LIVE
Loading latest headlines...

শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

সহীহ দলীলের ভিত্তিতে রমযানের ফাযায়েল ও রোযার মাসায়েল

শনিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে


মুসলিমদের জন্য রমযান অত্যন্ত গুরুত্তপুর্ন মাস। এতে একজন মুসলিম রমযান মাসকে কিভাবে ফলপ্রসূ করবে তার মাসআলা-মাসায়েল ও ফাযায়েল সংক্রান্ত যে সকল বিষয়াদির প্রয়োজন অনুভব করে সেগুলো খুব সুন্দরভাবে বইটিতে আলোচিত হয়েছে। রোযা ও রমযানের মত একটি মহান উৎদ্দীপনা তথা আনন্দমুখর মৌসুমকে ঘিরে যে সকল জানা ও মানার কথা এখানে পরিবেশিত হয়েছে তা আশা করি সকল মুসলিম ভাই বোনদের জানা প্রয়োজন। সহীহ দলীলকে ভিত্তি করে রমযানের ফাযায়েল ও রোযার মাসায়েল জানার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই বইটি লিখেছেন আব্দুল হামীদ ফাইযী আল-মাদানী এবং প্রকাশনায় তাওহীদ প্রকাশনী।

এখানে শুধুমাত্র রমযানের মাসায়েল সম্পর্কেই আলোচনা হয়নি রমযান মাস আমাদের জীবনে কেন এত গুরুত্তপুর্ন তারও বর্ননা রয়েছে। এখানে আলোচিত হয়েছেঃ
• সিয়ামের ফযীলত।
• সিয়ামের প্রকারভেদ।
• রমযান মাসের বৈশিষ্ঠ্য ও রোযার ফযিলত।
• রমযানের রোযার মানুষের শ্রেণীভেদ।

• খাদ্যদানের নিয়ম।
• মুসাফিরের জন্য রোযা রাখা ভালো নাকি কাযা করা ভালো?
• নিফাস ও ঋতুমতী।
• সেহেরি খাওয়া।
• ইফতার।
• রোযা অবস্থায় যা বৈধ
• রোযাদারদের জন্য যা অপছন্দনীয়।
• যাতে রোযা নষ্ট ও বাতিল হয়।
• রমযানে যে যে কাজ রোযাদারের কর্তব্য।
• ঈদ ও তার বিভিন্ন আহকাম।

• রমযানের পরে কি?
• রমযানের রোযা কাযা করার বিবরন।
• তারাবীহর সালাত বা কিয়ামে রামাযান
• সাদকাহ বা দান করা
• ইফতার করানো
• কুরআন তিলাওয়াত
• উমরাহ
• শেষ দশকের আমল ও ইবাদত
• ইত্তেকাফ
• শাবে ক্বাদর অন্বেষণ করা
• ফিতরার বিবরণ
• ঈদ ও ঈদের বিভিন্ন আহকাম
• ঈদের আদব
• ঈদ সংক্রান্ত আরও কিছু মাসায়েল
• রমযানের রোযা কাযা করার বিবরণ
• নফল রোযার প্রকারভেদ
• যে দিন গুলতে রোযা রাখা নিষিদ্ধ।
আরো অনেক বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।



আবু জেহেল (বদর যুদ্ধের পটভূমি)

শনিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে

 মদিনার ইহুদিরা কিন্তু মুহম্মদের শরীয়ত অপেক্ষা আনুষঙ্গিক অনিষ্টসহ পৌত্তলিকতা পছন্দ করেছিল। তারা মুহম্মদকে গালাগালি করত; তাকে দেখে মুখ ভেঙ্গচাত, কোরআনের শব্দাবলীর বিকৃত উচ্চারণ করত, এভাবে সেই সবকে অর্থহীন, অবান্তর বা অপবিত্র বলে প্রতিপন্ন করত। তাদের অনেকে মুসলিম মহিলাদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিদ্রুপাত্মক কবিতা রচনা করে আরবদের মর্যাদাবোধ ও স্বীকৃত বিধানকে পদদলিত করত। এসব করেও তারা ক্ষান্ত হল না। তারা রাষ্ট্রের শত্রুদের কাছে গোপনে দূত প্রেরণ করল, যে রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে তারা ওয়াদাবদ্ধ ছিল।

কুরাইশরা মুহম্মদকে হত্যা করার জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। তারা মুসলমানদের প্রকৃত জনশক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দল ও ইহুদিদের ধন্যবাদ দিল। তারা এ কথা জানত যে ইহুদিরা মুহম্মদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সাময়িক উপকারের বাসনা থেকে এবং যে মুহুর্তে তারা মদিনার নিকটবর্তী হবে তারা তাদের দলে যোগদান করবে।

ইসলামের তীব্রতম পরীক্ষার সময় উপস্থিত হল। মুহম্মদ নগরের সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে, বিশ্বাসীদের সুগঠিত করতে না করতে ভীষণ আঘাত তার উপরে নেমে এল।

প্রত্যেক মুহুর্তেই বিরাট কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক মদিনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় মুসলমানরা বিচলিত ছিলেন। হিজরতের ন্যূনাধিক এক বৎসর পরে, কুর্জ ইবনে জাবের নামক মক্কার একজন প্রধান, বহু সৈন্য নিয়ে মদিনার প্রান্তরস্থ কৃষিক্ষেতগুলির উপর আক্রমণ করে মুসলমানদের পশুগুলি ধরে নিয়ে গেল। এই সংবাদে মুহম্মদ কতিপয় মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পশ্চাৎধাবন করলেন। কিন্তু আততায়ীর দল ততক্ষণে বহুদূরে চলে গিয়েছিল, সুতরাং এ অভিযান ব্যর্থ হল। কুর্জের এই ঘটনার পর কুরাইশদের আক্রমণ আশঙ্কা শতগুনে বর্ধিত হল এবং মুসলমানরা তাদের গতিবিধির সংবাদ অবগত হবার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল।

এই ঘটনার পাঁচ মাস পরে, মুহম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে জহসের নেতৃত্বাধীনে একটি গুপ্তচরদল গঠন করে মক্কার পথে পাঠালেন। এই দলে চারটি উট ও আটজন মুসলমান ছিলেন। মুহম্মদ দলপতি আব্দুল্লাহকে একখানা পত্র দিয়ে বলে দিলেন, ‘দু‘দিনের পথ অতিক্রমের পর এই পত্র খুলে দেখবে এবং তার মর্মানুসারে কর্তব্য পালন করবে। তবে, সেই কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে কাউকেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য কোরও না।’

আব্দুল্লাহ পত্র নিয়ে চলে গেলেন এবং দু‘দিন পরে তা খুলে দেখলেন, তাতে লেখা আছে-‘...মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখালায় যাবে এবং গোপনে কুরাইশদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে তাদের সংবাদ জানাতে থাকবে।’

পত্র পাঠের পর আব্দুল্লাহ সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,  ‘..যার ইচ্ছে হয় দেশে ফিরে যাও, আর শহীদের মৃত্যু যার অভিপ্রেত সে আমার সঙ্গে আসুক।’
তখন আব্দুল্লাহর সহচররাও তার সাথে আনন্দ উৎফুল্লতার সাথে নাখালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তারা বাহরাইন নামক স্থানে পৌঁছে বিশ্রামের জন্যে থামলেন। এসময় সা‘দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও ওৎবার উট এখানে এসে হারিয়ে গেল। এতে তারা উটের সন্ধান করতে প্রবৃত্ত হলে আব্দুল্লাহ অবশিষ্ট ৬ জনকে নিয়ে অগ্রসর হলেন।

নাখালায় উপনীত হবার পর কুরাইশদের একটি ক্ষুদ্র বণিকদলের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হল। আমর ইবনে হাজরামী, হাকাম ইবনে কাইছান, ওসমান ইবনে আব্দুল্লাহ এ কুরাইশদলের সাথে ছিলেন। এসময় ওয়াকেদ ইবনে আব্দুল্লাহ শর নিক্ষেপ করলে হাজরামী নিহত হলেন। মুসলমানরা অবশিষ্ট দু‘জনকে বন্দী করে কাফেলার সমস্ত বাণিজ্য সম্ভারসহ মদিনায় নিয়ে এলেন।

মদিনায় উপস্থিতির পর, কাফেলার এই কার্যকলাপের বিষয় অবগত হয়ে মুহম্মদ যারপর নাই অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি আব্দুল্লাহকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘আমি তো তোমাদেরকে যুদ্ধ বা লুন্ঠন করতে প্রেরণ করিনি, তবে তোমরা এই অন্যায় আচরণ কেন করলে?’
মুহম্মদের ভর্ৎসনায় আব্দুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের অনুতাপের অবধি রইল না। তাদের মনে হতে লাগল যে, এই পাপের জন্যে তারা নিশ্চয় ধ্বংস হয়ে যাবেন।

এই ঘটনার পর মক্কাবাসীরা দূত পাঠিয়ে বন্দীদের মুক্তি প্রার্থনা করল। কিন্তু দলের যে দু‘জন উটের সন্ধানে ছিলেন তারা তখনও ফেরেননি, কাজেই আশঙ্কা হল কুরাইশরা সম্ভবতঃ তাদেরকে বন্দী বা হত্যা করে থাকবে। সুতরাং মুহম্মদ কুরাইশ দূতকে তার এ আশঙ্কার কথা জ্ঞাপন করে ঐ লোকদের ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। অতঃপর তারা ফিরে এলে বন্দীরা মুক্তি পেলেন। কিন্তু ওসমান মুক্তিলাভ করে ফিরে গেলেও হাকাম ইসলাম গ্রহণ করে মদিনাতেই রয়ে গেলেন।কিছুদিন পর বিরমাউনায় এই হাকাম নিহত হয়েছিলেন।

কুরাইশদের প্রধান দলপতি আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল ও তাদের সহচরবর্গ উত্তমরূপে বুঝতে পেরেছিলেন যে, মদিনায় গমনের পর মুসলমানরা অধিক শক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। আর কিছুকাল অপেক্ষা করলে তারা অজেয় হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে মুসলমানদের সাথে সত্ত্বর যুদ্ধে লিপ্ত হবার জন্যে তারা উন্মূখ হয়েই ছিলেন।

এসময় কাফেলাকে আক্রমণ ও বন্দীদের মদিনায় নীত হবার সংবাদে তারা মদিনা আক্রমণের জন্যে দৃঢ়সংকল্প হলেন। এই আক্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ান এক সহস্র উটের বাণিজ্য সম্ভারের এক কাফেলা নিয়ে শ্যাম দেশে গমণ করলেন। অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদাদি- রণসম্ভার খরিদ করার ও বেতনভোগী সৈন্যদল সংগ্রহের জন্যে মক্কাবাসীরা ৫০ হাজার দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা (দিনার হল স্বর্ণমুদ্রা যার ওজন সাড়ে চার মাশা) আবু সুফিয়ানের সাথে প্রেরণ করেছিল। এমনকি কুরাইশ নরনারীদের মধ্যে এক রতি- মাশা সোনা-চাঁদিও যার কাছে ছিল, সেও তা এই কাফেলার সাথে প্রেরণ করেছিল নিজের অংশ হিসেবে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাযিল হল-‘অবিশ্বাসীরা মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথ হতে প্রতিনিবৃত করার জন্যে নিজেদের ধন-সম্পদসমূহ ব্যয় করতে যাচ্ছে, দেখ শীঘ্রই তারা তা (ইসলাম ধর্মে বিঘ্নদানের জন্যে) ব্যয় করে ফেলবে- তখন এ তাদের পক্ষে অনুতাপেরই কারণ হবে, তদন্তর তারা পরাজিত হয়ে যাবে।’(৮:৩৬)

