LIVE
Loading latest headlines...

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

যাকাতের গুরুত্ব ও বিস্তারিত মাসায়িল আলোচনা

রবিবার, ডিসেম্বর ০১, ২০১৯ 1
বার দেখা হয়েছে
মাওলানা যাকারিয়া আব্দুল্লাহ
যাকাত : গুরুত্ব ও বিস্তারিত মাসায়িল
যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। কুরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত-যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ۝۱۱۰
‘তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। -সূরা বাকারা : ১১০

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ۝۵۶

‘তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’-সূরা নূর : ৫৬
সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَ الْمُقِیْمِیْنَ الصَّلٰوةَ وَ الْمُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ اُولٰٓىِٕكَ سَنُؤْتِیْهِمْ اَجْرًا عَظِیْمًا۠۠۝۱۶۲
‘এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব।’
অন্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন-

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ ؕ اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ۝۱۰۳
‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’-সূরা তাওবা : ১০৩

এছাড়া কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, সালাত ও যাকাতের পাবন্দী ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রশ্নই অবান্তর। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে, যেখানে খাঁটি মু’মিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে সেখানে সালাত-যাকাতের কথা এসেছে অপরিহার্যভাবে।

কুরআনের দৃষ্টিতে প্রকৃত পুণ্যশীলদের পরিচয় যেখানে দেওয়া হয়েছে সেখানে সালাত-যাকাতের উল্লেখ এসেছে। (সূরা বাকারা ১৭৭)
মুমিনের বন্ধু কারা-এই প্রশ্নের উত্তরেও সালাত-যাকাতের প্রসঙ্গ শামিল রয়েছে। (সূরা মায়েদা : ৫৫)
‘সৎকর্মপরায়ণদের বৈশিষ্ট্য ও কর্মের তালিকায় সালাত-যাকাতের প্রসঙ্গ অনিবার্য। (সূরা লুকমান : ৪)
মসজিদ আবাদকারীদের পরিচয় জানতে চাইলেও সালাত-যাকাত তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। (সূরা তাওবা : ১৮)
কুরআন মজীদ কাদের জন্য হেদায়েত ও শুভসংবাদ দাতা-এর উত্তর পেতে চাইলেও সালাত-যাকাত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। (সূরা নামল : ৩)
ভূপৃষ্ঠে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের পরও মুমিনদের অবস্থা কী তা জানতে চাইলে সালাত-যাকাতই অগ্রগণ্য। (সূরা হজ্জ্ব : ৪১)
বিধর্মী কখন মুসলিম ভ্রাতৃত্বে শামিল হয়- এ প্রশ্নের উত্তরে তাওবার সঙ্গে সালাত-যাকাতও উল্লেখিত। (সূরা তাওবা : ১১)
দ্বীনের মৌলিক পরিচয় পেতে চাইলে সালাত-যাকাত ছাড়া পরিচয় দান অসম্ভব। (সূরা বাইয়েনা : ৫)
মোটকথা, এত অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সালাত-যাকাত প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে এসেছে যে, এটা ছাড়া দ্বীন ও ঈমানের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। মুমিনের অন্তরের ঈমান সালাত-যাকাতের বিশ্বাসের ওপর এবং তার কর্মের ঈমান সালাত-যাকাতের কর্মগত বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর ভাষায়-

والزكاة أمر مقطوع به في الشرع يستغني عن تكلف الاحتجاج له، وإنما وقع الاختلاف في بعض فروعه، وأما أصل فرضية الزكاة فمن جحدها كفر.
‘যাকাত শরীয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলীল-প্রমাণের আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসআলায় ইমামদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। যাকাতের ফরযিয়তকে যে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।’ -ফাতহুল বারী ৩/৩০৯

উপরের আলোচনা থেকে যাকাতের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা এবং এর সুফল ও উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল। এখান থেকে এ বিষয়টাও অনুমান করা যায় যে, ফরয হওয়া সত্ত্বেও যারা যাকাত আদায় করে না তারা কত বড় ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার!

যাকাতের সকল সুফল থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে তাদেরকে যে মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তা-ও কুরআন মজীদে বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللّٰهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ ؕ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ؕ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ ؕ وَ لِلّٰهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ۠۠۝۱۸۰
আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। -সূরা আলইমরান : ১৮০

হাদীস শরীফে এসেছে- ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর সর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমরা পুঞ্জিভূত সম্পদ।’ -সহীহ বুখারী
.
এই গুরুত্বপূর্ণ ফরয আদায়ের জন্য কর্তব্য হল এ বিষয়ের শরয়ী মাসআলাগুলোর যথাযথ জ্ঞান লাভ করা। এ উদ্দেশ্যে যাকাতের মৌলিক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মাসায়েল এই প্রবন্ধে ফিকাহ ও হাদীসের কিতাবের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করার চেষ্টা করা হবে। তবে সকল মাসআলা এখানে আলোচিত হয়নি। বিস্তারিত জানার জন্য ফিকাহ ও ফতোয়ার নির্ভরযোগ্য কিতাবাদির সাহায্য নিতে হবে।

যাদের উপর যাকাত ফরয হয়
১. আগেই বলা হয়েছে যে, যাকাত ইসলামের একটি অপরিহার্য ইবাদত। এজন্য শুধু মুসলিমগণই যাকাত আদায়ের জন্য সম্বোধিত হন। সুস্থমস্তিষ্ক, আযাদ, বালেগ মুসলমান নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে যাকাত আদায় করা তার ওপর ফরয হয়ে যায়। -আদ্দুররুল মুখতার ২/২৫৯ বাদায়েউস সানায়ে ২/৭৯,৮২

কাফির যেহেতু ইবাদতের যোগ্যতা রাখে না তাই তাদের ওপর যাকাত আসে না।
এছাড়া অসুস্থমস্তিষ্ক মুসলিমের ওপর এবং নাবালেগ শিশু-কিশোরের ওপরও যাকাত ফরয নয়। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৬১-৪৬২; রদ্দুল মুহতার ২/২৫৯ রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮

যেসব জিনিসের উপর যাকাত ফরয হয়
২. সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর যাকাত ফরয হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরয হয়।

৩. সোনা-রুপার অলংকার সর্বদা বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক সর্বাবস্থাতেই তার যাকাত দিতে হবে। -সুনানে আবু দাউদ ১/২৫৫; সুনানে নাসায়ী হাদীস ২২৫৮; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৭০৫৪-৭০৬১,৭০৬৩-৭০৬৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ৯৯৭৪;৬/৪৬৯-৪৭১

৪. অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও যাকাত ফরয হয়।
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৬১; ৭০৬৬; ৭১০২

৫. জামা-কাপড় কিংবা অন্য কোনো সামগ্রীতে সোনা-রুপার কারুকাজ করা থাকলে তা-ও যাকাতের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যে পরিমাণ সোনা-রুপা কারুকাজে লেগেছে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে তারও যাকাত দিতে হবে। -মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৬৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১০৬৪৮,১০৬৪৯,১০৬৫১

সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তদ্রূপ হিরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোতেও যাকাত ফরয নয়।-কিতাবুল আছার মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৭০৬১-৭০৬৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৪৭-৪৪৮

৬. মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার যাকাত আদায় করা ফরয হয়।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৭০৯১,৭০৯২

তদ্রূপ ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও যাকাত ফরয হয়।

৭. টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে যাকাত ফরয হয়। -আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৭; রদ্দুল মুহতার ২/২৬২,৩০০

৮. হজ্বের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘর-বাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হচ্ছে তা-ও এর ব্যতিক্রম নয়। সঞ্চিত অর্থ পৃথকভাবে কিংবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যুক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে এবং নিসাবের ওপর এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত ফরয হবে। বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা যদি খরচ হয়ে যায় তাহলে যাকাত ফরয হবে না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৩২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩২৫

৯. দোকান-পাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে তা বাণিজ্য-দ্রব্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরয। -সুনানে আবু দাউদ ১/২১৮; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪/১৫৭; মুয়াত্তা ইমাম মালেক পৃ ১০৮; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১০৩,৭১০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১০৫৫৭, ১০৫৬০, ১০৫৬৩

১০. ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন জমি-জমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর যেমন মুদী সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলংকার, নির্মাণ সামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়ার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্য-দ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দেওয়া ফরয হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১০৩,৭১০৪


