থাক তাহলে একটু কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাও। তখন ’আবদুল্লাহ চালাকির আশ্রয় গ্রহণ করে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। যার কিছু নিম্নরূপঃ
‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহর ওয়াদা সত্য,
কাফিরদের ঠিকানা দোযখ,
’আরশ ছিল পানির ওপর,
’আরশের ওপর ছিলেন বিশ্বের প্রতিপালক,
আর সেই আরশ বহন করে তাঁরই শক্তিশালী ফিরিশতারা।’’
তাঁর স্ত্রী কুরআনের পারদর্শী ছিলেন না। এই কারণে তিনি বিশ্বাস করেন যে, আবদুল্লাহ কুরআন থেকেই তিলাওয়াত করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ সত্যবাদী, আমার চোখ দেখতে ভুল করেছে। আমি অহেতুক তোমাকে দোষারোপ করছি। দাসীর সাথে উপগত হওয়ার পর স্ত্রীর ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য হযরত আবদুল্লাহ এমন বাহানার আশ্রয় নেন। তিনি পরদিন সকালে এ ঘটনা রাসূলুল্লাহকে সা. জানালে তিনি হেসে দেন। (আল-ইসতীয়াব- ১/৩৬২, হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৫)
সামরিক দক্ষতা ছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার আরও অনেক যোগ্যতা ছিল। একারণে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে সমাদর করতেন। সেই জাহিলী আরবে যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক আরবীতে লেখা জানতো, ’আবদুল্লাহ তাদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল সা. তাঁকে স্বীয় ‘কাতিব’ (লেখক) হিসাবে নিয়োগ করেন। তবে কখন কিভাবে তিনি লেখা শিখেছিলেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস কিছু বলে না।
তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের একজন বিখ্যাত করি। ডক্টর ’উমার ফাররুখ বলেন, ’মদীনায় ইসলাম রাষ্ট্রশক্তি অর্জন করলে আরবের মুশরিকগণ আরও শংকিত হয়ে পড়ে। মক্কার পৌত্তলিক কবিগণ বিশেষতঃ ’আবদুল্লাহ ইবন আয-যিবা’রী, কা’ব ইবন যুহাইর ও আবু সুফইয়ান ইবন আল-হারিস রাসূলুল্লাহ সা. ও ইসলামের নিন্দা ও কুৎসা রটনা করে কবিতা লিখতো। তখন মদীনায় হাসসান ইবন সাবিত, ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ও কা’ব ইবন মালিক তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়িয়ে সমুচিত জবাব দেন এবং ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেন। মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত দু’পক্ষের এ কবিতায় যুদ্ধ চলতে থাকে। ’আবদুল্লাহ ছিলেন তাঁর যুগের ভালো কবিদের একজন। তিনি হাস্সান ও কা’বের সমপর্যায়ের কবি। জাহিলী যুগে তিনি কবি কায়েস ইবনুল খুতাইম- এর সাথে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ মূলক কবিতা লিখে প্রতিযোগিতা করতেন। আর ইসলামী যুগে রাসূলের সা. প্রশংসা এবং মুশরিক কবিদের প্রতিবাদ ও নিন্দায় কবিতা রচনা করতেন। (তারীখুল আদাব আল-আরাবী- ১/২৫৮, ২৬১, ২৬২)
জুরযী যায়দান বলেনঃ ‘মক্কার পৌত্তলিক কবিদের মধ্যে যারা মুসলমানদের নিন্দা করে কবিতা বলতো তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন আয-যিবারী, আবু সুফইয়ান ইবন আল-হারিস ও ’আমর ইবন আল- ’আস ছিল সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। একদিন নবী সা. বললেনঃ যারা তাদের অস্ত্রের দ্বারা আল্লাহর রাসূলকে সাহায্য করেছে, জিহ্বা দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে তাদেরকে কিসে বিরত রেখেছে? এই কথার পর যে তিন কবি উপরোক্ত কবিদের প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে যান তাঁরা হলেন, হাস্সান, ক’ব ও আবদুল্লাহ। রাসুল সা. মনে করতেন, এই তিন কবির কবিতা শত্রুদের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তিনি বলেছেনঃ এই তিন কবি কুরাইশদের কাছে তীরের ফলার চেয়েও বেশী শক্তিশালী। (তারীখু আদাব আল-লুগাহ আল-’আরাবিয়্যাহ- ১/১৯১)
কবি হাস্সান কুরাইশদের বংশ ও রক্তের ওপর আঘাত হানতেন, কবি কা’ব কুরাইশদের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অতীত ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরতেন। পক্ষান্তরে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তাদের কুফরীর জন্য নিন্দা ও ধিক্কার দিতেন। (উসুদুল গাবা- ৪/২৪৮) আবুল ফারাজ আল-ইস্পাহানী বলেনঃ হাস্সান ও কা’ব প্রতিপক্ষ কুরাইশ কবিদের মত যুদ্ধ বিগ্রহ ও গৌরবমূলক কাজ-কর্ম নিয়ে কবিতা রচনা করতেন এবং তার মধ্যে কুরাইশদের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি তুলে ধরতেন। আর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহ তাদের কুফরীর জন্য ধিক্কার ও নিন্দা জানাতেন। কুরাইশদের ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পূর্বোক্ত দু’জনের কবিতা ছিল তাদের নিকট ’আবদুল্লাহর কবিতা অপেক্ষা অধিকতর পীড়াদায়ক। কিন্তু যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করে তার মর্মবাণী উপলব্ধি করলো তখন ’আবদুল্লাহর কবিতা সর্বাধিক প্রভাবশালী ও পীড়াদায়ক বলে তাদের নিকট প্রতিভাত হলো। (কিতাবুল আগানী- ৪/১৩৬)
আবদুল্লাহ ছিলেন স্বভাব কবি। উপস্থিত কবিতা রচনায় দক্ষ ছিলেন। হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াব রা. বলেনঃ তাৎক্ষণিক কবিতা বলার ক্ষেত্রে আমি ’আবদুল্লাহ অপেক্ষা অধিকতর সক্ষম আর কাউকে দেখিনি। (তাহীবুল আসমা ওয়াল লূগাত- ১/২৬৫) একদিন তিনি মসজিদে নববীতে। পূর্বেই সেখানে হযরত রাসূলে কারীম সা. একদল সাহাবীর সাথে বসে ছিলেন। তিনি ’আবদুল্লাহকে কাছে ডেকে বলেন, তুমি এখন মুশরিকদের সম্পর্কে কিছু কবিতা শোনাও।’ আবদুল্লাহ কিছু কবিতা শোনালেন। কবিতা শুনে রাসূল সা. একটু হাসি দিয়ে বলেন, আল্লাহ তোমাকে অটল রাখুন। (আল-ইসতীয়াব- ১/৩৬২, তাবাকাত- ৩/৫২৮, আল-ইসাবা- ২/৩০৭)