এই আয়াত নাযিল হবার পর আবু সুফিয়ানের কাফেলা আক্রমণের জন্যে মুহম্মদ সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। মক্কায় মুসলমানদের উপর কুরাইশদের নির্যাতন যখন চরমসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল, যখন এমন কোন দিন যেত না, যেদিন কোন না কোন মুসলমান তাদের নিষ্ঠুর হাতে প্রহৃত ও আহত হয়ে না আসতেন, তখন মুসলমানরা তাদের উপর জুলুম ও অত্যাচার দেখে মুহম্মদের কাছে তাদের মেকাবেলায় যুদ্ধ করার অনুমতি চাইতেন। কিন্তু যদিও মক্কায় অবস্থানের শেষ দিনগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবুও মুহম্মদ তাদেরকে নিবৃত্ত করতেন এই বলে- ‘সবর কর। কেননা আমাকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়নি।’

আর এখন- যখন যুদ্ধের অনুমতি পাওয়া গেল, তখন রমজান মাস, যুদ্ধের কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেই দেখে কেউ কেউ সাহস প্রদর্শণ করলেও অধিকাংশ দোদুল্যমানতা প্রকাশ করলেন। অথচ জেহাদ ও যুদ্ধের এই আদেশ নতুন নয়। পূর্ববর্তী উম্মত ও পয়গম্বরদেরকেও অবিশ্বাসীদের মোকাবেলায় যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এরূপ করা না হলে কোন মাযহাব ও ধর্মের অস্তিত্ব থাকত না এবং উপাসনালয়সমূহ বিধস্ত হয়ে যেত।

এসময় মুসলমানদের উৎসাহিত করতে জেহাদের অনুমতি বাচক এই আয়াত নাযিল হল-‘যাদের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদের অনুমতি প্রদান করা হল- কারণ তারা অত্যাচারিত। সেই সমস্ত লোক যারা স্বদেশ হতে অন্যায়রূপে বহিস্কৃত হয়েছে- তবে তারা এ মাত্র বলেছিল যে, আল্লাহই আমাদের প্রভু। আল্লাহ যদি মানব সমাজের কতিপয় লোকের দ্বারা অন্য লোকদেরকে অপসৃত না করতেন, তা হলে মন্দির, গির্জা, উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ- যাতে বহুলরূপে আল্লাহর নাম করা হয়ে থাকে-বিধ্বস্ত করে ফেলা হত।’(২২:৩৯-৪০)

আর তারা যদি চুক্তির পর তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ও তোমাদের ধর্ম সম্পর্কে বিদ্রুপ করে, তবে অবিশ্বাসী প্রধানদের সাথে যুদ্ধ করবে। এরা এমন লোক যাদের প্রতিশ্রশ্রুতি প্রতিশ্রুতিই নয়। তোমরা কি সে সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না, যারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং রসূলকে তাড়িয়ে দেবার সংকল্প করেছে? ওরাই প্রথম তোমাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে। তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? বিশ্বাসী হলে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর- এ-ই আল্লাহর কাছে শোভনীয়। তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর। তোমাদের হাতে আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দেবেন, ওদেরকে অপদস্ত করবেন, ওদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে জয়ী করবেন ও বিশ্বাসীদের চিত্ত প্রশান্ত করবেন।(৯:১২-১৪)

উপরের আয়াতসমূহ নাযিল হবার পরেও মুহম্মদ জেহাদে অংশগ্রহণ করাকে অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক করলেন না। তিনি শুধু ঘোষণা করলেন, ‘যাদের কাছে এই মূহুর্তে সওয়ারীর ব্যবস্থা আছে শুধুমাত্র তারাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।’
ফলে যুদ্ধে যাবার জন্যে অল্পসংখ্যকই তৈরী হয়েছিলেন। অধিকাংশই বিরত রইলেন এ কারণে যে, মুহম্মদ তো যুদ্ধে যাত্রা অপরিহার্য করেননি। আর তাদের মনে হয়েছিল যে, বাণিজ্যিক কাফেলার জন্যে খুব বেশী যোদ্ধার প্রয়োজন পড়বে না।

এই যুদ্ধ যাত্রায় কোন স্ত্রীলোক অংশ নেয়নি। যাত্রার সময় নওফেলের কন্যা উম্মে ওয়ার্কা মুহম্মদের কাছে উপস্থিত হয়ে শুশ্রুষাকারিনীরূপে সেনাদলের সাথে যাবার অনুমতি চেয়েছিল। তিনি তাকে ক্ষান্ত করে বললেন, ‘নিজ বাটিতে অবস্থান কর।’

মুহম্মদ এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন। দলে উট ছিল ৭০টি অর্থাৎ প্রতি তিন জনের জন্যে একটি। ফলে তার বাহন উটেরও অপর দু‘জন অংশীদার ছিলেন। তারা হলেন আলী ও আবু লুবাবাহ। যখন মুহম্মদের হেঁটে চলার পালা এল, তখন তারা বললেন, ‘হে রসুলুল্লাহ! আপনি উপরেই থাকুন, আপনার পরিবর্তে আমরা হেঁটে চলব।’
তিনি বললেন, ‘না, আমরা পালাক্রমেই আরোহণ করব।’

বি‘রে সুকইয়া নামক স্থানে পৌঁছে মুহম্মদ কায়েস ইবনে সা‘দকে সৈন্য গণনার নির্দেশ দিলেন। কায়েস জানালেন, ‘মোট তিন‘শ তেরজন সৈন্য রয়েছে।’
তিনি খুশী হয়ে বললেন, ‘তালুতের সৈন্য সংখ্যাও ছিল এই। সুতরাং লক্ষণ শুভ।’

এদিকে সিরিয়ার আইনে যোরকা নামক স্থানে একব্যক্তি আবু সুফিয়ানকে সংবাদ দিল- ‘মুসলমানরা আপনার এই কাফেলাকে আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করছে।’

আবু সুফিয়ান এই সংবাদে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তিনি হিজাজের নিকটবর্তী হলে জনৈক দমদম ইবনে ওমেরকে কুড়ি মেশকাল সোনা দিয়ে এ ব্যাপারে রাজী করালেন যে, সে দ্রুত মক্কায় পৌঁছে কুরাইশদের সংবাদ দেবে যে, তার কাফেলা মুসলমানদের আক্রমণ আশঙ্কার সম্মুখীণ হয়েছে।

দমদম দ্রুতগামী একটি উটে রওনা হয়ে গেল। অতঃপর মক্কার নিকটবর্তী হয়ে ঘোর বিপদের চিহ্নস্বরূপ সে তার উটের নাক কান কেটে এবং নিজের পরিধেয় ছিঁড়ে হাওদাটি উটের পিঠে উল্টোভাবে বসিয়ে নগরীতে প্রবেশ করল। গোটা মক্কায় হৈঁ চৈঁ পড়ে গেল। এমনিতেই মুহম্মদ হিযরত করে মদিনায় চলে এলেও মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তি লক্ষ্য করে তাদের মনে শত্রুতার এক দাবাদাহ জ্বলেই যাচ্ছিল। এখন তারা মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার জন্যে উৎগ্রীব হয়ে উঠল।

আবু জেহেল, ওৎবা, শায়বা প্রমুখ মক্কার বারজন সর্দার যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয়ভার নিজেদের কাঁধে নিলেন। সাঁজ সাঁজ রবে সকলে প্রতিরোধের জন্যে তৈরী হয়ে গেল। যারা যুদ্ধে যেতে অপারগ হল তারা অন্য একজনকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করে দিল। আর নেতারা বিশেষভাবে তাদেরকে যুদ্ধে যাত্রা বাধ্যতামূলক করলেন, যারা মুসলমানদের সমর্থক বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন মুহম্মদের পিতৃব্য আব্বাস, আবু তালিবের পুত্র আকীল, আবু বকরের পুত্র আব্দুর রহমান, মুহম্মদের জামাতা আ’স ইত্যাদি অনেকে।

মদিনার ইহুদিরা বিশেষ করে বনি নাজির ও বনি কুরাইজা গোত্র যারা মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল, কুরাইশদের গোপনে যুদ্ধের সাঁজ-সরঞ্জাম, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সাহায্য করল। তাদের সাহায্য পেয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কুরাইশরা সকল প্রস্তুতি সেরে ফেলল। অতঃপর আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য, যাদের মধ্যে দু‘শ ঘোড়সওয়ার, ও সাত‘শ উষ্ট্রারোহী বর্মধারী এবং সারা গায়িকার বাঁদ্যদল মদিনার দিকে যাত্রা করল। যাত্রার প্রাক্কালে বাহিনী প্রধান আবু জেহেল কা‘বার পর্দা ধরে এই প্রার্থণা করলেন- ‘হে আল্লাহ! উভয় বাহিনীর মধ্যে যেটি উত্তম ও উচ্চতর এবং অধিক হেদায়েতের উপর রয়েছে তাকে বিজয় দান কোরও।’

এই নির্বোধেরা ভেবেছিলেন তারাই উত্তম এবং অধিক হেদায়েতের উপর রয়েছেন। তাই তাদের প্রার্থণার জবাবে এই আয়াত নাযিল হয়েছিল-তোমরা যদি মিমাংসা কামনা কর, তাহলে তোমাদের কাছে মিমাংসা পৌঁছে গেছে। আর যদি তোমরা প্রত্যাবর্তণ কর, তবে তা তোমাদের জন্যে উত্তম এবং তোমরা যদি তাই কর, তবে আমিও তেমনি করব। বস্তুতঃ তোমাদের কোনই কাজে আসবে না তোমাদের দল-বল, তা যত বেশীই হোক। জেনে রেখ আল্লাহ রয়েছেন ঈমানদারদের সাথে।(৮:১৯)

কুরাইশ বাহিনী যখন মুসলমানদের মোকাবেলার জন্যে যখন গর্বিতভাবে রওনা হচ্ছিল, তখন তাদের মনে হঠাৎ এক আশঙ্কা চেপে বসল। তাদের প্রতিবেশী বনি বকর ছিল তাদের শত্রু। তারা যুদ্ধ করতে চলে গেলে, সেই সুযোগে এই শত্রুরা না আবার তাদের বাড়ী-ঘর এবং নারী-শিশুদের উপর হামলা করে বসে। তারা রওনা হল বটে, কিন্তু এ আশঙ্কা তাদের পায়ে বেড়ী হয়ে রইল।

কুরাইশ বাহিনীর সাথে পথে বনি বকর গোত্রের একজন অন্যতম প্রধান সর্দার সোরাকা ইবনে মালেকের সঙ্গে দেখা হল। সোরাকার হাতে ছিল গোত্রের পতাকা এবং সঙ্গে ছিল সৈনিকদের একটি খন্ড দল। সে এগিয়ে এসে কুরাইশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দিয়ে বসল। সে বলল, ‘তোমাদের শক্তি-সামর্থ ও সংখ্যাধিখ্য তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং আজকের দিনে এমন কেউ নেই যারা তোমাদের উপর জয়লাভ করতে পারবে। আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা নিঃশ্চিন্তে এগিয়ে চল।’
বীরদর্পে কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে সোরাকার বাহিনীও এগিয়ে চলল মদিনার পথে।

এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতসমূহ- যারা বেরিয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোক দেখাবার উদ্দেশ্যে। আর আল্লাহর পথে তারা বাঁধা দান করত। বস্তুতঃ আল্লাহর আয়ত্ত্বে রয়েছে সেসমস্ত বিষয় যা তারা করে।(৮:৪৭)
আর যখন সুদৃশ করে দিল শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপকে এবং বলল যে, আজকের দিনে কোন মানুষই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না, আর আমি হলাম তোমাদের সমর্থক।(৮:৪৮)