নিসাবের বিবরণ
১১. স্বর্ণের ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাব হল বিশ মিসকাল। -সুনানে আবু দাউদ ১/২২১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৭৭, ৭০৮২

আধুনিক হিসাবে সাড়ে সাত ভরি।

১২. রুপার ক্ষেত্রে নিসাব হল দু’শ দিরহাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৭৯
আধুনিক হিসাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা। এ পরিমাণ সোনা-রুপা থাকলে যাকাত দিতে হবে।

১৩. প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা বা বাণিজ্য-দ্রব্যের মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হয় তাহলে যাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়েছে ধরা হবে এবং এর যাকাত দিতে হবে।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৭৯৭,৬৮৫১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ৯৯৩৭

১৪. যদি সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্য-দ্রব্য- এগুলোর কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে এক্ষেত্রে সকল সম্পদ হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৬৬,৭০৮১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৩৯৩


কিছু দৃষ্টান্ত
ক) কারো কাছে নিসাবের কম সোনা এবং নিসাবের কম রুপা আছে, কিন্তু যে পরিমাণ সোনা আছে তার মূল্য মজুদ রুপার সাথে যোগ করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য হয় বা তার চেয়ে বেশি হয়। তাহলে সোনা-রুপার মূল্য হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ৯৯৭৯,১০৬৪৯; রদ্দুল মুহতার ২/৩০৩

খ) কারো কাছে কিছু স্বর্ণালংকার আর কিছু উদ্বৃত্ত টাকা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য আছে যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়। এর যাকাত দিতে হবে। -রদ্দুল মুহতার ২/৩০৩

গ) কারো কাছে নিসাবের কম রুপা আর কিছু উদ্বৃত্ত টাকা বা বাণিজ্যদ্রব্য আছে যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়। এরও যাকাত দিতে হবে। -আদ্দুররুল মুখতার ২/৩০৩

১৫. নিসাবের অতিরিক্ত সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা ও বাণিজ্যদ্রব্যের যাকাত আনুপাতিক হারে দিতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৩২, ৭০৭৪, ৭০৭৫, ৭০৭৯, ৭০৮০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৩৯০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৯৯

১৬. কারো কাছে সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যদ্রব্য পৃথকভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিসাব পরিমাণ ছিল, বছরের মাঝে এ জাতীয় আরো কিছু সম্পদ কোনো সূত্রে পাওয়া গেল এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৮৭২,৭০৪০,৭০৪৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩২৫,১০৩২৭

১৭. বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে ঐ সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৪২,৭০৪৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৩০২


যে সব জিনিসের ওপর যাকাত ফরয নয়

১৮. নিজ ও পোষ্য পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর যাকাত ফরয নয়।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৯-২০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫

১৯. গৃহের আসবাবপত্র যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী যেমন হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৯৩,৭১০২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৬০; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫

তবে এক্ষেত্রে মনে রাখাতে হবে যে, যেসব বস্তুর উপর যাকাত আসে না সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে তাহলে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও যাকাত ফরয হবে।

২০. পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে যাকাত ফরয হবে না। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬৫

২১. দোকান-পাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসাপণ্য নয়, তার ওপর যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য তাই এসবের ওপর যাকাত ফরয হবে।

২২. ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে তার ওপর মাসআলা নং ৬ প্রযোজ্য হবে।

২৩. ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালা-বাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও যাকাত ফরয নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের উপর যাকাত আসবে।

ঋণ ও পাওনা প্রসঙ্গ
২৪. কারো ঋণ যদি এত হয় যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয নয়। -মুয়াত্তা মালেক ১০৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০০৩, ৭০৮৬, ৭০৮৯, ৭০৯০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪৭-৫৪৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/৮৩

কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে যে, এই প্রসিদ্ধ মাসআলাটি সকল ঋণের ক্ষেত্রে নয়। ঋণ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ক. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। খ. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়।

প্রথম প্রকারের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে যাকাতের নিসাব বাকি থাকে কিনা তার হিসাব করতে হবে। নিসাব থাকলে যাকাত ফরয হবে, অন্যথায় নয়। কিন্তু যে সকল ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয় যেমন কারখানা বানানো, কিংবা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে যাকাতের হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না। অর্থাৎ এ ধরনের ঋণের কারণে যাকাত কম দেওয়া যাবে না। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৮৭

২৫. বিয়ে-শাদিতে মোহরানার যে অংশ বাকি থাকে তা স্বামীর কাছে স্ত্রীর পাওনা। কিন্তু এই পাওনা স্বামীর ওপর যাকাত ফরয হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ যাকাতযোগ্য সম্পদের হিসাবের সময় এই ঋণ বাদ দেওয়া যাবে না; বরং সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬১

উল্লেখ্য যে, বিনা ওযরে মোহরানা আদায়ে বিলম্ব করা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

২৬. অন্যকে যে টাকা কর্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে বা ব্যবসায়ী কোনো পণ্য বাকিতে বিক্রয় করেছে এই পাওনা টাকা পৃথকভাবে বা অন্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে মিলিতভাবে নিসাব পূর্ণ করলে তারও যাকাত দিতে হবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১১১-৭১১৩,৭১২১,৭১২৩,৭১২৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৮৪-৪৮৬

২৭. পাওনা উসূল হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত আদায় করা ফরয হয়। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৪৭, ১০৩৫৬

২৮. উপরোক্ত ক্ষেত্রে পাওনা উসূল হতে যদি কয়েক বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যায় তাহলে উসুল হওয়ার পর বিগত সকল বছরের যাকাত আদায় করা ফরয হয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১১৬,৭১২৯,৭১৩১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৪৬,১০৩৫৬

২৯. স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নিসাব পরিমাণ হলেও তা স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে যাকাত ফরয হয় না। হস্তগত হওয়ার পর যদি আগে থেকেই ঐ মহিলার কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ না থাকে তাহলে এখন থেকে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে।

৩০. আর যদি স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার আগ থেকেই নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদের মালিক থেকে থাকে তাহলে এই সদ্যপ্রাপ্ত মোহরানা অন্যান্য টাকা-পয়সা বা সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং সেই সব পুরানো সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে।


কীভাবে যাকাত দিতে হবে
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা তার অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন-
وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰی رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَۙ۝۶۰
আর তারা যা কিছু দান করে এভাবে দান করে যে, তাদের হৃদয় ভীতকম্পিত থাকে (একথা ভেবে) যে, তারা তাদের রবের নিকটে ফিরে যাবে।’ -সূরা মুমিনূন : ৬০

এক আয়াতে মু’মিনদের সম্বোধন করে বলেন-
وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ فَلِاَنْفُسِكُمْ ؕ وَ مَا تُنْفِقُوْنَ اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ اللّٰهِ ؕ وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ یُّوَفَّ اِلَیْكُمْ وَ اَنْتُمْ لَا تُظْلَمُوْنَ۝۲۷۲
… এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই ব্যয় করে থাক। যে ধনসম্পদ তোমরা ব্যয় কর তার পুরস্কার তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবে প্রদান করা হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না। -সূরা বাকারা : ২৭২

অন্য এক আয়াতে ঈমানদারদের সতর্ক করা হয়েছে তারা যেন অসংযত আচরণের মাধ্যমে তাদের দান-সদকাকে ব্যর্থ না করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی ۙ كَالَّذِیْ یُنْفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকাকে বিনষ্ট করো না। ওই লোকের মতো যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর ঈমান রাখে না আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর।-সূরা বাকারা : ২৬৪

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
واحسنوا ان الله يحب المحسنين
কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিনয়, খোদাভীতি, ইখলাস ও আখলাকে হাসানা হল দান-সদকা আল্লাহর দরবারে মকবুল হওয়ার অভ্যন্তরীণ শর্ত। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়মতো যাকাত আদায় করে দেওয়া কর্তব্য।

৩১. বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যাকাত আদায়ে বিলম্ব করা যায় না। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنِیْۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیْبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ اَكُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ۝۱۰
আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। অন্যথায় মৃত্যু এল সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছু কালের অবকাশ কেন দিলে না! তাহলে আমি সদাকা করতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’-সূরা মুনাফিকূন : ১০

এক্ষেত্রে করণীয় হল, নিসাবের মালিক হওয়ার সময়টি সামনে রাখা এবং ঠিক তার এক বছর পর সেই সময়েই যাকাত আদায় করা। নির্দিষ্ট সময়টি জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো মাসের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়।