হযরত আবু হুরাইরা রা. ওয়াজ নসীহাতের সময় বলতেন, তোমাদের এক ভাই আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা অশ্লীল কথা বলতেন। তারপর তিনি ’আবদুল্লাহর একটি কবিতা আবৃত্তি করতেন। ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে কবিতাটি সংকলটন করেছেন। (আল-ফাতহুর রাব্বানী, শরহু মুসনাদ আহমাদ- ২২/২৮৭)
’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার সব কবিতা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে এখনও পঞ্চাশটি শ্লোক (verse) সীরাত ও ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। সীরাতু ইবন হিশামে তার অধিকাংশ পাওয়া যায়। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা (উর্দু)- ১২/৭৮০)
যখন সূরা শু’য়ারা- এর ২২৪-২২৬ নং আয়াতগুলি- ‘কবিদেরকে তারাই অনুসরণ করে যারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখনা তারা উদভ্রান্ত হয়ে প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়? এবং যা করে না তাই বলে বেড়ায়’- নাযিল হয় তখন হাস্সান, আবদুল্লাহ ও কাব এত ভীত হয়ে পড়েন যে, তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট ছুটে যান। তাঁরা বলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই আয়াত নাযিলের সময় আল্লাহ তো জানতেন আমরা কবি। তখন রাসূল সা. আয়াতের পরবর্তী অংশ- ‘কিন্তু তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আল্লাহকে বার বার স্মরণ করে ও অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে’- পাঠ করেন এবং বলেন এই হচ্ছো তোমরা। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭, তাবাকাত- ৩/৫২৮, হায়াতুস সাহাবা- ৩/৭৭, ১৭২)
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা থেকে কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি হাদীসগুলি খোদ রাসূল সা. ও বিলাল থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন ইবন ’আব্বাস, উসামা ইবন যায়িদ, আনাস ইবন মালিক, নু’মান ইবন বাশীর ও আবু হুরাইরা। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬)
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ছিলেন একজন দুনিয়া বিরাগী ’আবিদ ও সব সময় আল্লাহকে স্মরণকারী (জাকির) ব্যক্তি। আবুদ দারদা বলেনঃ এমন কোন দিন যায়না যেদিন আমি তাঁকে স্মরণ করিনা। আমার সঙ্গে একত্র হলেই তিনি বলতেনম, এস, কিছুক্ষণের জন্য আমরা মুসলমান হয়ে যাই। তারপর বসে ‘জিকর’ শুরু করতেন। ‘জিকর’ শেষ হলে বলতেন, এটা ছিল ঈমানের মজলিস। (উসুদুল গাবা- ৩/১৫৭)
আনাস ইবন মালিক বলেন। ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার সাথে রাসূলুল্লাহর সা. কোন সাহাবীর দেখা হলে বলতেন, এস, আমরা কিছু সময়ের জন্য ঈমান আনি। একদিন এক ব্যক্তি তাঁর এমন কথায় খুব রেগে গেল। সে সোজা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট অভিযোগ করে বললঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি কি দেখেন না, ইবন রাওয়াহা আপনার ঈমান ত্যাগ করে কিছুক্ষণের ঈমানকে পসন্দ করছে? তিনি বললেন, আল্লাহ ইবন রাওয়াহার ওপর রহম করুন। সে এমন সব মজলিস পসন্দ করে যার জন্য ফিরিশতারাও ফখর করে থাকে।
একবার তো তাঁর এমনি ধরণের আহ্বানে এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করে বলে বসলো, কেন আমরা কি মুমিন নই? তিনি বললেনঃ হাঁ, আমরা মুমিন। তবে আমরা জিকর করবো, তাতে আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে। (আল-ফাতহুল রাব্বানী- ২২/২৮৬, হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৫)
তাঁর স্ত্রী বর্ণনা করেন, যখন তিনি ঘর থেকে বের হতেন, দুই রাকায়াত নামায আদায় করতেন। আবার ঘরে ফিরে এসে ঠিক একই রকম করতেন। এ ব্যাপারে কক্ষণও অলসতা করতেন না। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭, হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৪৮)
একবার এক সফরে এত প্রচণ্ড গরম ছিল যে, মানুষ সূর্যের তেজ থেকে বাঁচার জন্য নিজ নিজ মাথার ওপর হাত দিয়ে রেখেছিল। এমন গরমে কে রোযা রাখে? কিন্তু তার মধ্যেও কেবল হযরত রাসূলে কারীম সা. ও ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ‘সাওম’ পালন করেন। (সহীহ বুখারী- ১/২৬১, মুসলিম- ১/৩৫৭, হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৭৯, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/২৬৫)
জিহাদের প্রতি ছিল তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ। বদর থেকে নিয়ে মূতা পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে তার একটিতেও তিনি অনুপস্থিত থাকেননি। রিজাল শাস্ত্রবিদরা (চরিত অভিধান) বলেছেনঃ আবদুল্লাহ সবার আগে যুদ্ধে বের হতেন এবং সবার শেষে ঘরে ফিরতেন। (আল-ইসাবা- ২/৩০৭)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. আদেশ-নিষেধ তিনি অক্ষরে পালন করতেন। একটি ঘটনায় এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার হযরত রাসূলে কারীম সা. মসজিদে খুতবা (ভাষণ) দিচ্ছেন। আর ইবন রাওয়াহা যাচ্ছেন মসজিদের দিকে। তিনি যখন মসজিদের বাইরের রাস্তায় এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন রাসূল সা. বলছেন, তোমরা নিজ নিজ স্থানে বসে পড়। এই নির্দেশ ইবন রাওয়াহার কানে যেতেই সেখানে বসে পগেন। রাসূল সা. খুতবা শেষ করার পর কোন এক ব্যক্তি ইবন রাওয়াহার ব্যাপারটি তাঁকে শোনান। শুনে তিনি মন্তব্য করেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের লালসা আল্লাহ তার মধ্যে আরও বৃদ্ধি করে দিন। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬, হায়াতুস সাহাবা- ২/৩৫৬)
হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা যেমন রাসূলকে সা. গভীরভাবে ভালোবাসতেন তেমনি রাসূল সা.-ও তাঁকে ভালোবাসতেন। একবার আবদুল্লাহ অসুখে পড়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। রাসূল সা. দেখতে গেলেন। তিনি দু’আ করলেঃ হে আল্লাহ, যদি তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসে থাকে তাহলে সহজে তার মরণ দাও অন্যথায় তাকে ভালো করে দাও। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬)
উসামা ইবন যায়িদ বলেনঃ সা’দ ইবন ’উবাদা অসুস্থ হলে রাসূল সা. তাঁকে দেখার জন্য বের হলেন। আমাকেও বাহনের পিছনে বসিয়ে নিলেন। ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই তার মুযাহিম দুর্গের ছায়ায় নিজ গোত্রের আরও কিছু লোকের সাথে বসে ছিল। রাসূল সা. মনে করলেন, কোন কথা না বলে তাদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া শিষ্টাচারের পরিপন্থী। তাই তিনি বাহনের পিছ থেকে নামলেন এবং সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ বসলেন। তারপর কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে তাদের সকলকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এতক্ষণ ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই চুপ করে ছিল। রাসূলুল্লাহর সা. কথা শেষ হলে সে বললঃ দেখুন, আপনার কথা সত্য হলে বাড়ীতে গিয়ে বসে থাকুন। কেউ আপনার কাছে গেলে তাকে যত পারেন শুনাবেন। এমন অবাঞ্ছিতভাবে কোন মজলিসে উপস্থিত হয়ে কাউকে বিরক্ত করবেন না। সেখানে উপস্থিত মুসলমানদের মধ্যে ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও ছিলেন। তিনি গর্জে উঠলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, তার কথা কক্ষণও মানবেন না। আপনি আসবেন! আপনি আমাদের মজলিসে, ঘরে ঘরে এবং বাড়ীতে বাড়ীতে আসবেন। আমরা সেটাই পসন্দ করি। আপনার আগমণের দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন, আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ১/৫৮৭, হায়াতুস সাহাবা- ২/৫০৯)
একদিন আবদুল্লাহ তাঁর স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে কাঁদা শুরু করলেন। তাই দেখে স্ত্রীও কাঁদতে লাগলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কাঁদছো কেন? স্ত্রী বললেনঃ তোমাকে কাঁদতে দেখে আমি কাঁদছি। তখন তিনি সূরা মরিয়াম- এর ৭১ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেন, আমি এই আয়াতটি স্মরণ করে কাঁদছি। জানিনে আমি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাব কিনা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৪৫)
বিখ্যাত আনসারী সাহাবী আবু দারদা-র ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আবদুল্লাহর ভূমিকাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জাহিলী যুগে উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। ’আব্দুল্লাহর ইসলাম গ্রহণের পরও আবু দারদা মূর্তি উপাসক থেকে যান। তাঁর বাড়ীতে ছিল বিরাট এক মূর্তি। একদিন আবু দারদা বাড়ী থেকে বের হলেন, আর ঠিক সেই সময় ভিন্ন পথ দিয়ে আবদুল্লাহ বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলেন। তিনি আবু দারদা-র স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আবু দারদা কোথায়? স্ত্রী জবাব দিলেনঃ এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন। আবদুল্লাহ মূর্তির ঘরে প্রবেশ করে সেখানে রক্ষিত একটি হাতুড়ী দিয়ে মূর্তিটি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেললেন। শব্দ শুনে আবু দারদা-র স্ত্রী ছুটে গেলেন। আবদুল্লাহ কাজ শেষ করে চলে গেলেন। এ দিকে আবু দারদা-র স্ত্রী ভয়ে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আবু দারদা ঘরে ফিরে স্ত্রীর নিকট সব কথা শুনে প্রথমে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করলেন, যদি মূর্তির কোন ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হতো। এই উপলব্ধির পর তিনি আবদুল্লাহকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট যান এবং ইসলামের ঘোষণা দেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৩২, ৩৩৩)
একবার কবি হাস্সান ইবন সাবিত, একটি কবিতায় সাফওয়ান ইবন আল-মুয়াত্তাল ও তাঁর গোত্রের নিন্দা করেন। সাফওয়ান ক্ষেপে গিয়ে কবিকে মারপিট করে এবং তাঁকে দু’হাত গলার সাথে বেঁধে বনু আল-হারিসের পল্লীতে নিয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তাকে ছাড়িয়ে দেন এবং বিষয়টি রাসূলুল্লাহকে সা. অবহিত করেন। তাদের দু’জনকেও রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে নিয়ে আসেন। তিনি তাদের ঝগড়া মিটমাট করে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩০৫)
উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে রাসূল সা. তাঁর প্রশংসায় বলেছেনঃ ‘নি’মার রাজুলু আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা’- আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা কতই না ভালো মানুষ। (আল-ইসাবা- ২/৩০৬)


আবূ সা’ঈদ আল-খুদারী (রা)

রবিবার, অক্টোবর ২০, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে

আবূ সা’ঈদ আল-খুদারী (রা)

নাম সা’দ, ডাক নাম আবূ সা’ইদ। খুদরাহ বংশের সন্তান হওয়ার কারণে খুদারী বা খুদরী বলা হয়। তাঁর পিতা মালিক ইবন সিনান উহুদের অন্যতম শহীদ। এ যুদ্ধে হযরত রাসূলে কারীম সা. আহত হলে তিনি রাসূলের সা. পবিত্র খুন চুষে গিলে ফেলেন। রাসূল সা. তখন মন্তব্য করেনঃ ‘আমার রক্ত যার রক্তে মিশেছে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।’ (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৮০, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) তাঁর মা উনায়সা বিনতু আবী হারিসা বনু ’আদী ইবন নাজ্জারের কন্যা। দাদা সিনান ছিলেন মহল্লার রয়িস। তিনি ছিলেন একটি কিল্লার অধিপতি ও ইসলাম পূর্ব যুগের একজন বিচারক।