এদিকে মুহম্মদ বদরের কাছে পৌঁছে জানতে পারলেন একহাজার সুসজ্জিত সেনাদল আবু জেহেলের নেতৃত্বে মুসলমানদেরকে মোকাবেলার জন্যে মদিনার দিকে এগিয়ে এসেছে। মুসলমানরা মদিনা হতে বহির্গমনের পর এখন উভয় অর্থাৎ আবু সুফিয়ানের ও কুরাইশদের অভিযানের খবর যুগপৎভাবে অবগত হলেন। মুসলমানরা জানতেন এই দু‘দলের মধ্যে একটির উপর তারা জয়লাভ করবেন। তাই এ সময়ে একদল মুসলমান আবু জেহেলের বাহিনী মোকাবেলার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, কিন্তু আর একদল এই দু‘দলের মধ্যে আবু সুফিয়ানের কাফেলাটি নিস্কন্টক ছিল বলে, সেটিকে আক্রমণ করার জন্যে উৎসুক হলেন। কেননা তারা বিশেষরূপে ভীত ও কুন্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করছিলেন যে, আবু জেহেলের বাহিনী মোকাবেলা অত্যন্ত দূরূহ বরং অসাধ্য ব্যাপার। আর এইদল মদিনা থেকে নির্গমনের সময়ও যুদ্ধ করার বিষয়ে মুহম্মদের সাথে যথেষ্ট বাক-বিতন্ডা করেছিলেন।

আবু সুফিয়ানের কাফেলা ও আবু জেহেলের এই অভিযান এবং মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোরআন জানায়- হে মুহম্মদ! তোমার প্রভু তোমাকে ন্যায্যরূপে স্বগৃহ হতে বহির্গত করলেন, অথচ এ বহির্গমণের সময় একদল মুসলমান (যেতে) বিশেষ কুন্ঠিত হচ্ছিল। সত্য স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হবার পরেও তারা তোমার সাথে বিতন্ডা করছিল। যেন তাদেরকে মৃত্যুর পানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আর সেই মৃত্যুকে যেন তারা প্রত্যক্ষ করছিল এবং যখন দু‘দলের মধ্যে একটি সম্বন্ধে আল্লাহ তোমাদেরকে এ ওয়াদা দিচ্ছিলেন যে, তোমরা সেইটির উপর জয়যুক্ত হতে পারবে: কিন্তু তোমাদের বাসনা ছিল যে (দল দু‘টির মধ্যে) যেটি নিস্কন্টক, সেইটির উপর তোমরা অধিকার লাভ কর- অথচ আল্লাহ স্বীয় বাণী দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার এবং ধর্মদ্রোহীদের মূলোচ্ছেদ করার সঙ্কল্প করেছিলেন।’(৮:৫-৭)

বদর অভিযান, রুট ম্যাপ।
মুসলিম মুজাহিদরা মদিনা থেকে ষাট মাইল পূর্ব-দক্ষিণে বদর সন্নিকটে এসে জানতে পারলেন আবু সুফিয়ানের কাফেলা পূর্বেই চলে গিয়েছে এবং কুরাইশ বাহিনী বদরের প্রান্তরে এসে পৌঁছেছে। তখন মুহম্মদ সকলের সাথে পরামর্শে বসলেন।

এ সময় আনসার দলপতি সা‘দ ইবনে ওবায়দা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হযরত! কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলা করা সম্পর্কে আপনি আমাদের (আনসারদের) মতামত জানতে চাচ্ছেন? যার হস্তে আমার প্রাণ-তাঁর শপথ, আপনি আদেশ করলে আমরা সমুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করতে পারি, জগতের দুর্গমতম স্থানকে পদদলিত করতে পারি।’

আর মেকদাদ বললেন, "হে রসূলুল্লাহ! We now stand by you, whatever you ask us to do. We will not behave like the followers of Moses as who said, ‘Go you and your God and fight the enemy, we remain here behind.' If we must fight, we will and we will fight to the right of you, to the left of you, in front of you and behind you. True, the enemy wants to get at you. But we assure you that he will not do so, without stepping over our dead bodies. Prophets of God, you invite us to fight. We are prepared to do more. Not far from here is the sea. If you command us to jump into it, we will hesitate not."

কুরাইশ সৈন্যদল যুদ্ধের ময়দানে মোতায়েন হয়েছিল। ফলে যিনি জীবনে কোনদিন অস্ত্র ধরেননি, যার কাছে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তীব্র বেদনা বয়ে আনত, যিনি আরবদের পৌরুষ বিষয়ক বিধিসমূহের বিরুদ্ধে তার সন্তান বা শিষ্যদের ক্ষতিতে নিদারুণ অশ্রুবির্জন করতেন, যার চরিত্র এতই কোমল ও দয়ালু ছিল যে তার শত্রুরা তাকে স্ত্রীজনোচিত বলে ভাবত। এই মানুষটি এখন প্রয়োজনের তাগিদে যুদ্ধের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করলেন।

অতঃপর মুহম্মদ যাত্রার আহবান করলেন এবং মুসলমানরা যাত্রা শুরু করলেন এবং তারা যে বদরের উপত্যকা দিয়ে আবু জেহেল অগ্রসর হচ্ছিল সেখানে পৌঁছে গেলেন রাতের বেলায়। সকলে একস্থানে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। কেবলমাত্র মুহম্মদ একা জেগে তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করতে লাগলেন।

যোদ্ধাদের এই ঘুম ছিল আল্লাহর রহমতস্বরূপ। এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত- যখন তিনি আরোপ করেন তোমাদের উপর তন্দ্রাচ্ছন্নতা নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রশান্তির জন্যে।(৮:১১)
 
বদর যুদ্ধ।
দ্বিতীয় হিজরী, ১৭ই রমজান, শুক্রবারের ভোরবেলা। বদর প্রান্তরে ফজরের আজান ধ্বনিত হল। একটু আগে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। মুসলমানরা অযু শেষে নামাজ আদায় করলেন। রাতে ঘুম হওয়াতে তারা এখন ক্লান্তি মুক্ত। আরবদের যুদ্ধ-বিগ্রহ নিশিকালে বা ভোররাত্রে পরিচালিত হত এবং তা আকস্মিক ও হত্যামূলক লুন্ঠন পর্যায়ে সীমিত ছিল, ছিল বিচ্ছিন্ন লড়াই বা সাধারন দাঙ্গার পর্যায়ভুক্ত। মুহম্মদ তার দেশবাসীর অভ্যস্ত কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এ কারণে ফজরের নামাজ শেষেই মুজাহিদরা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।

কুরাইশরা প্রথমে বদরের প্রান্তরে পৌঁছে সুবিধাজনক উঁচুস্থানে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাদের নিকটবর্তী ছিল পানি। আর মুসলমানদের অবস্থান করতে হয়েছিল নিম্নাঞ্চলে যেখানে কোন পানি ছিল না, ছিল চলাচলে অসুবিধাজনক বালুকাময় প্রান্তর।

এই যুদ্ধের নকশা এই আয়াত বিবৃত করেছে এভাবে-আর যখন তোমরা ছিলে সমরাঙ্গনের এ প্রান্তে আর তারা ছিল সে প্রান্তে অথচ কাফেলা তোমাদের থেকে নীচে নেমে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় যদি তোমরা পারস্পরিক অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে, তবে তোমরা একসঙ্গে সে ওয়াদা পালন করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ এমন এক কাজ করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।-(৮:৪২)

বদর যুদ্ধ।
যুদ্ধের এদিনটি ছিল শীতের ঝড়ো দিন। এক প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব পূর্বেই সারা উপত্যকা দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির দরুণ পানির সমস্যার সমাধান হল এবং বালুপূর্ণ ক্ষেত্র সমতল হয়ে পড়ায় কৌশলগত দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থান এখন মুসলমানদের অনুকূলে চলে এল। অন্যদিকে বৃষ্টির ফলে কুরাইশদের উঁচু ঢালু অবস্থান কর্দমাক্ত হয়ে পড়ায় চলাচলে তারা সমস্যায় পড়ে গেল। এসবের মধ্যেই প্রভাতে সহস্রাধিক কুরাইশ সৈন্য অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জ্বিত হয়ে সাঁরিবদ্ধভাবে আগুয়ান হল।

এদিকে তুলনামূলক একটি নিরাপদ অবস্থানে মুহম্মদের জন্যে একটি ছোট সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি ও আবু বকর তার নীচে উপবিষ্ঠ হলেন। আর তাদের হেফাজতকল্পে খোলা তরবারি হাতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মু‘আজ। অতঃপর যখন মুহম্মদ ধর্মদ্রোহীদের উষ্ট্রারোহী ও অশ্ববাহিনীকে ঔদ্ধত্য সহকারে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে দেখলেন, তখন তিনি মূসার মত উর্ধ্বে হস্ত উত্তোলিত করে প্রার্থনা করলেন- ‘হে প্রভু, তোমার সাহায্যের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যেও না। প্রভু, যদি এই ক্ষুদ্র দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তবে তোমার নির্ভেজাল প্রার্থনা করার মত কেউ থাকবে না।’

এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াতসমূহ- এবং তোমাদের উপর আকাশ থেকে পানি অবতীর্ণ করেন, যাতে তোমাদেরকে পবিত্র করে দেন এবং যাতে তোমাদের থেকে অপসারিত করে দেন শয়তানের অপবিত্রতা। আর যাতে সুরক্ষিত করে দিতে পারেন তোমাদের অন্তরসমূহকে এবং তাতে যেন সুদৃঢ় করে দিতে পারেন তোমাদের পা‘গুলো।-(৮:১১)

তোমরা যখন ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করেছিলে স্বীয় পরওয়ারদেগারের কাছে, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদের মঞ্জুরি দান করলেন যে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব ধারাবাহিক ভাবে আগত হাজার ফেরেস্তার মাধ্যমে। আর আল্লাহ তো শুধু সুসংবাদ দান করলেন যাতে তোমাদের মন আশ্বস্ত হতে পারে।-(৮:৯-১০)

যখন নির্দেশ দান করেন ফেরেস্তাদেরকে তোমাদের পরওয়ারদেগার যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখ। আমি অবিশ্বাসীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাট জোড়ায় জোড়ায়। যেহেতু তারা অবাধ্য হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের, সেজন্যে এই নির্দেশ। বস্তুতঃ যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হয়, নিঃসন্দেহে আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। আপাততঃ বর্তমান এ শাস্তি তোমরা আস্বাদন করে নাও এবং জেনে রেখ যে, অবিশ্বাসীদের জন্যে রয়েছে দোযখের আযাব।-(৮:১২-১৪)

এরপর সমরনীতি সম্পর্কিত আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হল- হে ঈমানদারেরা, তোমরা যখন অবিশ্বাসীদের সাথে মুখোমুখি হবে, তখন পশ্চাৎপসারণ কোরও না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাৎপসারণ করবে, অবশ্য লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিম্বা যে নিজ সৈন্যদের কাছে আশ্রয় নিতে আসে সে ব্যতীত- অন্যরা আল্লাহর গজব সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। আর তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম।-(৮:১৫-১৬)

মুহম্মদ প্রার্থনায় নিমগ্ন এসময় কুরাইশদের পক্ষ হতে তীর বর্ষণ শুরু হল। একটি তীর মেহজা নামের একজন মুসলিম সৈন্যের বক্ষ ভেদ করে গেল। এই মেহজাই বদর যুদ্ধের প্রথম শহীদ। সকল মুসলমানই তার মৃত্যু দৃশ্য দেখলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কোন চাঞ্চল্য বা ক্রোধ প্রকাশিত হল না। কারণ মুহম্মদের হুকুম ছিল- ‘আমি আদেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ বিপক্ষকে আক্রমণ কোরও না।’--কাজেই তারা নিরব, নিস্পন্দভাবে দঁড়িয়ে রইলেন। এসময় আরেকটি তীর পানি পানরত অবস্থায় হারেছা নামীয় একজনের কন্ঠ ভেদ করে গেল। সৈন্যরা নীরবে তাও দর্শণ করলেন। এরপর মুহম্মদ সকলকে প্রস্তুত হতে আদেশ করলেন। সকলে সমঃস্বরে উত্তর করলেন, ‘প্রভু হে, আমরা সকলেই প্রস্তুত।’