৩২. যে দিন এক বছর পূর্ণ হবে সেদিনই যাকাত আদায় করা ফরয হয়। এরপর যখনই যাকাত আদায় করুক সে পরিমাণই আদায় করতে হবে যা সেই দিন ফরয হয়েছিল। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৫৯

৩৩. বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ধর্তব্য, সৌর বর্ষের নয়।

যাকাতের নিয়ত করা
৩৪. যাকাত আদায় হওয়ার জন্য যাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি। -রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮

৩৫. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই যাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে যাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।-সূরা বাক্বারা ২৬৪

যাকাতের উপযুক্ত খাতে যেমন ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে। এটাই মূল নিয়ম। তবে নিজের সম্পদ থেকে যাকাতের টাকা পৃথক করে রাখলে পৃথক করার সময়ের নিয়তই যথেষ্ট হবে। এখান থেকে ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার সময় নতুন নিয়ত না করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।-রদ্দুল মুহতার ২/২৬৮

৩৬. যাকাতের উদ্দেশ্যে টাকা পৃথক করে রাখলেও মালিক তা প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে। তবে পরে যাকাত আদায়ের সময় যাকাতের নিয়ত করতে হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৩৯১, ১০৩৯২

৩৭. যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কিছু টাকা দান করা হয়েছে, কিন্তু দান করার সময় দানকারীর মনে যাকাতের নিয়ত ছিল না তো গ্রহীতার কাছে সেই টাকা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত আদায় হবে। তদ্রূপ যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো খাদ্যদ্রব্য প্রদান করা হলে গ্রহীতা তা খেয়ে ফেলার বা বিক্রি করে দেওয়ার আগে যাকাতের নিয়ত করলেও যাকাত আদায় হবে। এরপরে যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত হিসাবে আদায় হবে না।-আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৮; রদ্দুল মুহতার ২/২৬৮-২৬৯

৩৮. যাকাতের টাকা আলাদা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ফকীর-মিসকীনকে দেওয়ার আগেই তা চুরি হয়ে গেল বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেল তাহলে যাকাত আদায় হয়নি। পুনরায় যাকাত দিতে হবে।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৩৬,৬৯৩৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৩১-৫৩২; রদ্দুল মুহতার ২/২৭০

৩৯. যে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়েছে তার চল্লিশ ভাগের একভাগ (২.৫০%) যাকাত দেওয়া ফরয। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে। -সুনানে নাসায়ী হাদীস ২২৩০-২২৩৩; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ১৫৭০-১৫৭২; সুনানে তিরমিযী হাদীস ৬২৩; সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস ১৮০৩ ; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৩৩-৭১৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৩৯-১০৫৮১

৪০. যে পরিমাণ যাকাত ফরয হয় স্বেচ্ছায় তার চেয়ে বেশি দিয়ে দিলেও অসুবিধা নেই। এতে যাকাত আদায় এবং বাড়তি দান দু’টোরই ছওয়াব পাওয়া যাবে।- মুসনাদে আহমদ হাদীস ২০৭৭; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯০৭

৪১. যাকাত গ্রহণকারীকে একথা জানানোর প্রয়োজন নেই যে, তাকে যাকাত দেওয়া হচ্ছে। যেকোনোভাবে দরিদ্র ব্যক্তিকে যাকাতের মাল দেওয়া হলে মালিক যদি মনে মনে যাকাতের নিয়ত করে তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।-রদ্দুল মুহতার ২/২৬৮

৪২. অন্যের পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে যাকাত আদায় হবে না। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬৯

৪৩. গৃহকর্তা যদি ঘরের লোকদেরকে যাকাত দেওয়ার অনুমতি দিয়ে রাখেন তাহলে তারা যাকাতের নিয়তে কাউকে কিছু দিলে তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে । আর যদি পূর্বাগ্রে অনুমতি না দেওয়া থাকে আর ঘরের লোকেরা যাকাত হিসেবে কিছু দান করে তাহলে যাকে দান করা হল সে সেই অর্থ খরচ করার আগেই যদি গৃহকর্তা অনুমতি পাওয়া যায় তাহলেও তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে। অন্যথায় যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে।

৪৪. কোনো দরিদ্র ব্যক্তির কাছে কারো কিছু টাকা পাওনা আছে। এখন সে যদি যাকাতের নিয়তে পাওনা মাফ করে দেয় তাহলে যাকাত আদায় হবে না। তাকে যাকাত দিতে হলে নিয়ম হল, প্রথমে তাকে যাকাত প্রদান করা এরপর সেখান থেকে ঋণ উসূল করে নেওয়া।-আদ্দুররুল মুখতার ২/২৭০; রদ্দুল মুহতার ২/২৭১

ঋণগ্রস্তকেই যাকাতের টাকা প্রদান করা উত্তম। কেননা এতে তাকে ঋণের দায় থেকে মুক্ত করা হয়। আর কোনো সচ্ছল ব্যক্তি যদি যাকাত থেকে গণ্য করা নিয়ত ছাড়াই ঋণগ্রহীতার ঋণ ক্ষমা করে দেয় তবে তো কথাই নেই।-রদ্দুল মুহতার ২/২৭১


যাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে
কুরআন মজীদে যাকাতের খাত নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। এ খাত ছাড়া অন্য কোথাও যাকাত প্রদান করা জায়েয নয়। ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْعٰمِلِیْنَ عَلَیْهَا وَ الْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الْغٰرِمِیْنَ وَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ ؕ فَرِیْضَةً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ۝۶۰
যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।-সূরা তাওবা : ৬০

৪৫. যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে, অথবা কিছুই নেই, এমনকি একদিনের খোরাকীও নেই এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরীব। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।

৪৬. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ আছে সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

৪৭. অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ যাতে যাকাত আসে না যেমন ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নিসাব পরিমাণ আছে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৫৬ এই ব্যক্তির উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।

৪৮. যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদও নিসাব পরিমাণ নেই এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য ধরনের মাল-সামানাও নিসাব পরিমাণ নেই এই ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাদীস ১০৫৩৬

৪৯. যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।

৫০. কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা মাল-সামান চুরি হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েয, এর বেশি নয়।

৫১. যাকাতের টাকা এমন দরিদ্রকে দেওয়া উত্তম যে দ্বীনদার। দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি যাকাতের উপযুক্ত হয় তাহলে তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে। কিন্তু যদি প্রবল ধারণা হয় যে, যাকাতের টাকা দেওয়া হলে লোকটি সে টাকা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।

৫২. যাকাত শুধু মুসলমানদেরকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না। তবে নফল দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৬৬,৭১৬৭, ৭১৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫১৬-৫১৭

৫৩. যাকাতের টাকা যাকাতের হক্বদারদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুৎ-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

৫৪. যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়।

মোটকথা, যাকাতের টাকা এর হক্বদারকেই দিতে হবে। অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও যাকাত আদায় হবে না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৪৭,৬৯৪৮, ৭১৩৭,৭১৭০

৫৫. যাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হল, উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া। যাতে সে নিজের খুশি মতো তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি যাকাতদাতা নিজের খুশি মতো দরিদ্র লোকটির কোনো প্রয়োজনে টাকাটি খরচ করে যেমন, তার ঘর সংস্কার করে দিল, টয়লেট স্থাপন করে দিল কিংবা পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করল তাহলে যাকাত আদায় হবে না।-রদ্দুল মুহতার ২/২৫৭

নিয়ম হল, যাকাতের টাকা দরিদ্র ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেওয়া। এরপর যদি সে নিজের খুশি মতো এসব কাজেই ব্যয় করে তাহলেও যাকাতদাতার যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

৫৬. আত্মীয়-স্বজন যদি যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয় তাহলে তাদেরকে যাকাত দেওয়াই উত্তম। ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগনে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং অন্যান্য আত্মীয়দেরকে যাকাত দেওয়া যাবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৬০,৭১৬১,৭১৬৪,৭১৭১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪২-৫৪৬

দেওয়ার সময় যাকাতের উল্লেখ না করে মনে মনে যাকাতের নিয়ত করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটাই উত্তম।

৫৭. নিজ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যারা তার জন্মের উৎস তাদেরকে নিজের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতিন এবং তাদের অধস্তনকে নিজ সম্পদের যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।-রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮

৫৮. বাড়ির কাজের ছেলে বা কাজের মেয়েকে যাকাত দেওয়া জায়েয যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের অর্থ দিলে যাকাত আদায় হবে না। কেউ কেউ কাজের লোক রাখার সময় বলে, মাসে এত টাকা করে পাবে আর ঈদে একটা বড় অংক পাবে। এক্ষেত্রে ঈদের সময় দেওয়া টাকা যাকাত হিসাবে প্রদান করা যাবে না। সেটা তার পারিশ্রমিকের অংশ বলেই ধর্তব্য হবে।

৫৯. কোনো লোককে যাকাতের উপযুক্ত মনে হওয়ায় তাকে যাকাত দেওয়া হল, কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পেল যে, লোকটির নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাহলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দিতে হবে না। তবে যাকে যাকাত দেওয়া হয়েছে সে যদি জানতে পারে যে, এটা যাকাতের টাকা ছিল সেক্ষেত্রে তার ওপর তা ফেরত দেওয়া ওয়াজিব।

৬০. যাকাত দেওয়ার পর যদি জানা যায় যে, যাকাত-গ্রহীতা অমুসলিম ছিল তাহলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় যাকাত দিতে হবে।

৬১. অপ্রাপ্তবয়স্ক (বুঝমান) ছেলে-মেয়েকে যাকাত দেওয়া যায়।-রদ্দুল মুহতার ২/২৫৭; আলবাহরুর রায়েক ২/২০১



সদকাতুল ফিতরে গুরুত্ব

রবিবার, ডিসেম্বর ০১, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
সদকাতুল ফিতরে গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের শেষে একটি বিধান দিয়েছেন। অর্থাৎ ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে ‘সদকাতুল ফিতর’ আদায় করা। আজকের মজলিসে এ বিষয়ে কথা বলব। এর বিধান, উপকারীতা, শ্রেণী, পরিমাণ, অপরিহার্যতা, আদায় করার সময় ও স্থান সম্পর্কে আলোচনা করব।
সদকাতুল ফিতর আবশ্যক হওয়ার ওয়াক্ত রমজানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পরবর্তী সময় নির্ধারণ করার কারণ হচ্ছে, তখন থেকে ফিতর তথা খাওয়ার মাধ্যমে রমজানের সিয়াম সমাপ্ত হয়। এ কারণেই একে রমজনের সদকাতুল ফিতর বা সিয়াম খোলার ফিতর বলা হয়। বুঝা গেল, ফিতর তথা সিয়াম শেষ হওয়ার সময়টাই সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়। [ হানাফী মাজহাবে ঈদের দিনের সুবহে সাদিকের সময় সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়। ]
সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময় দু’ধরণের:

১. ফজিলতপূর্ণ সময় ও
২. ওয়াক্ত জাওয়াজ বা সাধারণ সময়


১. ফজিলতপূর্ণ সময় : ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাতের পূর্বে। বুখারীতে বর্ণিত, আবূ সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সদকাতুল ফিতর হিসেবে ঈদুল ফিতরের দিন এক সা’ পরিমাণ খাদ্য আদায় করতাম। ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের ঈদের সালাত পড়তে যাওয়ার পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দিয়েছে।

ইবনে উয়াইনা স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে আমর বিন দীনারের সূত্রে ইকরামা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, মানুষ ঈদের দিন সদকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করবে।


আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: “নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় এবং তার পালনকর্তার নাম স্বরণ করে, অতঃপর সালাত আদায় করে।” [ আলা ৮৭ : ১৪-১৫ ]
সুতরাং ঈদুল ফিতরের সালাত একটু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যাতে মানুষ সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে।

২. জায়েজ সময়: ঈদের একদিন দু’দিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করা।
বুখারীতে আছে, নাফে রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু নিজের এবং ছোট-বড় সন্তানদের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন, এমনকি আমার সন্তানদের পক্ষ হতেও। তিনি জাকাতের হকদারদের ঈদের একদিন বা দুদিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর দিতেন। ঈদের সালাতের পর আদায় করা জায়েজ নেই। অতএব, বিনা কারণে সালাতের পর বিলম্ব করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের পরিপন্থী। পূর্বে ইবনে আববাস রাদিআল্লাহু আনহু এর হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে, যে ব্যক্তি সদকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করবে, তার দান সদকাতুল ফিতর হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে, তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হিসেবে গণ্য হবে।[ আবু দাউদ, ইবনে মাজা ]

যদি কোন কারণ বশত বিলম্ব করে, তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যেমন সে এমন স্থানে আছে যে, তার নিকট আদায় করার মত কোন বস্তু নেই বা এমন কোন ব্যক্তিও নেই, যে এর হকদার হবে। অথবা হঠাৎ তার নিকট ঈদের সালাতের সংবাদ পৌঁছল, যে কারণে সে সালাতের পূর্বে আদায় করার সুযোগ পেল না। অথবা সে কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছিল, যে তা আদায় করতে ভুলে গেছে। এমতাবস্থায় সালাতের পর আদায় করলে কোন অসুবিধা নেই। কারণ সে অপারগ।


ওয়াজিব হচ্ছে, সদকাতুল ফিতর তার প্রাপকের হাতে সরাসরি বা উকিলের মাধ্যমে যথাসময়ে সালাতের পূর্বে পৌঁছানো। যদি নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে প্রদানের নিয়ত করে, অথচ তার সঙ্গে বা তার নিকট পৌঁছতে পারে এমন কারো সঙ্গে সাক্ষাত না হয়, তাহলে অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করবে, বিলম্ব করবে না।

সদকাতুল ফিতর প্রদানের স্থান:
সদকাতুল ফিতর প্রদানের সময় যে এলাকায় সে অবস্থান করছে ঐ এলাকার গরীবরাই বেশী হকদার। উক্ত এলাকায় সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কিন্তু যদি তার বসতি এলাকায় কোন হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে। সে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার সদকাতুল ফিতর আদায় করে দিবে ।
সদকাতুল ফিতরের হকদার:

সদকাতুল ফিতর হকদার হচেছ:
(১) দরিদ্র
(২) ঋণ আদায়ে অক্ষম
(৩) ঋণগ্রস্ত, তাকে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে।


এক সদকাতুল ফিতর অনেক ফকীরকে দেয়া যাবে এবং অনেক সদকাতুল ফিতর এক মিসকিনকেও দেয়া যাবে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু হকদারকে কি পরিমাণ দিতে হবে তা নির্ধারণ করেননি। সুতরাং যদি অনেক ব্যক্তি তাদের সদকাতুল ফিতর ওজন করার পর একটি পাত্রে জমা করে এবং সেখান থেকে তা পুনরায় পরিমাপ ছাড়া বণ্টন করে, তবে তা বৈধ হবে। কিন্তু ফকীরকে জানিয়ে দেয়া উচিৎ। তাকে তারা যা দিচ্ছে তার পরিমাণ তারা জানে না। ফকীরের জন্য বৈধ, কারো থেকে সদকাতুল ফিতর গ্রহণের পর নিজের পক্ষ থেকে বা পরিবারের অন্য সদস্যের পক্ষ থেকে দাতার কথায় বিশ্বাস করে পরিমাপ ছাড়াই কাউকে কিছু দেয়া।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি অনুযায়ী আনুগত্য করার তওফিক দিন। আমাদের আত্মা, কথা ও কাজ শুদ্ধ করে দিন। আমাদেরকে বিশ্বাস, কথা ও কাজের ভ্রষ্টতা থেকে পবিত্র করুন। নিশ্চয়ই আপনি উত্তম দানশীল ও করুনাময়। হে আল্লাহ! আখেরী নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এবং তার সকল পরিবার ও সাহাবাগণের উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন। আ
মীন
 
সদকাতুল ফিতরের বিধান:
সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মুসলিমদের উপর আবশ্যক করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আদেশ করেছেন তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আদেশ করার সমতুল্য।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: “যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হুকুম মান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই মান্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।“[ সুরা নিসা ৪: ৮০ ]

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: “যে কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং মুমিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকে ফিরাব যে দিকে সে ফিরতে চায় এবং আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। তা নিকৃষ্টতম গন্তব্যস্থল।” [ নিসা ৪ : ১১৫ ]

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: “আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল তোমাদের যা আদেশ করেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক।” [ হাশর ৫৯ : ৭ ]