তাঁর মার প্রথম স্বামী ছিল আউস গোত্রের ’আম্মান নামক এক ব্যক্তি। সে মারা যায়। রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় আগমনের পূর্বে তিনি মালিক ইবন সিনানকে দ্বিতীয় স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁদেরই সন্তান আবূ সা’ঈদ হিজরাতের দশ বছর পূর্বে ৬১৩ খ্রীস্টাব্দে ইয়াসরিবে জন্মগ্রহণ করেন। (আল-ইসাবা- ৪/৮৮, আল-আ’লাম- ৩/১৩৮) প্রখ্যাত বদরী সাহাবী কাতাদাহ ইবন নু’মান রা.- উহুদ যুদ্ধে যাঁর চোখ আহত হয় এবং রাসূলুল্লাহর সা. দু’আর বরকতে আবার ভালো হয়ে যায়- আবূ সা’ঈদের বৈপিত্রীয় ভাই। হিজরী ২৩ সনে এই কাতাদাহ মারা গেলে আবূ সা’ঈদ তাঁকে কবরে নামিয়ে দাপন করেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৪২, উসুদুল গাবা- ৫/২১১)
বাই’য়াতে আকাবা থেকেই মোটামুটি মদীনায় ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়। মদীনাবাসীদের অনেকেই তখন ইসলামী দা’ওয়াত ও তাবলীগের কাজে আত্ননিয়োগ করেন। এই সময় মালিক ইবন সিনান ইসলাম কবুল করেন। স্বামীর সাথে স্ত্রীও মুসলমান হন। সুতরাং আবূ সা’ঈদ মুসলিম মা-বাবার কোলেই বেড়ে উঠেন।
হিজরাতের প্রথম বছরেই মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আবূ সা’ঈদ এই নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। তিনি হযরত রাসূলে কারীমের সা. সাথে মোট বারোটি যুদ্ধে যোগ দেন। (তাহজীবুল আসমা- ২/২৩৭, আল-আ’লাম- ৩/১৩৮) অল্প বয়সের কারণে বদর যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। উহুদ যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর। যুদ্ধের পূর্বে পিতার সাথে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট যান। রাসূল সা. তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করেন এবং এখনও যুদ্ধের বয়স হয়নি- এই বলে ফিরিয়ে দেন। পিতা মালিক তখন রাসূলুল্লাহর সা. হাত ধরে বলেন, ছেলের বয়স কম হলে কি হবে, তার হাত দু’টি পুরুষের মত সবল। তবুও রাসূল সা. তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। (আল-ইসাবা- ২/৩৫; আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩০)
এই উহুদ যুদ্ধে হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র মুখমন্ডল আহত হয়ে রক্ত রঞ্জিত হয়। মালিক ইবন সিনান সেই রক্ত পান করেন। রাসূল সা. মন্তব্য করেনঃ ‘যদি কারও এমন ব্যক্তিকে দেখার ইচ্ছা হয় যার রক্ত আমার রক্তের সাথে মিশেছে, সে যেন মালিক ইবন সিনানকে দেখে। এরপর বীরের মত যুদ্ধ করে মালিক শাহাদাত বরণ করেন।
আবূ সা’ঈদের পিতা কোন সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন না। এ কারণে পিতার মৃত্যুতে তিনি পর্বত পরিমাণ বিপদের সম্মুখীন হলেন। দারিদ্র ও অনাহারে সময় সময় পেটে পাথর বেঁধে কাটাতেন। একদিন তিনি প্রচন্ড ক্ষুধায় পেটে পাথর বেঁধে আছেন। তখন তাঁর স্ত্রী (মতান্তরে মা অথবা দাসী) তাঁকে বললেনঃ নবীর সা. কাছে যাও, তাঁর কাছে কিছু চাও। অমুক এসে সাহায্য চেয়েছিল, তাকে তিনি দিয়েছেন। আবূ সা’ঈদ বলেনঃ আমি যখন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গেলাম তিনি তখন ভাষণ দিচ্ছেন এবং বলছেনঃ ‘যে নিজেকে গনী বা ধনী মনে করে আল্লাহও তাকে ধনবান করে দেন। আর যে আমার কাছে কোন কিছু চাওয়া থেকে বিরত থাকে সে ঐ ব্যক্তির থেকেও আমার বেশী প্রিয় যে আমার কাছে চায়।’ একথা শুনে আমি আর কিছু চাইলাম না। আমি বাড়ী ফিরে এলাম। অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের রিযকে বরকত বা সমৃদ্ধি দান করতে লাগলো। অবশেষে, আনসারদের মধ্যে কোন বাড়ী আমাদের চেয়ে বেশী বিত্তশালী ছিল বলে আমি জানতাম না। (মুসনাদ- ৩/৪৪৯; হায়াতুস সাহাবা- ২/২৫৭)
খন্দক ও বনী মুসতালিকের যুদ্ধে তিনি যোগ দেন। তবে ‘উসুদুল গাবা’ গ্রন্থের একটি বর্ণনায় এসেছেঃ ‘আবূ সা’ঈদ বলেনঃ খন্দকের দিন আমার পিতা আমার হাত ধরে রাসূলুল্লাহর সা. সামনে নিয়ে বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! এর হাড় খুব শক্ত।’ এরপরও তিনি আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেন। তিনি আরও বলেনঃ ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বনী মুসতালিক যুদ্ধে যোগ দিই।’ ওয়াকিদী বলেনঃ ‘তখন আবূ সা’ঈদের বয়স পনেরো বছর।’ (উসুদুল গাবা- ৫/২১১, আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৩৪)
ইমাম আহমাদ আবূ সা’ঈদ খুদারী থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা খন্দকের দিন বললামঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের প্রাণ তো গলায় এসে ঠেকেছে। এমন কোন দু’আ কি আছে যা আমরা পাঠ করতে পারি? বললেনঃ হাঁ। বলঃ আল্লাহুম্মা উসতুর ’আওরাতিনা ওয়া আমিন রাও’য়াতিনা- হে আল্লাহ আমাদের গোপন বিষয় গোপন রাখ এবং আমাদের ভীতিকে নিরাপত্তা দান কর।’ (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৮৮)
তিনি ‘বাই’য়াতুশ শাজারা’ বা ‘বাই’য়াতুর রিদওয়ানে’ অংশগ্রহণ করেন। (শাজারাতুজ জাহাব- ১/৮১; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) হিজরী ৮ম সনের সফর মাসে ’আবদুল্লাহ ইবন গালিব লায়সীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য ফিদাক যায়। তিনিও এই বাহিনীতে ছিলেন। আবদুল্লাহ সৈন্যদের তাকীদ দেন, তারা যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। এই উদ্দেশ্যে তিনি বাহিনীর সদস্যদের পরস্পরের সাথে মাওয়াখাত বা ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। তাঁকেও একজন বিশিষ্ট সাহাবীর সাথে ভ্রাতৃত্ব কায়েম করে দেন।
হিজরী ৯ম সনের বারী’উস সানী মাসে ’আরকামা ইবন মুখাররকে ছোট একটি বাহিনীসহ একটি অভিযানে পাঠানো হয়। আবূ সা’ঈদ ছিলেন এ বাহিনীর অন্যতম সদস্য। (মুসনাদ- ৩/২৭০; হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৭)