মুহম্মদ যোদ্ধাদেরকে বললেন, ‘তোমাদের জন্যে কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের সাহায্যার্থে তোমাদের পালনকর্তা আসমান থেকে অবতীর্ণ তিন হাজার ফেরেস্তা পাঠাবেন। অবশ্য তোমরা যদি সবর কর এবং বিরত থাক আর তারা যদি তখনই তোমাদের উপর চড়াও হয়, তাহলে তোমাদের পালনকর্তা চিহ্নিত ঘোড়ার উপর পাঁচ হাজার ফেরেস্তা তোমাদের সাহায্যে পাঠাতে পারেন।’ 
তিনি একমুষ্ঠি মাটি তুলে নিয়ে শত্রুদের ডানে, বামে, সম্মুখে ও পশ্চাতে নিক্ষেপ করলেন।

মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা দেখে কুরাইশ বাহিনীর অনেকের মনে পরিণতি ভেবে আফসোস হতে লাগল। তারা ভাবছিল-এহেন শক্তিশালী বাহিনীর বিপক্ষে মুষ্টিমেয় এই মুসলিম বাহিনী! হায়, বেচারাদেরকে তাদের দ্বীনই প্রতারণায় ফেলে মৃত্যুর মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।’

এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত-যখন মুনাফেকরা বলতে লাগল এবং যাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্থ, এরা নিজেদের ধর্মের উপর গর্বিত।-(৮:৪৯)

কুরাইশদের তিনজন (ওৎবা, শায়বা ও অলিদ) উন্মুক্ত প্রান্তরে এগিয়ে এলেন এবং প্রথা অনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে থেকে তিনজনকে একক যুদ্ধে আহবান করলেন। তারা চিৎকার করে বললেন, ‘কে আছ আস, আমাদের তরবারীর খেলা দেখে যাও!’

এই আহবান শুনে কয়েকজন আনসার মুহম্মদের অনুমতি ব্যতিরেকেই তরবারী হাতে সেই দিকে ধাবিত হলেন। মুহম্মদের নিষেধ করার পূর্বেই ওৎবা চিৎকার করে বললেন, ‘মুহম্মদ! মদিনার এই চাষাগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করা আমাদের পক্ষে অসম্মানজনক। আমাদের যোগ্য যোদ্ধা পাঠাও।’

ওৎবাকে অগ্রসর হতে দেখে তার একপুত্র হোজায়ফা মুসলমানদের পক্ষ থেকে মোকাবেলার জন্যে ব্যাকুলতা প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু মুহম্মদ তার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে থেকে আমীর হামজা, আলী ও ওবায়দাকে মোকাবেলার জন্যে অগ্রসর হতে বললেন। তিনি এটা করলেন একারণে যাতে কেউ এ প্রশ্ন না তুলতে পারে যে, মুহম্মদ মোহাজিরদেরকে বাদ দিয়ে আনসারদেরকে প্রথমে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।

হামজার সাথে শায়বার, আলীর সাথে অলিদের ও ওবায়দার সাথে ওৎবার যুদ্ধ হল এবং মূহুর্তের মধ্যে শায়বা ও অলিদের মস্তক ভূলুন্ঠিত হল। আর বৃদ্ধ ওবায়দা ওৎবাকে নিহত করলেন বটে, কিন্তু নিজেও মারাত্মক আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। ওৎবার স্ব-বংশে নিধন প্রাপ্তির পর যুদ্ধ সাধারণ রূপ পরিগ্রহ করল।

কুরাইশদের সহায়তার জন্যে যে শয়তানী বাহিনী যুদ্ধে এসেছিল, তাদের কারণে একসময় যুদ্ধের ভাগ্যবিপর্যয় দেখা দিচ্ছিল। এসময় আল্লাহ জিব্রাইলের নেতৃত্বে এক ফেরেস্তার বাহিনী প্রেরণ করলেন। সোরাকা ইবনে মালেকরূপী ইবলিস এবং তার সাথীরা ফেরেস্তা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে তখনি তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যেতে উদ্যত হল। কাছেই ছিল কুরাইশ যুবক হারেছ ইবনে হাশেম। সে সোরাকাকে পালিয়ে যেতে দেখে বলল, ‘যুদ্ধের ময়দানে এসে এ-কি করছেন! আপনি তো বলেছিলেন, আমি তোমাদের সমর্থনে রয়েছি।’
সোরাকা বলল, ‘আমি তোমাদের সাথে কৃত চুক্তি থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছি। কারণ, আমি এমন জিনিষ দেখছি যা তোমাদের চোখ দেখতে পায় না।’

সোরাকা তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের গতি ফিরে এল। এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত-অতঃপর যখন সামনা সামনি হল উভয় বাহিনী, তখন সে অতি দ্রুত পায়ে পিছন দিকে পালিয়ে গেল এবং বলল, ‘আমি তোমাদের সাথে নেই- আমি দেখছি যা তোমরা দেখছ না।-(৮:৪৮)

মুসলমানদের তরবারির আঘাতে যেসব কুরাইশরা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পড়ছিল, ফেরেস্তারা তাদের জান কবজ করতে লাগলেন। এসময় মৃত্যুপথযাত্রীদের মনে হতে লাগল কেউ যেন আগুনের চাবুক দিয়ে তাদের মুখে ও পিঠে আঘাত করে চলেছে। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তারা মৃত্যুর কলে ঢলে পড়তে লাগল। এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত- আর যদি তুমি দেখ, যখন ফেরেস্তারা অবিশ্বাসীদের জান কবজ করে; প্রহার করে তাদের মুখে ও পশ্চাৎদেশে আর বলে, জলন্ত আযাবের স্বাদ গ্রহণ কর।-(৮:৫০)

মক্কাবাসীরা অনেক ক্ষতি সহ্যকরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেল। তাদের অনেক নেতা নিহত হলেন। আবু জেহেল তার দুর্নিবার অহংকারের শিকার হয়েছিলেন। মা‘আজ ও তার ভাই আবু জেহেলকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়েছিলেন। আবু জেহেল পুত্র ইকরামা তাদেরকে বাঁধা দিয়েছিলেন। তিনি মা‘আজের বাম বাহুতে আঘাত করে তা ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু অদম্য মা‘আজ তা উপেক্ষা করে আবু জেহেলকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

বদর যুদ্ধে (Battle of Badr) অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের পক্ষে ৬ জন মোহাজির ও ৮ জন আনসার নিহত হয়। আর কুরাইশদের পক্ষে ওৎবা, শায়বা, আবু জেহেল ও তার ভ্রাতা আছী, আবু সুফিয়ানের পুত্র হানজালাসহ প্রায় শতাধিক নিহত হয়েছিলেন।

বদর যুদ্ধে নিহতদের সমাধি।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুরাইশদের পলায়নের সংবাদ শুনে মুহম্মদ মুসলমানদের অস্ত্র ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন। তিনি যুদ্ধের পূর্বেও মুসলমানদের এই বলে সতর্ক করেছিলেন-‘কুরাইশদের মধ্যে কতকগুলি লোক অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুদ্ধে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছে। সাবধান, তাদেরকে কেউ আঘাত কোরও না।’

মুসলমানরা মুহম্মদের আদেশ মেনে নিয়ে অস্ত্র ব্যাবহার বন্ধ করে পলায়নপর শত্রুদেরকে বন্দী করতে আরম্ভ করলেন। বহু সংখ্যক কুরাইশ (৭০জন) মুসলমানদের হাতে বন্দী হল। অতঃপর এসব বন্দী ও আবু জেহেলের ছিন্ন শির মুহম্মদের কাছে আনীত হল।

যুদ্ধ শেষে মুসলমানদের অনেকে নিজেদের বীরত্বসূচক কিছু কথাবার্তা বলে ফেললেন। এ সময় এই আয়াত নাযিল হল-সুতরাং তোমরা তাদের হত্যা করনি, বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর তুমি মাটির মুষ্ঠি নিক্ষেপ করনি, যখন তা নিক্ষেপ করেছিলে, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন আল্লাহ স্বয়ং যেন ঈমানদারদের প্রতি এহসান করতে পারেন যথার্থভাবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবণকারী, পরিজ্ঞাত।-(৮:১৭)

সমাপ্ত।

NB: This is all about the battle of Badr. Now in the following link, you will find how the liars depicted this battle to impose falsehood on Islam just hiding that the caravan was not a simple caravan, it was full with arms and ammunition's to use them against Muslim (8:36)- http://www.thereligionofpeace.com/muhammad/myths-mu-badr.htm


ছবি: Wikipedia, go-makkah, bjsallahwalay, commons.wikimedia.
এই সময়ে এপ্রিল ১৯, ২০১২ কোন মন্তব্য নেই: এই পোস্টে লিঙ্ক এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!Twitter-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
লেবেলসমূহ: আবু জেহেল, বনি কুরাইজা, বনি নাজির, সারা গায়িকা, Battle of Badr
১২ মার্চ, ২০১২
Battle of Badr: যুদ্ধে ধৃত বন্দীদিগের ভাগ্য মীমাংসা।

মক্কাবাসীরা প্রভূত ক্ষতি সহ্যকরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেল। তাদের অনেক নেতা নিহত হল। আবু জেহেল তার দুর্নিবার অহংকারের শিকার হয়েছিলেন। মা‘আজ ও তার ভাই আবু জেহেলকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাবিত হলে, আবু জেহেল পুত্র ইকরামা তাদেরকে বাঁধা দিল। সে তরবারির এক আঘতে মা‘আজের বাম বাহু বিছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু অদম্য মা‘আজ তা উপেক্ষা করে আবু জেহেলের শির তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।

এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের পক্ষে ৬ জন মোহাজির ও ৮ জন আনসার নিহত হয়। আর কুরাইশদের পক্ষে ওৎবা, শায়বা, আবু জেহেল ও তার ভ্রাতা আছী, আবু সুফিয়ানের পুত্র হানজালাসহ প্রায় শতাধিক নিহত হয়েছিলেন।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুরাইশদের পলায়নের সংবাদ শুনে মুহম্মদ মুসলমানদের অস্ত্র ব্যাবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন। তিনি যুদ্ধের পূর্বেও মুসলমানদের এই বলে সতর্ক করেছিলেন-‘কুরাইশদের মধ্যে কতকগুলি লোক অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুদ্ধে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছে। সাবধান, তাদেরকে কেউ আঘাত কোরও না।’

মুসলমানরা মুহম্মদের আদেশ মেনে নিয়ে অস্ত্র ব্যাবহার বন্ধ করে পলায়নপর শত্রুদেরকে বন্দী করতে আরম্ভ করল। বহু সংখ্যক কুরাইশ (৭০জন) মুসলমানদের হাতে বন্দী হল। অতঃপর এসব বন্দী ও আবু জেহেলের ছিন্ন শির মুহম্মদের নিকট আনীত হল।

যুদ্ধবন্দীদের প্রতি আরবদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা ও ঐতিহ্যের বিপরীতে উচ্চতম মানবতার সঙ্গে আচরণ করা হল। মুহম্মদ কড়া নির্দেশ ছিল যে বন্দীদের দুর্ভাগ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শণ করতে হবে এবং তাদের প্রতি সদয় আচরণ করতে হবে। যে সব মুসলমানদের তদারকীতে এসব বন্দীরা ছিল, তারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে মুহম্মদের নির্দেশ পালন করেছিলেন। তারা তাদের আহার্য রুটি বন্দীদের খেতে দিতেন এবং নিজেরা শুধু শুকনো খেজুর আহার করে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেন। পরবর্তীকালে একজন বন্দী (আবু আজিজ) তাদের প্রতি আচরণ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মদিনার লোকদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তারা আমাদের অশ্বপৃষ্ঠে যেতে দিতেন এবং নিজেরা হেঁটে যেতেন। তারা আমাদেরকে রুটি খেতে দিতেন, নিজেদের জন্যে রুটি অবশিষ্ট থাকত না, ফলে তারা খেজুর ভক্ষণ করে ক্ষুধা মেটাতেন এবং তাতেই তৃপ্ত থাকতেন।’