সাদকাতুল ফিতর মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, আজাদ-গোলাম সকলের উপর ওয়াজিব। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে আজাদ, গোলাম, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের উপর এক সা’ খেজুর, বা এক সা’ যব সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। পেটের বাচ্চার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর দেয়া ওয়াজিব নয়, কিন্তু কেউ যদি আদায় করে, তাহলে নফল সদকা হিসেবে আদায় হবে। ওসমান রাদিআল্লাহু আনহু পেটের বাচ্চার পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করতেন। ফিতরা নিজের পক্ষ থেকে এবং নিজের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে আদায় করবে। যেমন স্ত্রী ও সন্তান। যদি তাদের নিজস্ব সম্পদ থাকে তবে তাদের সম্পদ থেকেই সদকাতুল ফিতর আদায় করবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন: “তোমরা সাধ্য অনুপাতে আল্লাহকে ভয় কর।” [  তাগাবুন ৬৪ : ১৬ ]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমি যখন তোমাদের কোন বিষয়ে আদেশ করি, তোমরা তা সাধ্যানুযায়ী পালন কর।” [ বুখারী ও মুসলিম ]

সদকাতুল ফিতরের উপকারিতা :
১. দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হয়
২. ঈদের দিনগুলোতে দরিদ্র ব্যক্তিরা ধনীদের ন্যায় স্বচ্ছলতা বোধ করে
৩. সদকাতুল ফিতরের ফলে ধনী-গরীব সবার জন্য ঈদ আনন্দদায়ক হয়
৪. সদকাতুল ফিতর আদায়কারী দানশীল হিসেবে পরিগণিত হয়
৫. সদকাতুল ফিতরের মাধ্যমে সিয়াম অবস্থায় ঘটে যাওয়া ক্রটিগুলোর কাফ্ফারা করা হয়
৬. সদকাতুল ফিতর দ্বারা আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হয়। তিনি নিজ অনুগ্রহে বান্দাকে পূর্ণ একমাস সিয়াম পালনের তওফিক দিয়েছেন, সাথে সাথে সদকাতুল ফিতিরের ন্যায় আরেকটি ভাল কাজের তওফিক দান করলেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন অশ্লীল ও অনর্থক কথা-বার্তার কারণে সিয়ামে ঘটে যাওয়া ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করার জন্য ও মিসকিনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলে তা সদাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হিসেবে গন্য হবে।” [ আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ ]

যে সব জিনিস দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়:
মানুষের সাধারণ খাবার জাতীয় বস্ত্ত দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়। যেমন, খেজুর, গম, চাল, পনির, ঘি ইত্যাদি।

বুখারী ও মুসলিমে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিত্র খেজুর অথবা যব দ্বারা আদায় করতে বলেছেন। যবের ক্ষেত্রে দুই দিনের খাবারের সমপরিমণ  যব প্রদান করা।

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে আমরা খাবার জাতীয় জিনিস দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম। সে সময় আমাদের সবার খাবার ছিল পনির, ঘি এবং খেজুর।” [ বুখারী ]


“মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর খাদ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় হবে না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ফরজ করেছেন মিসকিনদের খাদ্যের অভাব পূরণ করার জন্য, কোন প্রাণীর খাদ্যাভাব পুরণের জন্য নয়। এমনকি কাপড়, বিছানা, পান পাত্র ইত্যাদি দ্বারাও আদায় হবে না। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকায়ে ফিতর খাদ্যের মাধ্যমে আদায় করা ফরজ করেছেন।” [ হানাফি মাজহাবের ওলামায়ে কেরামের মত অনুসারে মূল্য দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করলে, সদকায়ে ফিতর আদায় হয়ে যাবে। ]

খাদ্যমূল্য দ্বারা আদায় করলেও আদায় হবে না। যেহেতু এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের বিপরীত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের  নির্দেশ নেই, তা পরিত্যাজ্য।’

অন্য এক বর্ণনায় আছে, “যে আমাদের ধর্মে এমন জিনিস সৃষ্টি করল, যা আমাদের ধর্মে নেই, তা পরিত্যাজ্য।” [ মুসলিম ] তাছাড়া খাদ্যমূল্য প্রদান করা সাহাবাদের আমলের পরিপন্থী। কারণ, তারা খাদ্যজাতীয় বস্তু দ্বারাই সদকাতুল ফিত্র আদায় করতেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আমার সুন্নত এবং আমার পরবর্তীতে সঠিক পথে পরিচালিত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত আকড়ে ধর। সদকাতুল ফিতর নির্দিষ্ট একটি এবাদত, তাই অনির্দিষ্ট বস্ত্ত দ্বারা আদায় করলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যেমন নির্দিষ্ট সময় ছাড়া আদায় করলে আদায় হয় না।

যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। আর প্রত্যেক খাদ্য দ্রব্যের মূল্য সমান নয়। সুতরাং মূল্যই যদি ধর্তব্য হয়, তাহলে নির্দিষ্ট কোন এক প্রকারের এক সা’ হত এবং তার বিপরীত বস্ত্ত দ্বারা ভিন্ন মূল্যের হত। দ্বিতীয়ত মূল্য প্রদানের দ্বারা সদকাতুল ফিতর প্রকাশ্য এবাদতের রূপ হারিয়ে গোপন এবাদতের রূপ পরিগ্রহণ করে, তাই এটা পরিহার করাই বাঞ্চনীয়। এক সা’ খাদ্য সবার দৃষ্টি গোচর হয়,  কিন্তু মূল্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে
সক্ষম হয় না।

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ:
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ  : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের এক সা’। যার ওজন চার শত আশি মিসকাল গম। ইংরেজী ওজনে যা দুই কেজি ৪০ গ্রাম গম। যেহেতু এক মিসকাল সমান চার গ্রাম ও এক চতুর্থাংশ হয়। সুতরাং ৪৮০ মিসকাল সমান ২০৪০ গ্রাম হয়। অতএব রাসূলের যুগের সা’ জানতে ইচ্ছা করলে, তাকে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম গম ওজন করে এমন পাত্রে রাখতে হবে, যা মুখ পর্যন্ত ভরে যাবে। অতঃপর তা পরিমাপ করতে হবে।

সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ায় সময়:
ঈদের রাতে সূর্যাস্তের সময় জীবিত থাকলে তার উপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক, নতুবা নয়। সুতরাং কেউ সূর্যাস্তের এক মিনিট পূর্বে মারা গেলে তার উপর ওয়াজিব হবে না। এক মিনিট পরে মারা গেলে অবশ্যই তার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে। যদি কোন শিশু সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পর ভূমিষ্ট হয়, তার উপরও আবশ্যক হবে না, তবে আদায় করা সুন্নত। যার আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে। আর সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পূর্বে ভুমিষ্ট হলে তার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে।




মুসলিম উম্মার আচার-আচরণে সততা ও সত্যবাদিতার প্রতিষ্ঠা ও মিথ্যা পরিত্যাগ

রবিবার, ডিসেম্বর ০১, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে



পাঠ সংক্ষেপ 
খুতবার উদ্দেশ্য : ১-মুসলিম উম্মার আচার-আচরণে সততা ও সত্যবাদিতার প্রতিষ্ঠা, ২-মিথ্যা থেকে হুঁশিয়ার করা, ৩-মানুষের মাঝে আস্থা বীজবপন করা।
প্রথম খুৎবা
الْحَمْدُ لِلَّهِ نَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا، مِنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، أَرْسَلَهُ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ، مَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ رَشَدَ، وَمَنْ يَعْصِهِمَا فَإِنَّهُ لَا يَضُرُّ إِلَّا نَفْسَهُ وَلَا يَضُرُّ اللهَ شَيْئًا، اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيِنِ، أَمَّا بَعْدُ :