উপরোক্ত যুদ্ধগুলি ছাড়াও মক্কা বিজয়, হুনাইন, তাবুক, আওতাস প্রভৃতি অভিযানে তাঁর অংশগ্রহণের কথা সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। সহীহ বুখারীর বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. যুগে সংঘটিত মোট ১২ টি যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণের গৌরব অর্জন করেন। তিনি তাবুক যুদ্ধে মুসলমানদের চরম অভাব ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। হুনাইন যুদ্ধে লব্ধ গনীমাতের বেশীর ভাগ যখন রাসূল সা. মক্কাবাসী নওমুসলিমদের খুশী (তালীফে কুলুম) করার জন্য দান করেন তখন মদীনার আনসারদের অনেকে একটু ক্ষুণ্ন হন। এ সম্পর্কিত ঘটনা আবূ সা’ঈদ বর্ণনা করেছেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৯৭-৩৯৮; ৩/৬২৫) তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমরা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যুদ্ধে গিয়েছি রমজান মাসে। আমাদের কেউ সাওম পালন করতো, আবার কেউ করতো না। তবে একে অপরকে কোন রকম হিংসা করতো না। তারা প্রত্যেকেই জানতো যে, যে ব্যক্তি নিজেকে সক্ষম মনে করবে সে সাওম পালন করবে, আর এটাই তার জন্য উত্তম। আর যে নিজেকে দুর্বল ও অক্ষম মনে করবে সে সাওম পালন করবে না। আর এটাই তার জন্য উত্তম।’ (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৭৯)
একবার হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁদেরকে একটি ছোটখাট অভিযানে পাঠালেন। বাহিনীর সর্বমোট সদস্য তিরিশজন এবং নেতা আবূ সা’ঈদ। যাত্রা পথে তাঁরা একটি স্থানে তাঁবু স্থাপন করে যাত্রা বিরতি করেন। নিকটেই ছিল একটি জনপদ। তাঁরা সেই জনপদের লোকদের বললেন, আমরা আপনাদের অতিথি। কিন্তু তারা অতিথিদের সেবা করতে পরিষ্কার অস্বীকার করলো। ঘটনাক্রমে সেইদিন উক্ত জনপদের প্রধানকে বিচ্ছুতে কামড়ায়। নানা জনে নানা রকম চিকিৎসা চালালো’ কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তাদেরকে কেউ পরামর্শ দিল, তোমরা এই অতিথিদের কাছে যাও, তাদের মধ্যে কারও হয়তো কোন চিকিৎসা জানা থাকতে পারে। পরামর্শমত তারা এসে বিষয়টি জানালো। আবূ সা’ঈদ বললেন, ‘আমি ঝাড়-ফুঁক জানি, তবে পারিশ্রমিক হিসেবে তিরিশটি ছাগল দিতে হবে। তারা রাজি হয়ে গেল। আবূ সা’ঈদ তাদের সাথে গেলেন এবং সূরা মুহাম্মাদ পাঠ করে দংশিত স্থানে একটু থু থু লাগিয়ে দিলেন। তাতেই লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। সাহাবায়ে কিরাম তিরিশটি ছাগল নিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করলেন। তাঁদের মনে দ্বিধা ও সংশয় ছিল, এভাবে ছাগলগুলি নেওয়া ঠিক কিনা। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো যে, বিষয়টি রাসূলুল্লাহকে সা. জানানো হবে। মদীনায় পৌঁছেই তাঁরা রাসূলুল্লাহকে সা. ঘটনাটি খুলে বলেন। সবকিছু শুনে তিনি একটু মুচকি হাসি দেন। তারপর বলেন, তোমরা কিভাবে জানলে যে, এই সূরা ঝাড়-ফুঁকের কাজ দেয়? তোমরা ঠিকই করেছ। বকরীগুলি তোমরা ভাগ করে নেবে এবং আমাকেও একটি অংশ দিতে ভুল করবে না। (সহীহুল বুখারী- ১/২৫১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের পর তিনি মদীনাতেই অবস্থান করেন। খলীফা হযরত ’উমার ও হযরত ’উসমানের রা. যুগে ফাতওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। যিয়াদ ইবন মীনা’র সূত্রে ইবন সা’দ বর্ণনা করেছেনঃ ইবন ’আব্বাস, ইবন ’উমার, আবূ সা’ঈদ খুদারী, আবূ হুরাইরা, আবদুল্লাহ ’আমর ইবনুল ’আস, জাবির ইবন ’আবদিল্লাহ প্রমুখ আসহাবে রাসূল ’উসমানের মৃত্যুর সময় থেকে তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত মদীনায় ফাতওয়া দিতেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস বর্ণনা করতেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৫৫)
হযরত আলীর রা. যুগে খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে তিনি যোগ দেন। তখন তিনি বলতেন, তুর্কীদের চেয়ে খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমি বেশী প্রয়োজন মনে করি। (মুসনাদ- ৩/৩৩, ৫৬) হযরত ইমাম হুসাইন যখন মদীনা ছেড়ে কুফায় যাওয়া স্থির করেন, তখন আরও অনেক সাহাবীর মত আবূ সা’ঈদও তাঁকে এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। (সুয়ূতীঃ তারীখুল খুলাফা)
হিজরী ৫৯ সনে হযরত উম্মু সালামা রা. ইনতিকাল করলে আবূ সা’ঈদ তাঁর জানাযায় শরীক ছিলেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৩২) হিজরী ৬১ সনে হিজাযবাসীরা ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাসূলুল্লাহর সা. ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের ইবনুল ’আওয়ামের রা. হাতে বাই’য়াত করে। এই বাই’য়াতকারীদের মধ্যে হযরত আবূ সা’ঈদও ছিলেন।
হিজরী ৬৩ সনে দারুল হিজরাহ্ মদীনার অধিবাসীরা ইয়াযীদের আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে গাসীলুল মালায়িকা হযরত হানজালার ছেলে হযরত ’আবদুল্লাহর হাতে বাই’য়াত করে তাঁকে নিজেদের আমীর বলে ঘোষণা দেয়। ইয়াযীদের বাহিনী মদীনা আক্রমণ করে মদীনাবাসীদের পরাভূত করে। হযরত ’আবদুল্লাহ ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। বিজয়ী ইয়াযীদ বাহিনী সেই সময় মদীনায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসের তান্ডবলীলা সৃষ্টি করে। রাসূলুল্লাহর সা. হারাম বা সম্মানিত শহর মদীনার এমন অসম্মান ও অবমাননা সেই সময় জীবিত সাহাবীরা দেখে দারুন মর্মাহত হন। আবূ সা’ঈদও এমন দৃশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে পাহাড়ের এক গুহায় আত্মগোপন করেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর খোঁজে একজন পৌঁছে যায় এবং তাঁকে হত্যার জন্য তরবারি উঠায়। তিনি প্রথমতঃ তাকে ভয় দেখানোর জন্য তরবারি তুলে ধরেন। কিন্তু সৈন্যটি আরও এগিয়ে এলে তিনি তরবারি মাটিতে রেখে দিয়ে সূরা আল-মায়িদার ২৮ নং আয়াতটি পাঠ করেনঃ