বদরযুদ্ধে (Battle of Badr) ধৃত বন্দীদিগের ভাগ্য সম্বন্ধে মীমাংসার ভার ও অধিকার আল্লাহ কর্তৃক মুসলমানদের প্রতি ন্যস্ত হয়েছিল এবং মুহম্মদ প্রকাশ্যভাবে এর ঘোষণাও করে দিয়েছিলেন। এ কারণে বন্দীদের মদিনায় আনয়নের পর পরামর্শ সভা বসল। মুহম্মদ শিষ্যদের মতামত জানতে চাইলেন। আবু বকর নিবেদন করলেন, ‘হযরত এরা সকলে আমাদের স্বজন ও আত্মীয়। আমার মতে যদি কিছু কিছু অর্থ নিয়ে এদেরকে মুক্তি দেয়া হয়, তাতে আমাদের সাধারণ তহবিলে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত হবে, পক্ষান্তরে অল্পদিনের মধ্যে এদের সকলের পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করাও সম্ভব।’

মুহম্মদ আবু বকরের মতামত শোনার পর ওমরের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, ‘খাত্তাবের পুত্র, আপনার কি মত?’
ওমর স্ব-সম্ভ্রমে নিবেদন করলেন, ‘এরা ইসলামের চিরশত্রু। মুসলমানদেরকে নির্যাতিত করতে, আল্লাহর রসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে এবং আল্লাহর সত্য ধর্মকে পৃথিবীর পৃষ্ঠ হতে মুছে ফেলতে এরা সাধ্যমতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। এগুলি অন্যায়, অধর্ম ও অত্যাচারের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্ত্তি। এদেরকে অবিলম্বে হত্যা করে ফেলা উচিৎ। প্রত্যেক মুসলমান উলঙ্গ তরবারী হস্তে দন্ডায়মান হবে এবং নিজহস্তে নিজের আত্মীয়বর্গের মুন্ডুপাত করবে- এটাই ন্যায়তঃ বলে আমি মনে করি।’

মুহম্মদ দু‘টি ফয়সালাই সাহাবীদের কাছে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পেশ করলেন। অধিকাংশ সাহাবীর মতের প্রতিধ্বনি ছিল মুক্তিপণের মাধ্যমে বন্দীদেরকে মুক্তিদান। সুতরাং রহমাতুল্লিল আলামীন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করলেন। অতঃপর মুক্তিপণ নির্ধারিত হল। এর পরিমান ছিল চারশত দিরহাম। এসময় জিব্রাইল এসে মুহম্মদকে অবহিত করলেন যে, বন্দীদেরকে অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্তের কারণে আল্লাহর নির্দেশক্রমে একথা অবধারিত যে, এর বদলা হিসেবে আগামী বৎসর সমসংখ্যক মুসলমান যুদ্ধে শহীদ হবে।’

অতঃপর কোরআনের এ আয়াত নাযিল হল- নবীর পক্ষে উচিৎ নয় বন্দীদেরকে নিজের কাছে রাখা, যতক্ষণ না দেশময় প্রচুর রক্তপাত ঘটাবে। তোমরা পর্থিব সম্পদ কামনা কর, অথচ আল্লাহ চান আখেরাত। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরক্রমশালী হেকমতওয়ালা। (৮:৬৭)

বদর যুদ্ধের সময় পর্যন্ত যুদ্ধবন্দীদের প্রতি কৃপা করা বা মুক্তিপণ নেয়া নিষিদ্ধ ছিল। তাই অধিকাংশ সাহাবী কর্তৃক মুক্তিপণ বাবদ পার্থিব সম্পদ কামনা করা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ছিল না। কিন্তু মুসলমানরা যে এমন সিদ্ধান্ত নেবে তা পূর্ব থেকেই লওহে মাহফুজে তিনি লিখে রেখেছেন। একারণে কোন আযাব তাদেরকে পাকড়াও করবে না। সাহাবীদেরকে সতর্ক করা ঐ আয়াতটি এই-যদি একটি বিষয় না হত যা পূর্ব থেকেই আল্লাহ লিখে রেখেছেন, তাহলে তোমরা যা গ্রহণ করছ, সেজন্যে বিরাট আযাব এসে পৌঁছাত।(৮:৬৮)

এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর মুহম্মদ সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্তের কারণে আল্লাহর আযাব নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিল। আর যদি আযাব এসেই পড়ত, তবে ওমর ইবনে খাত্তাব ও সা‘দ ইবনে মু‘আজ ব্যতিত কেউই রেহাই পেত না।’

অতঃপর এই আয়াত নাযিল হল- হে নবী, তাদেরকে বলে দাও, যারা তোমার হাতে বন্দী হয়ে আছে যে, আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে কোনরকম মঙ্গল চিন্তা রয়েছে বলে জানেন, তবে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী দান করবেন যা তোমাদের কাছ থেকে বিনিময়ে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। বস্তুতঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।(৮:৭০)

অনেকে আশঙ্কা করছিল কুরাইশরা মক্কায় ফিরে গিয়ে আবারও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। তখন তাদের আশঙ্কামুক্ত করতে এই আয়াত নাযিল হল-আর যদি তারা তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে চায়-বস্তুতঃ তারা আল্লাহর সাথেও ইতিপূর্বে প্রতারণা করেছে, অতঃপর তিনি তাদেরকে ধরিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিজ্ঞাত, সুকৌশলী।(৮:৭১)

যে সকল বন্দী লেখাপড়া জানত কিন্তু মুক্তিপণ দিতে অক্ষম ছিল তাদেরকে মুক্তির বিনিময়ে দশটি বালককে লেখাপড়া শেখাতে বলা হয়েছিল। আর যাদের শিক্ষা ও অর্থ কোনটাই ছিল না তাদেরকে কোন প্রকার পণ না নিয়েই মুক্তি দেয়া হয়েছিল। এভাবে মুহম্মদের দয়া ও মুসলমানদের অনুগ্রহের ফলে অল্পদিনের মধ্যে কুরাইশ সমস্ত বন্দী স্বাধীনভাবে স্বদেশে ফিরে গেল।

মুহম্মদের পিতৃব্য আব্বাস বদর যুদ্ধে ধৃতবন্দীদের একজন ছিলেন। তাকে বন্দী অবস্থায় মদিনায় আনা হলে তার মুসলিম আত্মীয়বর্গ যারা মদিনাতে হিযরত করে চলে এসেছিল তারা তাকে বাতিল ধর্মের উপর বহাল থাকার জন্যে বিদ্রুপ করতে লাগল। তখন আব্বাস বললেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করে আছ, অথচ আমরা কা’বার রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি সরবরাহ করে থাকি? তাই আমাদের সমান আমল কারও হতে পারে না।’

তার এই কথা ও তার জবাব কোরআন দিয়েছে এভাবে-তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনেকর, যে ঈমান রাখে আল্লাহ ও শেষবিচারের দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করেছে আল্লাহর রাহে, এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়, আর আল্লাহ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না।(৯:১৯)

যাহোক মুক্তিপণের সময় আব্বাস যখন মুহম্মদের সম্মুখে আনীত হলেন, তিনি দেখলেন যে তার গায়ে কোন কোর্তা নেই। তখন তিনি উপস্থিত সাহাবীদের বললেন, ‘তাকে একটি কোর্তা পরিয়ে দেয়া হোক।’
আব্বাস ছিলেন দীর্ঘাদেহী লোক। উপস্থিত আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও ছিলেন দীর্ঘাদেহী। তিনি আগ্রহ করে তার কোর্তা খুলে দিলে মুহম্মদ তা তার পিতৃব্য আব্বাসকে পরিয়ে দিলেন।

অতঃপর তিনি পিতৃব্যকে বললেন, ‘আপনার জন্যে মুক্তিপণ ধার্য্য হয়েছে।’
আব্বাস নিবেদন করলেন, ‘আমার কাছে যে স্বর্ণমুদ্রা ছিল তা মুক্তিপণ হিসেবে গণ্য করা হোক।’ তিনি ৭০০স্বর্ণমুদ্রা কুরাইশ সৈন্যদের জন্যে ব্যয় করার উদ্দেশ্যে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।
তিনি বললেন, ‘তা মুসলমানদের গনিমতের মালে পরিণত হয়েছে। মুক্তিপণ হতে হবে সেগুলো বাদে। তাছাড়া আপনার দুই ভাতিজা আকিল ইবনে আবু তালিব ও নওফেল ইবনে হারেসের মুক্তিপণও আপনাকে পরিশোধ করতে হবে।’
আব্বাস বললেন, ‘আমার উপর এত অধিক অর্থনৈতিক চাপ পড়লে আমাকে কুরাইশদের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হবে।’
তিনি বললেন, ‘আপনি সেই অর্থ মুক্তিপণ বাবদ দেবেন যা আপনি যুদ্ধে আসার আগে আপনার স্ত্রী উম্মুল ফজলের কাছে রেখে এসেছেন।’
একথা শুনে আব্বাস অতি অবাক হয়ে তার মুখপানে চেয়ে রইলেন।

বদর যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এসে মুহম্মদের জামাতা আ‘স বন্দী হয়েছিলেন। পিতার নব্যুয়ত প্রাপ্তির পর কন্যা জয়নব ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার স্বামী আ‘স পৌত্তলিক রয়ে গিয়েছিলেন। আ‘স ছিলেন খাদিজার ভাগিনেয় এবং তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও ধনী। আ‘সকে কখনই মুহম্মদ বা খাদিজা কেউই ইসলাম গ্রহণের জন্যে পীড়াপীড়ি করেননি বা জয়নবকে তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টাও করেননি। মুহম্মদ যখন তার পরিবারকে মক্কা থেকে মদিনায় স্থানান্তরিত করেন, তখন জয়নব তার স্বামীর গৃহেই রয়ে গিয়েছিলেন।
       
বন্দীরা মদিনায় আনীত হলে অন্যান্য বন্দীর মত আ‘সেরও মুক্তিপণ নির্ধারিত হয়। তখন জয়নব তার স্বামীর মুক্তিপণ বাবদ কিছু অর্থ ও একটি মুল্যবান স্বর্ণহার পাঠিয়ে দেন। এই হার বিবি খাদিজা জয়নবকে বিবাহে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। হারটি দেখে মুহম্মদ বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং আ’সের কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ প্রদেয় হারটি গ্রহণ না করার জন্যে শিষ্যদের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তারা সম্মত হল। আ‘সকে হারটি ফিরিয়ে দেয়া হল একটি মাত্র শর্ত দিয়ে যে, তিনি জয়নবকে মদিনায় পাঠিয়ে দেবেন।
আ‘স তার কথা রক্ষা করেছিলেন।

সমাপ্ত।

বিদ্র: জয়নব খাদিজার কন্যা হোক বা তার বোন হালার, বিবি খাদিজা  ও মুহম্মদ তাকে লালন-পালন করেছেন এতে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই।
এই সময়ে মার্চ ১২, ২০১২ কোন মন্তব্য নেই: এই পোস্টে লিঙ্ক এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!Twitter-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
লেবেলসমূহ: আনসার, আবু জেহেল, ইকরামা, মুহম্মদ, মোহাজির, Battle of Badr
Hijrat: মুহম্মদের মদিনায় হিজরত।
শিষ্যদের প্রায় সকলে ইয়াসরিবের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করলেও, মুহম্মদ একাই অনুগত আলী ও আবু বকরসহ সাহসিকতার সঙ্গে নিজ অবস্থান আগলে ছিলেন। অবশ্য যে সকল মুসলমান নরনারী কুরাইশদের দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত ও বন্দী হয়ে মক্কায় অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিল তাদের কথা আলাদা।