মুহতারাম মুসল্লীবৃন্দ! সত্য কথা বলা ও সৎভাবে জীবনযাপন করা মহৎ মানুষের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য। মিথ্যা কথা বলা ও অসৎ জীবন যাপন করা অসৎ মানুষের লক্ষণ। সত্যবাদিতা হলো ঈমানের পূর্ণতাদানকারী একটি মহৎ গুণ। ইসলামের দাবি হলো সততানির্ভর জীবন, যে জীবনে থাকে না কোনো অসত্যের চিহ্ন। সত্যবাদিতা নির্ভেজাল ও নির্মল ঈমানের জন্ম দেয় এবং সত্যবাদী ব্যক্তিরাই প্রকৃত অর্থে দুনিয়া-আখিরাতে সফলকাম হয়ে থাকে। সত্যবাদী-সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তিরাই আল্লাহর ওপর যথোপযুক্ত তাওয়াক্কুল ও ভরসা রাখে দুর্যোগ ও দুর্ভোগের সময় ধৈর্যের পরিচয় দেয় স্বচ্ছলতার সময় ঐকান্তিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। সত্যবাদীরাই কল্যাণকর কাজে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং অকল্যাণকর কাজে তারা হয় প্রতিবাদী-বিদ্রোহী। এ সব কারণেই আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতি ও সত্যবাদী লোকদের সংস্রব অবলম্বন করার জোর নির্দেশ দিয়েছেন।
 ইরশাদ হয়েছে :
{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ}
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (সূরা আত-তাওবা : ১১৯)।

সাদেকীন অর্থ যারা বোধ ও বিশ্বাসে সত্যবাদী, কাজে-কর্মে সত্যবাদী এবং লেনদেন, বেচাকেনাসহ সকল ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী। মুসলিম উম্মাহর সকল সদস্যের জন্য এটা আবশ্যক যে তারা জীবন চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যকে ফুটিয়ে তুলবে। সত্যের চর্চা ও অনুশীলকে সার্বক্ষণিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে। সত্যবাদিতা ধরে রাখতে গিয়ে যদি আর্থিক ক্ষতিও সহ্য করতে হয় তবু তারা সত্যকে ধরে রাখবে। আর এভাবেই তরা সক্ষম হবে আল্লাহর পক্ষ হতে অফুরান বরকত লাভের। যেমন হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
(الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا، أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا، فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا، بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا، مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا)

‘ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই (ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া নাকচ করার) ইখতিয়ার রাখে যতক্ষণ না তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা যদি সত্য বলে এবং ক্রটি-বিচ্যুতি বলে দেয়, তাহলে উভয়ের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দেয়া হয়। আর যদি তারা মিথ্যা বলে এবং পণ্যের দোষ লুকিয়ে রাখে তাহলে তাদের বেচাকেনার বরকত ধ্বংস করে দেয়া হয়’ (মুসলিম)।

সততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। সত্যবাদী ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে :
{هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا}

‘ আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকার করবে। তাদের জন্য জান্নাতে রয়েছে যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নদী। তারা তাতেই থাকবে চিরকাল’ (সূরা আল মায়েদা : ১১৯)।

অর্থাৎ পার্থিব জগতে তাদের সততা পারলৌকিক জীবনে উপকারী হবে। বিচার দিবসে আল্লাহর ভয়াবহ শাস্তি থেকে সত্যবাদিতাই তাদেরকে বাঁচিয়ে দেবে। ইরশাদ হয়েছে :

{وَبَشِّرِ الَّذِينَ آَمَنُوا أَنَّ لَهُمْ قَدَمَ صِدْقٍ عِنْدَ رَبِّهِمْ}
‘এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর যে, তাদের রবের নিকট তাদের জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা’ (ইউনুস : ২)।

যারা সত্যকে ধারণ করে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নেয় তাদেরকে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে:
{وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ}
‘আর যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং যে তা সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই হলো মুত্তাকী’ (যুমার : ৩৩)।

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, শুধু নিজে নিজে সত্যবাদী হলেই চলবে না বরং যারা সত্যবাদী তাদেরকে সত্যবাদী বলে সত্যায়ন করাও জরুরী। কারণ অনেকেই অহংকারবশত বা হিংসার বশবর্তী হয়ে সত্যবাদীকে সত্যায়ন করতে অস্বীকার করে।

সত্যবাদিতা এমন মহৎ গুণ যে আল্লাহ তাআলা নিজেই এ গুণে গুণান্বিত বলে উলে¬খ করেছেন। সত্যবাদিতা হলো আল্লাহর গুণ। ইরশাদ হয়েছে :
{قُلْ صَدَقَ اللَّهُ}
‘বল, ‘আল্লাহ সত্য বলেছেন’ (আল ইমরান: ৯৫)।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :
{وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا}
‘আর কথায় আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী কে’? (নিসা : ৮৭)।

আমাদের একটি ভুল ধারণা এই যে সত্যবাদিতা শুধু কথার জগতে সীমিত। পক্ষান্তরে সত্যবাদিতার ক্ষেত্র সুদূরবিস্তৃত। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, সত্যবাদিতা মৌলিকভাবে তিন প্রকার-

এক. কথার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা। অথাৎ মানুষের জিহ্বা সত্যবাদিতা শেকড়ে সুদৃঢ়ভাবে স্থির থাকবে যেভাবে স্থির থাকে ধানের শীষ ধান গাছে।

দুই. কর্মের ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা : অর্থাৎ ব্যক্তির আমল ও কর্ম স্থির থাকবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এঁকে দেয়া সীমানার ভেতর যেমন স্থির থাকে মাথা শরীরের ওপরের অংশে।

তিন. সার্বিক অবস্থার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা। অর্থাৎ অন্তরের আমল ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল ইখলাসের ভিত্তিমূলে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এই তিন প্রকারের সত্যবাদিতায় নিজকে দাঁড় করাতে পারলেই বলা সঙ্গত হবে যে কোনো ব্যক্তি সিদ্ক বা সততা-সত্যবাদিতা নিয়ে এসেছে বা সত্যবাদিতার গুণে যথার্থভাবে গুণান্বিত হয়েছে। আর এই তিন প্রকারের সত্যবাদিতায় ব্যক্তি যতই অগ্রসর হবে তার সিদ্দীকিয়াতের মাত্রাও ততো বেড়ে যাবে। আবু বকর সিদ্দীক রাযি. এর সিদ্দীকিয়াতের সর্বোচ্চ শেখরে অধিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে এই তিন প্রকারের সত্যবাদিতায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের উৎকর্ষ সাধনই কারণ ছিল। এ তিন প্রকারের সত্যবাদিতার সারমর্ম হলো নিম্নরূপ-

কথার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতার অর্থ- সকল প্রকার মিথ্যা থেকে নিজের যবানকে হিফাযত করা। সদাসর্বাদ সত্য বলা এবং এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা কেননা মানুষ জিহ্বাকে ব্যবহার করে কি কি কথা বলেছে তা কিয়ামতের দিন আল¬াহ তাআলা স্বয়ং জিহ্বাকেই জিজ্ঞাসা করবেন। ইরশাদ হয়েছে :
{يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ}
‘যেদিন তাদের জিহ্বাগুলো, তাদের হাতগুলো ও তাদের পাগুলো তারা যা করত, সে ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে (সূরা আন-নূর : ২৪)।

কর্মে সত্যবাদিতা হলো ব্যক্তির অন্তর ও বহির একরকম হওয়া। ভেতরে একরকম বাইরে অন্যরকম এরূপ না হওয়া। আবদুল ওয়াহেদ ইবনে যায়েদ আল বসরী, হাসান আল বসরী রহ. সম্পর্কে বলেন, হাসান আল বসরী যখন কোনো কাজের নির্দেশ দিতেন তিনি অন্যদের তুলনায় সে কাজে অধিক আমলকারী থাকতেন। আর যদি তিনি কোনো বিষয় থেকে কাউকে বারণ করতেন তবে তিনি অন্যদের তুলনায় সে বিষয়ে অধিক দূরত্বে অবস্থান করতেন। অন্তর ও বহির সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে হাসান আল বসরীর মতো অন্য কোনো মানুষকে আমি দেখিনি’।

সার্বিক অবস্থার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের সত্যবাদিতা। যেমন ইখলাস ও ভয়, তাওবা ও আশা, যুহদ, আল্লাহ ও তার রাসূলের মহব্বত, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ইত্যাদির ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা। এ কারণে ‘আ‘মালুল কুলূব’ বা অন্তরাশ্রিত সকল আমলের মূল হলো সত্যবাদিতা। মুমিন যখন এসব অবস্থায় সত্যবাদী হয় তখন সে উঁচু পর্যায়ে চলে যায়। আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা বেড়ে যায়। 
আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :
{لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ}

‘ ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে বরং ভালো কাজ হলো যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী’ (সূরা আল বাকারা:১৭৭)।
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ
 
দ্বিতীয় খুৎবা
الْحْمْدُ لِلَّهِ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ السَّلَامِ، رَفَعَ مَنَارَ الْإِسْلَامِ، وَعَمَّ خَلْقَهُ بِالنِّعَمِ الْعِظَامِ، أَحْمَدُ رَبِّيْ وَأَشْكُرُهُ، وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ وَأَسْتَغْفِرُهُ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ ذُوْ الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ، وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا وَسَيِّدَنَا مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلَى عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ أَجْمَعِيْنَ ، أَمَّا بَعْدُ: فَاتَّقُوا اللهَ تَعَالَى وَأَطِيْعُوْهُ، وَتَقَرَّبُوْا إِلَيْهِ بِمَا يُرْضِيْهِ.