‘যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তোমার হাত বাড়াও তবুও আমি তোমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আমার হাত বাড়াবো না। কারণ, আমি আল্লাহ রাব্বুল ’আলামীনকে ভয় করি।’
সৈনিকটি থেমে যায়। সে প্রশ্ন করে, আল্লাহর ওয়াস্তে বলুন তো আপনি কে? বললেনঃ আমি আবূ সা’ঈদ আল খুদারী। আপনি কি রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী? বললেন, হাঁ। সৈনিকটি গুহা ছেড়ে চলে গেল। (আল-ইসাবা- ৩/৫৫) আবূ সা’ঈদ গুহা থেকে বাড়ী আসলেন। নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ চললো এবং বন্দী করা হলো। অবশেষে প্রচন্ড চাপের মুখে ইয়াযীদের প্রতি বাই’য়াত করতে বাধ্য হলেন।
একথা হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. অবগত হয়ে তাঁর কাছে যান এবং বলেনঃ শুনেছি আপনি নাকি দুই আমীরের বাই’য়াত বা আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছেন? বললেনঃ হাঁ। প্রথমে ’আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের এবং বন্দী হওযার পরে ইয়াযীদের প্রতি বাই’য়াত করেছি। ইবন ’উমার বললেনঃ আমি এমনই আশংকা করেছিলাম। আবূ সা’ঈদ বললেনঃ কিন্তু আমার করার কি ছিল? কারণ, আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছি, মানুষের প্রতিটি সকাল ও সন্ধ্যা কোন না কোন আমীরের অধীনে অতিবাহিত হওয়া উচিত। একথা শুনে ইবন ’উমার বললেন, যাই হোক না কেন, আমি দুই আমীরের প্রতি বাই’য়াত পছন্দ করিনে। (মুসনাদ- ৩/২৯, ৩০)
বেশী সংখ্যক বর্ণনা মতে তিনি হিজরী ৭৪ বছর জীবন লাভ করেছিলেন। তবে আল্লামা জাহাবী লিখেছেন, তিনি ৮৬ বছর বয়সে মারা যান এবং এটাই সঠিক। (দ্রঃ তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৩৭, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ২/২৩৭, আল-আ’লাম- ৩/১৩৮, শাজারাতুজ জাহাব- ১/৮১, উসুদুল গাবা- ৫/২১১)
হযরত আবূ সা’ঈদের ছিল দুই স্ত্রী। একজনের নাম যয়নাব বিনতু কা’ব ইবন আজযাহ্। কেউ কেউ বলেছেনম তিনি সাহাবিয়্যা ছিলেন। দ্বিতীয়জন উম্মু ’আবদিল্লাহ বিনতু ’আবদিল্লাহ নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর সন্তানদের নামঃ আবদুর রহমান, হামযাহ্ ও সা’ঈদ।
হযরত আবূ সা’ঈদ ছিলেন আহলুস্ সুফ্ফার অন্যতম সদস্য। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ ফকীহ। কোন ক্বারীর নিকট কুরআন তিলাওয়াত শিখেছিলেন। তাঁর শিক্ষা জীবনে আনসারদের কয়েকটি হালকায়ে দারস ছিল। সেখানে আনসারদের ’আলিম ব্যক্তিরা দারস দিতেন। আবূ সা’ঈদের ছাত্র জীবনের যুগটি ছিল ইসলামের প্রথম যুগ। সেই সময় মানুষ ঠিক মত শরীর ঢাকার মত কাপড়ও সংগ্রহ করতে পারতো না। হালকায়ে দারসে একজন আর একজনের আড়ালে আবডালে চুপে চুপে বসে যেত। একদিন এমন একটি হালকায়ে দারসে হযরত রাসূলে কারীম সা. উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে ক্বারীর কিরাত থেমে গেল। তিনি সবাইকে গোল হয়ে বসতে বলে নিজেও তাদের সাথে বসে গেলেন। সেই হালকায় সে দিন যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে একমাত্র আবূ সা’ঈদকে রাসূল সা. চিনতেন। (মুসনাদ- ৩/৬৩, হায়াতুস সাহাবা- ৩/২০৪)
হাদীস ও ফিকাহর জ্ঞান তিনি সরাসরি রাসূল সা. ও অন্য সাহাবীদের নিকট থেকে অর্জন করেন। চার খলীফা ও যায়িদ ইবন সাবিতের নিকট থেকে তিনি হাদীস শোনেন। অসংখ্য হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ১১৭০ টি। যাঁরা বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন তিনি এমন একজন হাফেজে হাদীস। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ৪৩ টি মতান্তরে ৪৬ টি মুত্তাফিক ’আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম সম্মিলিতভাবে বর্ণনা করেছেন।) এবং বুখারী ও মুসলিম প্রত্যেকেই এককভাবে যথাক্রমে ১৬ টি ও ৫২ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। যে সকল বিখ্যাত সাহাবী ও তাবে’ঈ তাঁর নিকট থেকে হাদীস শোনেন ও বণৃনা করেন তাঁদের কয়েকজন নাম নিম্নে দেওয়া গেলঃ
যায়িদ ইবন সাবিত, ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস, আনাস ইবন মালিক, ইবন ’উমার, ইবন যুবাইর, জাবির, আবূ কাতাদাহ, ইবন ’আমর, মাহমূদ ইবন লাবীদ, আবুত তুফায়েল, আবূ উমামা ইবন সাহল, সা’ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, তারিক ইবন শিহাব, ’আতা, মুজাহিদ, আবূ ’উসমান আন-নাহদী, ’উবায়দ ইবন ’উমায়র, ’আয়্যাদ ইবন আবী সারাহ, বুসর ইবন সা’ঈদ, আবূ নুদবাহ, ইবন সীরীন প্রমুখ। (দ্রঃ আল-ইসাবা- ২/৩৫, তাজকিরাতুল হুফফাজ- ১/৪৪, তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ২/২৩৭, আল-আ’লাম- ৩/১৩৮)
তাঁর হালকায়ে দারস সব সময় ছাত্রে পরিপূর্ণ থাকতো। কেউ কোন প্রশ্ন করতে চাইলে অনেক প্রতীক্ষার পর সুযোগ পেত। (মুসনাদ-৩/৩৫) দারসের সময় ছাড়াও যে কোন সময় লোকে তাঁর কাছে বিভিন্ন মাসয়ালা জানতে পারতো। প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিতেন। একবার ইবন ’আব্বাস ছেলে ’আলী ও দাস ’আকরামাকে বললেন, যাও তো আবূ সা’ঈদের নিকট থেকে হাদীস শুনে এস। তারা যখন পৌঁছলেন, আবূ সা’ঈদ তখন বাগিচায়, তিনি তাদের সাথে বসেন এবং হাদীস শোনান। (মুসনাদ- ৩/৯০, ৯১)
হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে কিভাবে তিনি সে হাদীস শুনেছিলেন সে অবস্থারও বর্ণনা দিতেন। হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. কোন এক ব্যক্তির নিকট থেকে একটি হাদীস শোনেন। এই লোকটি আবূ সা’ঈদের সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করে। ইবন ’উমার ঐ লোকটিকে সংগে করে আবূ সা’ঈদের নিকট যান এবং প্রশ্ন করেনঃ এই ব্যক্তি কি অমুক হাদীসটি আপনার নিকট থেকে শুনেছে? আর আপনি কি তা রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনেছেন? তিনি বললেনঃ আমার দু’চোখ দেখেছে এবং দু’কান শুনেছে। (মুসনাদ- ৩/৪)