ইতিমধ্যে বিপদের মেঘ দ্রুত ঘনিয়ে আসছিল। মুহম্মদ যে কোন সময়ে পলায়ন করতে পারেন এই আশঙ্কায় দার-উন-নাদওয়ায় (কোসাই ইবনে কেলাবের বাড়ী- বর্তমান বাবুজ জিয়াদাতই সেইস্থান যেখানে এই বাড়ীটি ছিল।) কুরাইশদের একটি জরুরী অধিবেশন বসল-অন্যত্র থেকে কিছুসংখ্যক প্রধানকে এই অধিবেশনে ডাকা হল।
মুহম্মদের বংশকে এই সভায় আহবান করা হয়নি।

উপস্থিত সমস্যা ও তার সমাধানকল্পে আহবায়িত এই সভা খুবই বাক-বিতন্ডাপূর্ণ হল। কারণ, কুরাইশদের মনে ভয় প্রবেশ করেছিল। এই ভয় ছিল এই যে, এতদিন মুহম্মদের ইসলাম প্রচার ও লোকদের নূতন ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার বিষয়টি মক্কাতেই সীমাবদ্ধ ছিল অর্থাৎ কুরাইশদের আয়ত্ত্বের মধ্যেই ছিল, কিন্তু এখন তা মদিনাতেও বিস্তার লাভ করেছে এবং তার অনুসারীদেরও অধিকাংশ মদিনাতে হিযরত করেছে। এখন মুহম্মদ সেখানে পালিয়ে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন। তাতে কুরাইশদের সমূহ বিপদের সম্ভাবণা। এ কারণে সভায় তাকে যাবৎজীবন কারাদন্ড প্রদান বা নগর থেকে বহিস্কার করা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হল।

একজন বলল, ‘আমার মতে হাতে হাতকড়ি, পায়ে বেড়ী দিয়ে এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তাকে জেলখানায় রাখা হোক। তারপর কারাকক্ষের দরজা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হোক। সেখানে সে নিজের পাপের দন্ডভোগ করতে করতে মরে যাবে।’
আর একজন এ কথার প্রতিবাদ করে বলল, ‘এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করলে মুহম্মদের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনদের এ সংবাদ জানতে বাকী থাকবে না। তারা যে কোন প্রকারে, তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। এতে একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধ-বিগ্রহ বেঁধে একটা হিতে বিপরীত কান্ড ঘটতে পারে-এই প্রস্তাব একেবারেই অসমীচীন।’
আর একজন বলল, ‘তাকে দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হোক। দেশান্তরিত হয়ে যাবার পর, সে যেখানে যাক বা যা করুক, তা আমাদের দেখার কোন আবশ্যকতা নেই। আমরা নিরাপদে নিজেদের কাজ-কর্মে মনোযোগ দিতে পারব।’

এই প্রস্তাবেরও প্রতিবাদ হল। প্রতিবাদকারীরা বলল, ‘তার কথা যেরূপ মিষ্টি এবং সে মানুষের মনকে যেমন সুন্দর করে বশীভূত করে নিতে পারে-তাতে সে যে দেশে গমন করবে, সেখানেই তার বহু ভক্ত জুটে যাবে। তাহলে আমাদের কন্টক যেমনকার তেমনি রয়ে গেল। পক্ষান্তরে অন্যত্র যেতে পারলেই সে লোকবলে পুষ্ট হবে। তখন আমাদের উপর আপতিত হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার পক্ষে সহজ হয়ে পড়বে।’ 

অতঃপর তাকে হত্যা করার প্রস্তাব উঠল; কিন্তু কেউ একজন তাকে হত্যা করলে তিনি ও তার পরিবার রক্তের প্রতিশোধ-প্রতিহিংসায় কবলিত হয়ে পড়বেন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

অবশেষে আবু জেহেল (তার প্রকৃত নাম আমর এবং বিচক্ষণতার জন্যে সে আবুল হিশাম (জ্ঞানের পিতা) উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মান্ধতার জন্যে নতুন ধর্মের মধ্যে তিনি কোন কল্যাণ দেখতে পাননি, এ কারণে মুহম্মদ তাকে আবু জেহেল (অজ্ঞানতার পিতা) উপাধি দেন) পরামর্শ দিলেন- ‘সকল গোত্রের বাঁছাইকৃত লোকেরা তাকে হত্যা করবে।’
প্রস্তাবটি সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হল।

কুরাইশদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোরআন জানায়-‘এবং (হে মুহম্মদ! সেই ঘোর বিপদের কথা স্মরণ কর) যখন অবিশ্বাসীরা তোমার সম্বন্ধে- তোমাকে বন্দী করে রাখবে কি তোমাকে হত্যা করে ফেলবে, কিম্বা তোমাকে দেশ হতে বহিস্কার করে দেবে- এ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল।(৮:৩০)

এদিকে ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয় মুহম্মদকে বিপদ সম্পর্কে সাবধান করল। অতঃপর জিব্রাইল মারফত তিনি কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হলেন ও হিযরতের আদেশ পেলেন। ইতিপূর্বেই মুহম্মদ মানসিকভাবে হিযরতের প্রস্তুতিতে ছিলেন, সুতরাং তিনি দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিলেন। আর  আবু বকর তার সঙ্গী হবেন এটাও তিনি নিশ্চিত ছিলেন।

দ্বিপ্রহরের প্রখর রৌদ্রে মুহম্মদ আবু বকরের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। আবু বকর পূর্ব থেকেই হিজরতের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। তিনি চার মাস পূর্বে দু’টি দ্রুতগামী উট মুহম্মদের পূর্ব ইঙ্গিতে ক্রয় করে রেখেছিলেন। তাকে এমন অসময়ে আগমন করতে দেখে আবু বকর বললেন, ‘ব্যাপার কি? আমার জনক-জননী আপনার প্রতি উৎসর্গীত হোক।’
মুহম্মদ বললেন, ‘ব্যাপার কিছুই না। আমি হিযরত (Hijrat) করার অনুমতি পেয়েছি।’
তিনি বললেন, ‘আমি সঙ্গে যেতে পারব কি?’
সম্মতি সূচক উত্তর পেয়ে আবু বকর বললেন, ‘তাহলে আপনি আমার একটি উট গ্রহণ করুন।’
তিনি বললেন, ‘বেশ। তবে বিনামূল্যে নয়।’
মুহম্মদ আবু বকরের সঙ্গে যাত্রার বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে গৃহে ফিরে এলেন।

এদিকে আসমা ও আয়েশা দু‘বোন মিলে তাড়াতাড়ি করে তাদের পথের জন্যে কিছু খাদ্য তৈরী করতে লাগলেন। আর আবু বকর আপণ কর্তব্যের খাতিরে নিজ পরিবারকে এবং সহায় সম্পত্তি কুরাইশদের মধ্যে রেখে, আনন্দ ও আগ্রহ সহকারে, ইসলামের জন্যে, সত্যের জন্যে, আল্লাহর রসূলের জন্যে- নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে, নিজেকে আসন্ন মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে নিক্ষেপ করে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। 

মক্কার জনসাধারণ কুরাইশ দলপতিদের প্ররোচনায় ও নিজেদের অজ্ঞতাবশতঃ মুহম্মদের বিরুদ্ধাচারণ করতে কুন্ঠিত হয়নি। কিন্তু সেই পরম শত্রুকে তারা তখনও এতদূর বিশ্বাস্য ও মহাত্মা বলে মনে করত যে মক্কার যার যে কোন মূল্যবান অলঙ্কার ও নগত অর্থ আমানত বা গচ্ছিত রাখার আবশ্যক হত, সে তা নিঃসংশয়ে তার কাছে রেখে যেত। এমনকি তিনি যখন আবু বকরকে নিয়ে মদিনায় যাত্রা করার জন্যে প্রস্তুত হলেন, তখনও তার কাছে কুরাইশদের বহু মূল্যবান জিনিষপত্র গচ্ছিত ছিল, তখনও তিনি আমিন ও সাদেক নামে খ্যাত। তাকে সেইরাত্রে চলে যেতে হবে অথচ আমানতের জিনিষপত্রগুলি ফিরিয়ে দিতে গেলে লোকের মনে সন্দেহের উদ্রেক হবে। এই কারণে তিনি, আলীকে মক্কায় রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন।

সন্ধ্যা রাত। গৃহীত প্রস্তাব মত লোকেরা মুহম্মদের গৃহ পাহারা দিতে এল। মুহম্মদ তাদের অভিসন্ধি পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। সুতরাং তিনি হত্যাকারীদের দৃষ্টি তার শয্যার উপর নিবদ্ধ করার জন্যে তার সবুজ পোশাক অনুগত আলীকে পরিধান করালেন ও তার শয্যায় শয়ন করতে আদেশ করলেন এবং তিনি হযরত দাউদের মত জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলেন।

লোকেরা রাত্রি জেগে মুহম্মদের গৃহ পাহারা দিতে লাগল এবং প্রত্যুষে যখন তিনি ঘর থেকে বের হবেন তখন তাকে হত্যা করার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। তারা মাঝে মাঝে দরজার একটি ছিদ্র দিয়ে দেখতে লাগল যে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন কিনা।

সওর গুহা।
এদিকে মুহম্মদ নির্দিষ্ট স্থানে আবু বকরের সাথে মিলিত হলেন। অতঃপর তারা সকলের অলক্ষ্যে তাদের নির্দয় জন্মভূমি থেকে পলায়ণ করলেন।

তারা মক্কার দক্ষিণ দিকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত সত্তর গিরি গুহায় কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলেন। মক্কা হতে হোছায়নি গ্রামে যে পথ গিয়েছে, ঐ পথের বামদিকে-আন্দাজ দেড় ঘন্টার পথ অতিক্রম করলে এই পর্বত দেখা যায়। পর্বতের চূঁড়া দেশে এই গুহাটি অবস্থিত। গুহাটির একটি মাত্র প্রবেশ মুখ ছিল-যার মধ্যে দিয়ে একজন মোটাসোটা লোক কষ্টে প্রবেশ করতে পারত। পরবর্তীতে যাত্রীদের সুবিধার জন্যে অন্যদিক হতে একটা প্রশস্তপথ তৈরী করা হয়েছিল।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আলী গাত্রত্থান করলেন। অতঃপর আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দ্বার খুলে বেরিয়ে এলেন তিনি। তৎক্ষণাৎ অবরোধকারীরা খোলা তরবারী হাতে ঘিরে ধরল তাকে। ভোরের আলো ততটা না ফুটলেও তারা মুহম্মদের সবুজ পোষাক পরিহিত আলীকে চিনতে পারল। কাজেই তাকে হত্যা করতে উদ্যোগী হল না তারা। বরং সারারাত নিজেদের বোকামীর কথা চিন্তা করে তারা বিশেষ লজ্জিত হয়ে পড়ল।

মুহম্মদ পলায়ন করেছেন- এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এতে কুরাইশদের উম্মত্ততা সীমাহীন আক্রোশে ফেঁটে পড়ল। হত্যাকারীরা ব্যর্থ হয়েছে- আর এই ব্যর্থতা তাদের সমগ্র শক্তিকে জাগিয়ে তুলল।

উন্মত্ত কুরাইশদল আলীকে বন্দী করে নিয়ে এল। অতঃপর আক্রোশ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বল, মুহম্মদ কোথায়?’
আলী দুঃসাহসিক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর করলেন, ‘তোমরা কি তার গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্যে আমাকে নিয়োজিত করেছিলে?’