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! ইসলাম সত্যবাদিতা ও সত্যবাদীদের সম্মান করে, মর্যাদা দেয়। আর যারা মিথ্যাবাদী তাদেরকে ঘৃণা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেয়। মিথ্যা ভয়ঙ্কর খিয়ানতের আলামত নিফাক ও কপটতার আলামত। হাদীসে এসেছে :
(آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ، إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ)
‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, তার কাছে কিছু আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে’ (বুখারী)।

বরং মিথ্যা ইসলামের সাথে কখনো মিলে না, মিলতে পারে না। মুসলমানের প্রকৃতিতে কখনো মিথ্যাচারিতা থাকতে পারে না। খেয়ানত করার প্রবণতা থাকতে পারে না। ঈমান ও পৌরুষত্ব যতক্ষণ জীবিত থাকে, যতক্ষণ একজন ব্যক্তি দীনের ব্যাপারে, নিজের ইজ্জত-সম্মানের ব্যাপারে সজাগ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মিথ্যার কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সে যেতে পারে না।

মুহতারাম মুসল্লীবৃন্দ! দুঃখের বিষয় হলো আমরা যদি আজ মুসলমানদের অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখি, তা হলে এ ব্যাপারে চরম উদাসিনতা লক্ষ্য করতে পাই। এর কারণ অধিকাংশ মুসলমানের ঈমানী দুর্বলতা যা উত্তর-আধুনিকতার বর্তমান সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আজ মুসলমানদের মধ্যে পাপ-গুনাহ ছড়িয়ে পড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। মানুষের জীবনে দুনিয়া-প্রীতি বেড়ে গিয়েছে মারাত্মক আকারে। যার কারণে মানুষের কথার জগৎ থেকে সত্যবাদিতা বিদায় হয়েছে। কাজের জগৎ থেকে সত্যবাদিতা বিদায় হয়েছে। যার কারণে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে যার প্রতি শতভাগ আস্থা রাখা সম্ভব। কেননা সত্যবাদিতাই হলো আস্থার কারণ। হাদীসে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
(فَإِنَّ الصِّدْقَ طُمَأْنِينَةٌ، وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيبَةٌ)
‘নিশ্চয় সত্যবাদিতা হলো আস্থার কারণ, আর মিথ্যাবাদিতা হলো সংশয় সন্দেহের কারণ’ (তিরমিযী)।

বর্তমানে প্রচলিত মিথ্যার আকার প্রকৃতি
এক. ছোট বাচ্চাদের সাথে মাতা-পিতার মিথ্যাচারিতা। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো বাচ্চাদেরকে সত্যবাদিতার পবিত্র বলয়ে মানুষ করা। সকল প্রকার মিথ্যা থেকে তাদেরকে দূরে রাখা যাতে বাচ্চারা কথায় ও কাজে সত্যাশ্রিত হয়ে, স্পষ্টবাদী হয়ে, নির্ভীক হয়ে বড় হয়ে ওঠে। আবদুল্লাহ ইবনে আমের রাযি. বর্ণনা করেন, ‘আমার মা আমাকে একদিন ডাকলেন। আমি তখন ছোট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন আমাদের মাঝে বসা। মা আমাকে বললেন,‘এসো, আমি তোমাকে একটি জিনিস দেব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন,‘তুমি ওকে কি দিতে চেয়েছ’? মা বললেন, ‘আমি ওকে খেজুর দিতে চেয়েছি’। তিনি বললেন,‘তুমি যদি ওকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমল-নামায় একটি মিথ্যা লিখা হত’। 

আবু হুরাইরা রাযি. বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
(مَنْ قَالَ لِصَبِيٍّ: تَعَالَ هَاكَ ثُمَّ لَمْ يُعْطِهِ، فَهِيَ كِذْبَةٌ)
‘যে ব্যক্তি তার বাচ্চাকে বলল, এসো, নাও। এরপর সে তাকে কিছু দিল না, তবে তা হবে মিথ্যা’ (আহমদ, হাসান)।

আমাদের উচিত এই পূত-পবিত্র নববী আদর্শের ওপর বাচ্ছাদেরকে মানুষ করা। ইসলামী ভাবধারা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী বাচ্চাদেরকে গড়ে তোলা।

দুই. কথায় ও কাজে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া। এরূপ করা নিঃসন্দেহে কবীরা গুনাহ, বড় অন্যায়। শুধু তাই নয় বরং এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর অভিসম্পাদের উপযোগী। ইরশাদ হয়েছে :
{فَنَجْعَلْ لَعْنَةَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ}
‘মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লা’নত করি’ (সূরা আলে ইমরান:৬১)।
 
আনাস রাযি. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
(آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ، إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ)

‘মুনাফিকের আলামত তিনটি কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে খেলাফ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে’ (বুখারী ও মুসলিম)।

তিন : ওয়াদা-খলাপি প্রসার পাওয়া। উপরোল্লিখিত হাদীসে ওয়াদা-খেলাপির কথা বলা হয়েছে। আর এ ওয়াদা-খেলাপি বর্তমানে প্রকাশ্য একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এমনকি এমন অনেকেই রয়েছেন যারা ওয়াদা-খেলাপিতে খুবই প্রসিদ্ধ। তাদের নাম আসলেই বলে দেয়া যায় যে তারা ওয়াদাখেলাপ করে অভ্যস্ত। ওয়াদা-খেলাপের কিছু আকার প্রকৃতি নিম্নরূপ-

ওজর ছাড়াই ওয়াদাকৃত কোনো স্থানে বা অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হওয়া। ওয়াদাকৃত সময়ে না এসে দেরি করে আসা। উদাহরণত কোনো ব্যক্তি আপনাকে ওয়াদা দিল যে তিনি আটটার সময় আসবেন, পরে দেখা গেল তিনি আসলেন নয়টার সময়। আর এসে এই ওজর পেশ করলেন যে আসার পথে আমি একটি দোকানে ঢুকে কিছু কেনাকাটি করেছি। আর এটা খুবই দুঃখজনক যে যাদের বাহ্যিক বেশভূষা থেকে তাকওয়া পরহেযগার বলে বিশ্বাস হয়, তারও ওয়াদা ভঙ্গে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। এটা সত্যিই আফসোস ও পরিতাপের বিষয়।

চার. আমানতের খিয়ানত। বর্তমানে এমন অনেককেই দেখা যায় যারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথার্থরূপে পালন করে না। যেমন অফিসের কাজকর্মে ফাঁকি দেয়া। দেরি করে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া। কর্মে ক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়ার পর আলাপচারিত, ফোন করা ইত্যাদিতে সময় কাটিয়ে দেয়া। অসুস্থ না হয়েও অসুস্থতার ছুটি কাটানো। অথচ এমন ব্যক্তিরা মাস শেষে বেতন-ভাতা ঠিকই হাসিল করে নেয়। কর্মক্ষেত্রে এভাবে মিথ্যাচারিতার আশ্রয়ে পরিশেষে নিজের পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব করে বুঝে নেয়ার কোনো অধিকার ইসলামী শরীয়ত কাউকে দেয়নি।

পাঁচ. বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া। যেমন বিক্রেতা তার পণ্যের কোনো দোষ গোপন করে পণ্যটি বিক্রি করে দিল আর এই বলে ওজর পেশ করল যে এটা বিক্রেতার ওপর অর্পিত দায়িত্ব। অথচ বিক্রেতার উদ্দেশ্য হলো তার পণ্যটি ভালো মূল্যে বিক্রি করা। বিক্রেতা এটা ভুলে যায় যে পণ্যের দোষত্র“টি গোপন করার অর্থ হলো বেচাকেনার বরকত চলে যাওয়া। হাকীম ইবনে হিযাম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
(الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا، أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا، فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا، بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا، مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا)
‘ ক্রেতা-বিক্রেতার লেনদেন নাকচ করার অধিকার রয়েছে যতক্ষণ না তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদি তারা সত্য বলে এবং কোনো কিছু গোপন না রাখে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দেয়া হয়। আর যদি তারা গোপন করে এবং মিথ্যা বলে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত ধ্বংস করে দেয়া হয়’ (বুখারী ও মুসলিম)।