একবার কুয’য়া নামক একজন ছাত্রের নিকট একটি হাদীস খুব ভালো লাগে। তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন, হাদীসটি কি আপনি রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনেছেন? এমন প্রশ্নে তিনি একটু ক্ষুব্ধ হলেন। বললেনঃ তাহলে কি না শুনেই আমি বর্ণনা করছি? হাঁ, আমি শুনেছি। (মুসনাদ- ৩/৯১)
যে সকল হাদীস রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শোনা শব্দাবলীর ওপর আস্থা না হতো সেগুলি বর্ণনার ব্যাপারে দারুন সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যেমন একবার একটি হাদীস বর্ণনা করলেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহর সা. নামটি উচ্চারণ করলেন না। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করে বসলো, এটা কি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণিত? বললেনঃ আমিও জানি।
আবূ সা’ঈদ হযরত রাসূলে কারীমের সা. উপদেশ মত তাঁর ছাত্রদের আন্তরিকভাবে স্বাগতম জানাতেন। ইমাম তিরমিযী আবূ হারুন থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমরা আবূ সা’ঈদের কাছে গেলে বলতেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. অসীয়াতের (উপদেশ) প্রতি স্বাগতম। নবী সা. বলেছেনঃ মানুষ তোমাদের অনুসরণ করবে। কিছু লোক নানা স্থান থেকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে তোমাদের কাছে আসবে। তারা যখন তোমাদের কাছে আসবে তোমরা তাদের ভালো উপদেশ দেবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তাদেরকে শিক্ষা দেবে এবং বলবে মারহাবা, মারহাবা, নিকটে এস।’ (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২০২, কানযুল ’উম্মাল- ৫/২৪৩)
আবূ সা’ঈদ আরও বর্ণনা করেন। ‘রাসূল সা. আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন তাদের (ছাত্রদের) মজলিসে বসার স্থান করে দিই, তাদের হাদীস শিখাই।’ কারণ, তোমরাই তো আমাদের পরবর্তী প্রতিনিধি, আমাদের পরবর্তী মুহাদ্দিস। তিনি তাঁর ছাত্রদের আরও বলতেনঃ তুমি কোন বিষয় না বুঝলে তা বুঝার জন্য বার বার প্রশ্ন করবে। কারণ, তুমি বুঝে আমার মজলিস থেকে উঠে যাও- এটা তোমার না বুঝে উঠে যাওয়া থেকে আমার নিকট অধিক প্রিয়। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২০৩, কানযুল ’উম্মাল- ৫/২৪৩)
তিনি ছাত্রদের হাদীস লিখে দিতেন না। তাবরানী আবূ নাদরাহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমি আবূ সা’ঈদকে বললাম, আপনি আমাদেরকে হাদীস লিখে দিন। তিনি বললেনঃ আমরা কক্ষণও লিখে দেবনা এবং কক্ষণও হাদীসকে কুরআন বানাবো না। তোমরা বরং আমাদের নিকট থেকে এমনভাবে গ্রহণ কর যেমন আমরা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে গ্রহণ করেছি। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২১৭)
হানজালা ইবন আবী সুফইয়ান আল-জুমাহী তাঁর শায়খদের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন! আবূ সা’ঈদ আল-খুদারী অপেক্ষা রাসূলুল্লাহর সা. ঘটনাবলীর অধিকতর সমঝদার ব্যক্তি আর কেউ নেই। (তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ২/২৩৭)
অত্যন্ত সত্যভাষী ছিলেন তিনি। বলতেনঃ আমি রাসূলকে সা. সত্য ভাষণের প্রতি জোর তাকীদ দিতে শুনেছি। হায়, যদি তা না শুনতাম! (মুসনাদ- ৩/৫) একবার সত্য ভাষণের হাদীসটির আলোচনা উঠলে তিনি কেঁদে ফেলেন। তারপর বলেনঃ হাদীসটি তো অবশ্যই শুনেছি; কিন্তু তার ওপর ’আমল মোটেও হচ্ছেনা। (মুসনাদ- ৩/৬১, ৭১)
হযরত আমীর মু’য়াবিয়ার রা. শাসনকালে অনেক বিদ’য়াতের প্রচলন হতে থাকে। তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মু’য়াবিয়ার রা. কাছে যান এবং এক এক করে সকল বিদ’য়াতের কথা তাঁর কর্ণগোচর করেন। (মুসনাদ- ৩/৮৪) একবার আমীর মু’য়াবিয়ার সাথে তাঁর আনসারদের সম্পর্কে কথা হয়। তিনি বলেন, রাসূল সা. আমাদের কষ্টে ধৈর্য ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। তখন আমীর মু’য়াবিয়া বললেনঃ তাহলে তোমরা ধৈর্য ধর। (মুসনাদ- ৩/৮৯)
একবার উমাইয়্যা খলীফা মারওয়ানের দরবারে বসে সাহাবীদের ফজীলাত ও মর্যাদা সম্পর্কে তাঁকে রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস শোনালেন। মারওয়ান বিশ্বাস করতে চাইলেন না। উক্ত বৈঠকে হযরত যায়িদ ইবন সাবিত ও রাফে ’ইবন খাদীজও উপস্থিত ছিলেন। আবূ সা’ঈদ প্রথমে তাদের দুইজনকে স্বাক্ষী মানলেন। তারপর বললেনঃ তাঁরাই বা কেন বলবে? একজনের তো সাদাকার দায়িত্ব থেকে অপসারণের ভয় আছে, আর অন্যজনের আপনার একটু ইশারাতেই গোত্রের নেতৃত্ব চলে যাওয়ার ভয়। এমন স্পষ্ট কথা শুনে মারওয়ান তাঁকে কোড়া দিয়ে মারার জন্য উদ্যত হয়। তখন ঐ ব্যক্তিদ্বয় তাঁর কথার সত্যতা স্বীকার করেন। (মুসনাদ- ৩/২৩)
এমনিভাবে এক ’ঈদের দিনে মারওয়ান মিম্বার বের করেন এবং নামাযের পূর্বে খুতবা দেন। এক ব্যক্তি উঠে প্রতিবাদ করে বলে, এ দু’টি কাজই সুন্নাতের পরিপন্থী বিদ’য়াত। মারওয়ান বললেনঃ পূর্বের পদ্ধতি পরিত্যক্ত হয়েছে। সেখানে আবূ সা’ঈদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, যা কিছুই হোক না কেন, লোকটি তার দায়িত্ব পালন করেছে। আমি হযরত রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ যদি কোন ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ করতে দেখে তাহলে তার উচিত শক্তি প্রয়োগে তা প্রতিরোধ করা। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে উচিত মুখে প্রতিবাদ করা, আর তাও সম্ভব না হলে কমপক্ষে অন্তরে তা ঘৃণা করা উচিত। (মুসনাদ- ৩/১০)