সুষ্ঠ জবাব না পেয়ে তারা আলীকে উৎপীড়নের চরম করল। তারপর সদলবলে মুহম্মদের খোঁজে আবু বকরের গৃহদ্বারে এসে উপস্থিত হল। কেননা মুহম্মদ যে মদিনায় গমন করবেন এবং আবু বকর ছাড়া যে তিনি কিছুই করবেন না এ কথা তাদের অবিদিত ছিল না।

দলপতি ক্রোধান্বিত হয়ে আবু বকরের গৃহদ্বারে ভীষণভাবে করাঘাত করতে শুরু করলেন। বাড়ীতে তখন যুবতী আসমা ও বালিকা আয়েশা ছিলেন। ব্যাপার কি তা তাদের বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হল না। পিতা তাদেরকে বিপদের মধ্যে রেখে গেছেন এবং নিজেও মৃত্যুর মুখে ঝাপিয়ে পড়েছেন কিন্তু তাতে তারা এতটুকু বিচলিত ছিলেন না। আসমা দরজা খুলে দিলেন এবং সম্মুখে মূর্ত্তিমান শয়তান আবু জেহেলকে দেখতে পেলেন। আবু জেহেল তীব্রস্বরে হুংকার দিলেন, ‘বল, তোর পিতা কোথায়?’
নিরুদ্বিগ্ন ঠান্ডা স্বরে আসমা উত্তর করলেন, ‘আমি বলতে পারিনে।’
সাথে সাথে আবু জেহেল তাকে প্রচন্ড এক চড় লাগালেন। এই চড়ে আসমার কর্ণবালি ছিন্ন হয়ে গেল এবং তিনি ছিঁটকে পড়লেন। ক্রোধান্বিত দলপতি ভূ-লুন্ঠিত আসমার প্রতি ক্ষণকাল তীব্র দৃষ্টি হেনে দলবলসহ প্রস্থান করলেন।

অশ্বারোহীরা দেশময় তন্নতন্ন করে মুহম্মদকে খুঁজতে লাগল। তার মস্তিস্কের উপর কুরাইশ প্রধানরা মূল্য নির্ধারণ করলেন।
এক’শ উট মুহম্মদের শিরের মূল্য নির্ধারিত হয়েছিল।

পলাতকদ্বয় তিন দিন সওর গুহায় অবস্থান করলেন। দু’একবার বিপদ এত কাছে এসে পড়েছিল যে, আবু বকর সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
খুঁজে ফেরা কুরাইশদের একদল মুহম্মদের অনুসন্ধানে গুহার মুখ পর্যন্ত এসে গেল। এ সময় আবু বকর ভীতকন্ঠে বললেন, ‘আমরা যে মাত্র দু’জন।’
মুহম্মদ বললেন-‘না, আমরা তিনজন, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’

এ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত- ‘যখন অবিশ্বাসীরা তাকে দেশান্তরিত করে দিয়েছিল, দু-‘জন মাত্র, দু‘জনের একজন সে (মুহম্মদ)। যখন তারা গুহায় অবস্থান করছিল (এবং অবিশ্বাসীদের উলঙ্গ তরবারীর নীচে তাদের নিঃসহায় অবস্থা ও আসন্ন মৃত্যুর বিভিষিকা প্রত্যক্ষ করে সত্যের ধ্বংসের আশঙ্কায়-যখন তার সঙ্গী বিচলিত হয়ে পড়েছিল) সে আপন সহচর (আবু বকর)কে বলল, -চিন্তিত হবে না, বিষন্ন হবে না (আমরা দু‘জন মাত্র নই) আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’(৯:৪০)

এদিক ওদিক অনুসন্ধান করার পর গুহার মুখে দৃষ্টি ফেলে অনুসন্ধানীরা বলল, ‘এর ভিতর নিশ্চয়ই কেউ প্রবেশ করেনি, নতুবা মাকড়সার জাল কিছুতেই অক্ষত থাকত না।’

মাকড়সারা ক্ষতিগ্রস্থ স্থানে পুনঃরায় জাল বুনে নিয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে পরিত্যক্ত গুহামুখে পূর্ব থেকেই প্রচুর মাকড়সা জাল বিস্তার করেছিল সহজ শিকারের আশায়। মুহম্মদ ও আবু বকরের প্রবেশের কারণে এই জাল কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বটে কিন্তু তারা দীর্ঘসময় গুহাতে অবস্থান করায় মাকড়সারা ক্ষতিগ্রস্থ স্থানে পুনঃরায় জাল বুনে নিয়েছিল।

গুহায় তল্লাশি না করেই অনুসন্ধানী কুরাইশ দল ফিরে গেল। তিনদিন পর তারা তাদের তল্লাশি প্রচেষ্টা কিছুটা শিথিল করল। এ কয়দিন আবু বকরের দুঃসাহসী কন্যা আসমা রাত্রিতে একাকী সবার অলক্ষ্যে অতি সতর্পণে কয়েক মাইল পথ হেঁটে তাদের জন্যে আহার্য সরবরাহ করেছিলেন। গৃহত্যাগের পূর্বে আবু বকর তাদের অবস্থান পরিকল্পণা তার এই জৈষ্ঠ্য কন্যাকে জানিয়ে এসেছিলেন।
তৃতীয় রজনীর প্রভাতে পলাতকরা গুহা ত্যাগ করলেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ার্কা নামক এক ব্যক্তিকে আবু বকর পূর্ব হতে নিযুক্ত করেছিলেন। তার সঙ্গে কথা ছিল তৃতীয় রজনীর প্রভাতে তিনি আবু বকরের নির্দিষ্ট উট দু‘টি নিয়ে সওর পর্বতের কাছে উপস্থিত হবেন। আব্দুল্লাহ যদিও তখন পর্যন্ত পৌত্তলিক ছিলেন। কিন্তু তিনি তার কথা ও দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেছিলেন। উট দু‘টি ও আমেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

মুহম্মদ ও আবু বকর মদিনার পথে।
সাধারণভাবে মক্কা ও মদিনার কাফেলা যে সকল পথ দিয়ে যাতায়াত করে থাকে, সেই সকল পথ দিয়ে গমন করা কোনমতেই নিরাপদ নয়, এজন্যে অপরিচিত পথ দিয়ে তাদেরকে যেতে হবে। আব্দুল্লাহ এসম্পর্কে খুবই দক্ষ ব্যক্তি তাই তাকে ও তার সঙ্গে আগত আমেরকে সঙ্গে নেয়া হল। এরপর স্বল্প ব্যবহৃত পথে তারা লোহিত সাগরের উপকূল ধরে ইয়াসরিবের পথে যাত্রা করলেন।

মুহম্মদ ও তার সঙ্গীরা দ্রুত বেগে পথ পর্যটন করছেন। দেখতে দেখতে সূর্যের কিরণ প্রখর হতে প্রখরতর হতে লাগল। একসময় তারা পরিশ্রান্ত হয়ে ছায়ার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হলেন এবং সম্মুখে একটি পাহাড়ের চাতানের নীচে আশ্রয় নিতে থামলেন। আবু বকর উট থেকে নেমে প্রথমে স্থানটি যথাসম্ভব পরিস্কার করে সেখানে নিজের চাদর বিছিয়ে মুহম্মদকে তথায় বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করলেন।
মুহম্মদ উট থেকে অবতরণ করলেন।

মুহম্মদ বিশ্রাম নিচ্ছেন, এসময় আবু বকর তথা হতে একটু দূরে গিয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। কুরাইশ কর্তৃক নিয়োজিত ঘাতকদল এখনও তাদেরকে অনুসরণ করছে কিনা, দূরদর্শী আবু বকর বিশেষ সতর্কতার সাথে তার সন্ধান নিচ্ছিলেন। অতঃপর তার নজরে এল-অদূরে একজন রাখাল কতকগুলি ছাগল চরাচ্ছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে ঐ রাখালকে প্রশ্ন করে জানতে পারলেন যে, সে একজন কুরাইশ ভৃত্য। তার অনুরোধ মতে রাখাল একটি দুগ্ধবতী ছাগ দোহন করে একটি পাত্র ভর্তি করে নিয়ে এল। আরবের নিয়মমত তাতে কিছুটা পানি মিশ্রিত করে তিনি তা মুহম্মদের কাছে নিয়ে এলেন। মুহম্মদ সেই দুধ পান করলেন। একসময় আবু বকর বললেন, ‘যাত্রার সময় হয়েছে।’
তারা সেখান থেকে যাত্রা করলেন।

Migration Route (in Red).
মুহম্মদের শিরের জন্যে ধার্য্য উচ্চমূল্য মক্কা থেকে অনেক অশ্বারোহীকে পথে টেনে এনেছিল এবং তখনও তারা সযতেনে অসহায় গৃহত্যাগীকে খুঁজে ফিরছিল। মুহম্মদের কাফেলাটি এদেরই একজনের নজরে এল। সে ত্বরিত নিজ পল্লীতে ফিরে গেল। পল্লীর প্রধানরা তখন এক মজলিশে বসে গল্পগুজব করছিলেন। আগন্তুক ব্যাগ্র ও ত্রস্তভাবে সংবাদ দিল, ‘একটি ক্ষুদ্র যাত্রীদল সমূদ্র উপকূলের দিক দিয়ে যাত্রা করছে।’

সূরাকা ইবনে মালেক একজন দূর্বার, দুধর্ষ যোদ্ধা। সে সেখানে উপস্থিত ছিল, সে উত্তমরূপে বুঝতে পারল যে সংবাদদাতা যথার্থ সংবাদই এনেছে। কিন্তু শত উটের মূল্যবান পুরস্কার আর মুহম্মদকে হত্যার অক্ষয় যশ একাই লাভ করবে সঙ্কল্প করল সে। কাজেই এসময় সে চাতুরীর আশ্রয় নিল, বলল, ‘না, না, ঐ দলটি মুহম্মদ বা তার সহচরবৃন্দের নহে। আমি বিশেষরূপে অবগত রয়েছি যে, ঐ দলটি তাদের পলায়িত পশুর সন্ধানে বের হয়েছে।’
তার কথার সত্যতায় আর কারও সন্দেহ রইল না এবং কেউই যাত্রীদলের অনুসরণে প্রবৃত্ত হল না।

Migration Route (in Red).
অল্পক্ষণ পরে সূরাকা ধীর পদক্ষেপে তথা হতে নিজ বাড়ীতে এল এবং অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দ্রুতগামী অশ্বে আরোহণ পূর্বক উপকূলের দিকে তীরবেগে ধাবিত হল।
একসময় দলটি সুরাকার দৃষ্টি সীমানায় চলে এল।

দূর হতে ধাবমান এক অশ্বারোহীকে দেখতে পেয়ে আবু বকর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমাদের সর্বনাশ।’
মুহম্মদ বললেন, ‘ভীত হবেন না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন।’

পলাতকদের দেখতে পেয়ে সুরাকা এক ধরণের উত্তেজনা অনুভব করল। সে ত্রস্ততার মধ্যে  দ্রুতবেগে তার অশ্বকে সম্মুখে ধাবিত করল। হঠাৎ তার অশ্ব একখন্ড প্রস্তরে আঘাতপ্রাপ্ত হল। এতে সে ছিঁটকে ভুপাতিত হল। তার মন অনেকটা ভেঙ্গে পড়ল। সে নিরুৎসাহ হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং আর অগ্রসর হবে কিনা, এ সম্পর্কে ইতস্ততঃ করতে লাগল। এরপর সে যলমের চোঙ্গা হতে শর শলাকা বের করে ভাগ্য পরীক্ষা করল। ফল না সূচক হল। এতে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে জর্জরিত এই পৌত্তলিকটির মন একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল।