আমর বিল মারূফের (সৎকাজের আদেশ) আবেগ এত তীব্র ছিল যে, একবার মারওয়ান হযরত আবূ হুরাইরার রা. সাথে বসে ছিলেন। এমন সময় তাঁদের সামনে দিয়ে একটি লাশ অতিক্রম করলো। এই লাশের সাথে আবূ সা’ঈদও ছিলেন। মারওয়ান লাশ দেখেও উঠলেন না। তখন আবূ সা’ঈদ তাঁকে বললেনঃ আমীর, জানাযার জন্যে ওঠো। কারণ, রাসূল সা. উঠতেন। একথা শুনে মারওয়ান দাঁড়িয়ে যান। (মুসনাদ- ৩/৪৭, ৯৭) ইবন সা’দের মতে এই জানাযাটি ছিল উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসার রা.। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪২৮)
হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইর যখন মদীনার গভর্ণর তখন একবার ’ঈদুল ফিতরের দিন জিজ্ঞেস করলেন, নামায এবং খুতবার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর সা. কর্মপন্থা কি ছিল? আবূ সা’ঈদ বললেনঃ রাসূল সা. খুতবার আগে নামায পড়াতেন। মুস’য়াব তাঁর কথামত কাজ করেন। (মুসনাদ- ৩/৪)
একবার শাহর ইবন হাওশাব ‘তূর’ পাহাড় ভ্রমণের ইচ্ছা করেন। তিনি আবূ সা’ঈদের সাথে দেখা করতে আসেন। আবূ সা’ঈদ তাঁকে বলেন, তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন পবিত্র ভূমির প্রতি সফর নিষেধ করা হয়েছে।
ইবন আবী সা’সার জঙ্গল খুব পছন্দ ছিল্ আবূ সা’ঈদ তাঁকে বললেনঃ তুমি সেখানে এমন জোরে আযান দেবে যেন গোটা জঙ্গলে তাকবীরের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। (মুসনাদ- ৩/৯৫, ৪/৯৩)
তাঁর বোন কোন কিছু পানাহার ছাড়াই ধারাবাহিকভাবে সাওম পালন করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. এ ধরণের সাওম পালনে নিষেধ করতেন। আবূ সা’ঈদও সব সময় তাঁকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন।
তিনি ছিলেন পরিপূর্ণভাবে রাসূলুল্লাহর সা. সুন্নাতের অনুসারী। হযরত আবূ হুরাইরাহ এক মসজিদে নামায পড়াতেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন বা কোন কারণে আসতে পারলেন না। তাঁর পরিবর্তে আবূ সা’ঈদ নামায পড়ালেন। তাঁর নামাযের পদ্ধতির সাথে লোকেরা কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলো। তিনি মিম্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, আমি যেভাবে রাসূলুল্লাহকে সা. নামায আদায় করতে দেখেছি ঠিক সেইভাবে পড়িয়েছি। এখন তোমরা আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করলে তাতে আমার কিছু যায় আসেনা।
তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল। একবার তাঁর পায়ে ব্যথা হলো। তিনি পায়ের ওপর পা রেখে শুয়ে ছিলেন। তাঁর ভাই এসে হঠাৎ সেই পায়ে হাত দিয়ে একটি থাবা মারেন। তাতে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। তিনি অত্যন্ত নরমভাবে বললেন, আমাকে ব্যথা দিলে? তুমি তো জানতে আমার পায়ে ব্যথা। ভাই বললেনঃ হাঁ, জানতাম। তবে এভাবে শুতে রাসূল সা. নিষেধ করেছেন।
সরলতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একবার একটি জানাযার নামাযের জন্য তাঁকে ডাকা হয়। সবার শেষে একটু দেরীতে তিনি পৌঁছলেন। লোকেরা তাঁর অপেক্ষায় বসে ছিল। তাঁকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য স্থান খালি করে দেয়। তিনি বললেনঃ এ উচিত নয়। মানুষের উচিত ফাঁকা জায়গায় বসা। একথা বলে তিনি একটি ফাঁকা স্থানে বসে পড়েন।
আবূ সালামা নামে তার এক ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন তাবে’ঈ। তাঁর সাথে ছিল চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একবার আবূ সালামা তাঁকে ডাক দিলেন। তিনি গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। আবূ সালামা বললেন, একটু বাগিচা পর্যন্ত চলুন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। তিনি আবূ সালামার সাথে চললেন।
তিনি ইয়াতীমদের প্রতিপালন করতেন। লায়স ও সুলায়মান ইবন ’আমর তাঁরই পালিত। তিনি হাতে একটি ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন। হালকা-পাতলা ছড়ি তাঁর পছন্দ ছিল। খেজুরের ডাল সোজা করে তিনি ছড়ি বানাতেন। এক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. অনুসারী। (মুসনাদ- ৩/৬৫)
আনাস বলেনঃ আনসারদের ২০ জন যুবক সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহর সা. সেবায় নিয়োজিত থাকতো। যে কোন প্রয়োজনে রাসূল সা. তাদের কাউকে পাঠাতেন। আবদুর রহমান ইবন ’আউফ বলেন, চার অথবা পাঁচজন সাহাবী তো কক্ষণও রাসূলুল্লাহর সা. বাড়ীর দরযা থেকে উঠতো না। আবূ সা’ঈদ বলেন, আমরা পালাক্রমে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে থাকতাম। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৮৭)
একবার এক ওয়ালিমার অনুষ্ঠানে তাঁকে দা’ওয়াত করা হয়। তিনি উপস্থিত হয়ে দেখেন, নানা পদের খাবার প্রস্তুত। বাড়ীর লোকদের বললেন, তোমরা কি জাননা, রাসূল সা. যে দিন দুপুরে খেতেন সে দিন রাতে উপোস যেতেন এবং সকালে নাস্তা করলে দুপুরে খেতেন না? (হায়াতুস সাহাবা- ২/৩০৮)
সিফ্ফীন যুদ্ধে হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’আমর ইবনুল ’আস পিতা ’আমর ইবনুল ’আসের সাথে হযরত ’আলীর রা. বিরুদ্ধে রনাঙ্গনে যান। এ কারণে হযরত হাসান ইবন ’আলী বহুদিন যাবত তাঁর সাথে কথা বলা বন্ধ রাখেন। হযরত আবূ সা’ঈদ রা. এ কথা জানতে ’আবদুল্লাহকে সংগে নিয়ে হাসানের নিকট যান এবং তাঁদের দু’জনের মনোমালিন্য দূর করে সম্প্রীতি ও সৌহার্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৪৩৪)
– মুহাম্মাদ আবদুল মা‘বুদ



ফটো গ্যালারী

1/6
ওহুদ যুদ্ধ - হযরত মহাম্মদ (সা:) এর বিপ্লবী জীবন
2/6
মুসলিম নারীর বিধান
3/6
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা
4 / 6
ইসলামীক জিজ্ঞাসাঃ লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
5/6
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
6/6
উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব

Islam-icon Profile.png