অতঃপর সেইসময় শয়তানের প্ররোচনা তাকে এক’শ উটের পুরস্কার ও সম্মানিত হবার গৌরব লাভের লোভ দুঃসাহস এনে দিল। সে গণনার ফলকে অগ্রাহ্য করল। ভাবল- সম্ভবতঃ গণনারই ভুল হয়েছে। সে পুনঃরায় অশ্বারোহণ করল এবং দ্রুতবেগে সম্মুখে ধাবিত হল। কিছুদূর যেতে না যেতেই তার অশ্বের সম্মুখের পদদ্বয় মাটিতে প্রোথিত হল এবং সে পুনঃরায় ভু-তলশায়ী হল। এসময় আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে তার অশ্বটিকে উদ্ধার করতে পারল না। সে ভীত হল ও পূর্বেকার ভাগ্যপরীক্ষার ফলের কথা তার মনে পড়ল। দ্রুত হস্তে পুনঃরায় যলমের চোঙ্গা হতে শর শলাকা বের করে আবারও ভাগ্য পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হল সে।
ফল এবারও না সূচক।

এদিকে অদূরে উষ্ট্রপৃষ্ঠে উপবিষ্ট অবিচঞ্চল আত্মবিশ্বাসী মুহম্মদের সহাস্য মুখ। সেদিকে তাকিয়ে সুরাকা ভয়ে ও বিস্ময়ে একেবারে বিহবল হয়ে পড়ল। মুহম্মদ এসময় একমনে কোরআনের আয়াত আবৃত্তি করতে লাগলেন। আর আবু বকর উত্তেজনা নিয়ে সতর্কতার সাথে চতুর্দিকে ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলেন।

দেহে বল নেই, অন্তরে সাহস নেই, সর্বাঙ্গ অবসন্ন সুরাকা যাকে অনুসরণ করছিল তারই কাছে কাতরস্বরে অতঃপর ক্ষমাপ্রার্থী হল এবং ক্ষমা প্রদর্শণের সাফাইয়ের জন্যে অনুরোধ করল। আবু বকর প্রদত্ত একখানি অস্থির উপর এই সাফাই প্রদত্ত হল। মুহম্মদের নির্দেশে আমের এটা লিখলেন। 
এরপর মুহম্মদ সুরাকার অশ্বটিকে উদ্ধার করে দিলে সে ফিরে গেল। আর যাত্রীদল মদিনার দিকে প্রস্থান করলেন।

মুহম্মদ যে মদিনায় হিযরত করবেন এটা কুরাইশদের বিশেষরূপে জানা ছিল। তাই তারা মদিনা গমনের গন্তব্য পথের চারিপার্শ্বের আরব গোত্রগুলির মধ্যে নিজেদের সঙ্কল্প ও মূল্যবান পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। এই পুরস্কারের লোভে আসলাম বংশের বারিদা নামক জনৈক প্রধান, ৭০ জন দুর্ধর্ষ সঙ্গী নিয়ে মুহম্মদের আগমন প্রতীক্ষা করছিল। মদিনার উপরিভাগ আর অধিক দূরে নয়, এসময় এই ক্ষুদ্র যাত্রীদলের সাথে তাদের দেখা হল। ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব লুন্ঠনকারী, পশু প্রকৃতির এই দুর্ধর্ষ দস্যুদল একই সাথে বিদ্বেষে ও প্রলোভনে উত্তেজিত, উৎসাহিত। কা’বার অবমাননাকারী, দেবদেবীগণের শত্রু মুহম্মদের হত্যার ন্যায় পূণ্যকর্ম আর কি হতে পারে! তার উপর শত উটের মহামূল্য পুরস্কার।
মার মার কাট কাট রূপে ৭০টি নাঙ্গা তরবারী হাতে ছুটে এল তারা আগন্তুক দলটির দিকে।

মুহম্মদ নিবিষ্ট মনে কোরআন পাঠ শুরু করলেন। সেই পবিত্র সূর লহরী ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হয়ে দ্রুত আগুয়ান দস্যুদলের কর্ণ-কূহরে প্রবেশ করতে লাগল এবং তা শ্রোতাদের মর্মে স্থান করে নিল। দস্যু দলপতি বারিদার চরণদ্বয় যেন ভারাক্রান্ত হয়ে এল, তার বাহুদ্বয় শিথিল হয়ে পড়ল। এসময় মুহম্মদ তার সেই স্বাভাবিক মধুর-গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আগন্তুক! তুমি কে?’
‘আমি বারিদা, আসলাম গোত্রপতি।’
-‘আসলাম-শান্তি, শুভকথা।’
‘আর আপনি?’ -কম্পিত স্বরে বারিদার প্রশ্ন।
‘আমি মক্কার অধিবাসী, মুহম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। সত্যের সেবক, আল্লাহর রসূল।’ 
বারিদার শিথিল মুষ্ঠি হতে বর্শাদন্ড খসে পড়ল। অবিলম্বে সে বসে পড়ল। সহচররাও তাকে অনুসরণ করল।

মুহম্মদের মুখ নিঃসৃত বাণী শুনে বারিদা অভিভূত হয়ে পড়ল। এরপর যখন মুহম্মদ চলে যেতে উদ্যত হয়েছেন তখন বারিদা ভক্তি গদগদ কন্ঠে নিবেদন করল, ‘প্রভু হে! নিজ গুণে একবার যে চরণে ঠাঁই দিয়েছেন, তা থেকে আর বঞ্চিত করবেন না।’

মহা উৎসাহে সঙ্গীদের নিয়ে বারিদা তার অগ্রবর্তী হল। ৭০ খানা উলঙ্গ কৃপাণ-৭০ খানা দীর্ঘ বর্শাফলক, সূর্য্য কিরণে উদ্ভাসিত হয়ে তাদের পিছনে পিছনে হেলে দুলে চলতে লাগল। দলপতি নিজের শ্বেত পতাকাকে বার বার আন্দোলিত করে ঘোষণা করতে করতে চলল:
‘...স্বর্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আসছেন-
জগদ্বাসীর কাছে এই আনন্দ সংবাদ।’

বারিদা পথ হতে ফিরে গিয়েছিল। এরপরে সে বদর যুদ্ধের সমসাময়িককালে মদিনায় উপস্থিত হয়েছিল। মধ্যবর্তী সময়ে সে নিজ গোত্রে ইসলাম প্রচারে ব্যস্ত ছিল।

যাত্রীদল আর কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই অগ্রসর হতে থাকলেন। পথে জুবায়ের ইবনে আওয়াম ও কতিপয় লোকের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হল। ঐদল বাণিজ্য উপলক্ষ্যে সিরিয়ায় গিয়েছিল। জুবায়ের খুশী হয়ে আবু বকর ও মুহম্মদের ব্যবহারের জন্যে কয়েকখন্ড শ্বেতবস্ত্র উপহার দিলে তারা তা পরিধান করলেন। যাত্রীদল তাদের কাছ থেকে অবগত হলেন যে, মদিনাবাসী অধীর আগ্রহে তাদের আগমনের প্রতীক্ষায় রয়েছে।

মুহম্মদ যখন রাগেবের নিকটবর্তী জোহফা নামক স্থানে পৌঁছিলেন, তখন মক্কার পথ তার দৃষ্টিগোচর হল। এতে বায়তুল্লাহ ও স্বদেশের স্মৃতি তার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করল। তখন জিব্রাইল তাকে আশ্বস্ত করতে এই আয়াত নিয়ে আগমন করেছিলেন-যিনি তোমার প্রতি কোরআনের বিধান পাঠিয়েছেন, তিনি অবশ্যই তোমাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনবেন।(২৮:৮৫)

তিনদিন পথ চলার পর তারা ইয়াসরিবের সীমান্তে প্রবেশ করলেন। ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের এক গরমের দিনে মুহম্মদ তার উট "আল কাসোয়া" থেকে অবতরণ করলেন ইয়াসরিবের মাটিতে-যা পরে তার স্বদেশ ও আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল।

সমাপ্ত।
এই সময়ে মার্চ ১২, ২০১২ কোন মন্তব্য নেই: এই পোস্টে লিঙ্ক এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!Twitter-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
লেবেলসমূহ: ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয়, আবু জেহেল, আবু বকর, আবুল হিশাম, আয়েশা, আসমা, Hijrat
 
৭ মার্চ, ২০১২
Muhammad: মুহম্মদ তার প্রভু কর্তৃক তিরস্কৃত হলেন।

মুহম্মদের ব্যক্তিত্বের বিনয় নম্রতা, আত্মার মহত্ত্ব ও হৃদয়ের পবিত্রতা, চরিত্রের তপশ্চর্যা, অনুভূতির সূক্ষ্মতা ও কোমলতা এবং কঠোর কর্তব্যপরায়ণতা, যা তাকে আল-আমিন উপাধিতে বিভূষিত করেছিল তা সমন্বিত হয়েছিল তার আত্মসমীক্ষার কঠোর বোধের সঙ্গে- যা ছিল তার চরিত্রের বিশিষ্টতা। একবার তিনি মক্কার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলেন, তখন একজন অন্ধ, বিনয়ী বিশ্বাসীকে তার সঙ্গদান থেকে বিমুখ করেছিলেন। তিনি সর্বদা অনুশোচনার সঙ্গে এ ঘটনার পুনরুল্লেখ করতেন এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর অনুমোদনের কথা ঘোষণা করতেন।

বর্ণিত অন্ধ ব্যক্তিটি ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মকতুম। তিনি অন্ধ হওয়ার কারণে এটা জানতে পারেননি যে, মুহম্মদ (Muhammad) অন্যের সাথে আলোচনায় রত রয়েছেন। তিনি মসজিদে প্রবেশ করেই তাকে কোরআনের একটি আয়াতের পাঠ জিজ্ঞেস করেন এবং কয়েকবার আওয়াজ দেন।

মুহম্মদ কুরাইশ নেতৃবর্গকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। এই নেতৃবর্গ ছিলেন ওতবা ইবনে রাবিয়া, আবু জেহেল ইবনে হাশেম ও তার পিতৃব্য আব্বাস। মুহম্মদের বিরক্তির কারণ ছিল প্রথমতঃ আব্দুল্লাহর প্রশ্নটি ছিল মামুলি, আর তিনি তার এই মামুলি প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাবের জন্যে পীড়াপীড়ি করছিলেন। তিনি সাচ্চা মুসলমান ছিলেন এবং সদাসর্বদা মজলিসে উপস্থিত থাকতেন। সুতরাং তার এ প্রশ্ন অন্যসময়ও রাখতে পারতেন।

অতঃপর এই আয়াত নাযিল হল- ‘সে (মুহম্মদ) বিরক্ত হল, মুখ ফিরিয়ে নিল, কারণ তার কাছে এক অন্ধ এসেছিল। তুমি ওর সম্বন্ধে কি জান? সে হয়তঃ পরিশুদ্ধ হত বা উপদেশ নিত ও উপদেশ থেকে উপকার পেত। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ না করে, তবে তাতে তোমার কোন দোষ হত না। অথচ যে কিনা তোমার কাছে ছুটে এল, আর এল ভয়ে ভয়ে, তাকে তুমি অবজ্ঞা করলে, কখনও (তুমি এমন করবে) না এ এক উপদেশবাণী।(৮০:১-১১)

অতঃপর যখনই মুহম্মদ ঐ ব্যক্তিকে দেখতে পেতেন তখনি তাকে সম্মান দেখানোর জন্যে কাজ ফেলে এগিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘সেই ব্যক্তিকে বারবার অভিনন্দন যার জন্যে প্রভু আমাকে তিরস্কার করেছেন।’

এই অন্ধ ব্যক্তিকে মুহম্মদ দু‘বার মদিনার গভর্ণর করেছিলেন।
সমাপ্ত।




ফটো গ্যালারী

1/6
ওহুদ যুদ্ধ - হযরত মহাম্মদ (সা:) এর বিপ্লবী জীবন
2/6
মুসলিম নারীর বিধান
3/6
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা
4 / 6
ইসলামীক জিজ্ঞাসাঃ লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
5/6
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
6/6
উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব

Islam-icon Profile.png