ছয়. সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য ও প্রয়োজনগ্রস্ততার দাবি করা। আবু হুরায়রা রযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
(مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا، فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا.)
‘ যে ব্যক্তি সম্পদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সাওয়াল করল সে যেন একটি তপ্ত অঙ্গার সাওয়াল করল’ (মুসলিম)।

সাত. বিবাহের পূর্বে বর ও কনে উভয়েই নিজ নিজ দোষ গোপন করা। এ দোষ চাই দৈহিক হোক অথবা চারিত্রিক। বরং এর বিপরীতের কেবল ভালো দিকগুলো প্রকাশ করা। আর তা অতিরঞ্জিত আকারে বাড়িয়ে বলা। এ বিষয়টি বিবাহের বরকতকে নস্যাৎ করে দেয়।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আমাদের যুগের ব্যবসায়ীরা অধিক পরিমাণে মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত। তারা ক্রেতাদেরকে ফাঁদে ফেলার জন্য নানা ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেয়। পণ্যের ক্ষেত্রে, দামের ক্ষেত্রে তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এর চেয়েও মারাত্মক হলো, অনেক ব্যবসায়ী মিথ্যা কসম খেতেও বিন্দুমাত্র ভায় পায় না। অথচ নবী কারীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যা কসমকে কবীরা গুনাহর মধ্যে শামিল করেছেন।

হাদীসে এসেছে, ‘কবীরা গুনাহ হলো- আল্লাহর সাথে শরীক করা, মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয়া। মানুষ হত্যা করা। কোনো জিনিসকে কেন্দ্র করে মিথ্যা কসম খাওয়া’ (বুখারী)।

ইবনে বাত্তাল রা. বলেন: ‘ইয়ামিনে গামুস এমন কসম যা কোনো বস্তুকে কেন্দ্র করে করা হয়, যদিও সে জানে যে সে মিথ্যা বলছে। আর এ ধরনের কসম খাওয়ার উদ্দেশ্য হলো কাউকে রাজি করানো অথব কানো সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। এটা এমন কসম যার কোনো কাফফারা হয় না। উপরšু— যারা পণ্য চালিয়ে দেয়ার জন্য মিথ্যা কসম খায় তাদের ব্যবসায় বরকত হয় না। কেননা বরকত তো ঠিক তখনই হয় যখন ক্রেতা-বিক্রেতা সত্যবাদিতার পরিচয় দেয়, পণ্যে দোষত্র“টি গোপন না করে সব কিছু উন্মুক্ত করে দিয়ে তবেই বিক্রি করে।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আমাদের মধ্যে যারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত তাদের উচিত হবে যাদের সাথে তারা ওঠা-বসা করে, লেনদেন করে, তাদের সবার সাথে সত্যবাদিতা বজায় রাখা, সততা বজায় রাখা। তারা যদি এরূপ করতে পারে তবে তাদের রিযক বেড়ে যাবে। ইরশাদ হয়েছে :
(وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ)
‘ আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমীন থেকে বরকতসমূহ তাদের ওপর খুলে দিতাম কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (সূরা আল আরাফ:৯৬)।

আর আল্লাহ তাআলার তাকওয়া অবলম্বন আল্লাহর পক্ষ হতে রিযক লাভের একটি নিশ্চিত মাধ্যম। ইরশাদ হয়েছে:
{وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا. وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ}
‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না’ (সূরা আত-তালাক:২-৩)।

সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা একটি মারাত্মক অপরাধ। মিথ্যা সাক্ষ্য একটি ঘৃণ্য বিষয়। আল্লাহ তাআলা এ জাতীয় কাজ ঘৃণা করেন। ইরশাদ হয়েছে:
{فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ}
‘সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর’ (সূরা আল হাজ্জ:৩০)।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :
{وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آَثِمٌ قَلْبُهُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ}
‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না এবং যে কেউ তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা আমল কর, অল্লাহ সে ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত’ (সূরা আল বাকারা: ২৮৩)।

সত্যবাদিতার ফায়দা
১-জান্নাতে লাভে ধন্য হওয়া: ‘জান্নাতের আমল কী’? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেন,‘সত্যবাদিতা’(আহমদ)। আল কুরআন অনুযায়ী কিয়ামতের দিন সত্যবাদিতাই মানুষের উপকারে আসবে, মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে নেবে। 
আল্লাহ তাআলা বলেন :
{هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ}
‘ এটা সেই দিন যেদিন সত্যবাদীগণকে তাদের সততা উপকার করবে। তাদের জন্য আছে জান্নাতসমূহ যার নীচে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী। অল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এটা মহাসাফল্য। (সূরা আল মায়েদা:১১৯)।

২-কল্যানের দরজা উন্মুক্ত হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ হতে তাওফীক আসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কা‘ব ইবনে মালেক রাযি.- তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা তিনজনের একজন- কে উদ্দেশ্য করে বলেন:.
أَمَّا هَذَا فَقَدْ صَدَقَ
‘তবে এ ব্যক্তি, সে নিশ্চয় সত্য বলেছে’ (বুখারী ও মুসলিম)।

৩-ধ্বংস থেকে বেঁচে যাওয়া ও সমস্যা-সঙ্কট দূরীভূত হওয়া। যে তিন ব্যক্তির গুহার মুখ পাথর দ্বারা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসে এসেছে:
(لَا يُنْجِيكُمْ إِلَّا الصِّدْقُ فَليَدْعُ كُلُّ رَجُلٍ مِنْكُمْ بِمَا يَعْلَمُ أَنَّهُ قَدْ صَدَقَ فِيهِ)
‘ তোমাদেরকে মুক্তি দেবে না তবে তোমাদের সততা। তাই তোমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি সে যে বিষয়ে সত্যবাদি ছিল বলে জানে তা উল্লে¬খ করে যেন দুআ করে’ (বুখারী)।

৪-অন্তরে শুদ্ধতা আসা। কেননা যে ব্যক্তি বাইরের কাজে সত্যবাদী সে অন্তরবিষয়ক আমলেও সত্যবাদী।

৫-সত্যবাদিতা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের কারণ।

 ইরশাদ হয়েছে :
{هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ}

‘এটা সেই দিন যেদনি সত্যবাদীগণকে তাদের সততা উপকার করবে’ (সূলা আল-মায়েদা:১১৯)।

৬-সত্যবাদিতা আস্থা ও প্রশান্তির কারণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
(فَإِنَّ الصِّدْقَ طُمَأْنِينَةٌ، وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيبَةٌ)

‘ নিশ্চয় সত্যবাদিতা হলো আস্থার কারণ, আর মিথ্যাবাদিতা হলো সংশয় সন্দেহের কারণ’ (তিরমিযী)।

৭- ফেতনা সত্যবাদীর কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

৮-সত্যবাদিতা সকল কল্যাণের মূল। আর মিথ্যাচার সকল গোমরাহীর মূল।

৯-মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হতে সত্যবাদীর নিষ্কৃতি। কেননা মিথ্যা বলা, হাদীস অনুযায়ী, মুনাফিকের একটি আলামত।

১০ সত্যবাদিতা সঠিক দূরদৃষ্টি অর্জনে সাহায্য করে।

তাই ভাইয়েরা আমার! আসুন আমরা সকল ক্ষেত্রে সত্যবাদী হই। সততার পরিচয় দেই। সত্যবাদীদরে সঙ্গ অবলম্বন করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন।
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সাদিকীনদের দলভুক্ত করুন। কথায়-কাজে-আচরণে আমাদের সবাইকে সততার পরিচয় দেয়ার তাওফীক দান করুন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে সত্যাশ্রয়ী হয়ে জীবনযাপনের তাওফীক দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে মিথ্যা থেকে হিফাযত করুন। কপটতা ও মুনাফিকী থেকে হিফাযত করুন। আমীন ।
عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : (إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ. 



বিদায় হজ্জের ভাষণ

রবিবার, ডিসেম্বর ০১, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
বিদায় হজ্জের ভাষণ ১০ম হিজরিতে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হজ্জ পালনকালে আরাফাতের ময়দানে ইসলাম ধর্মের শেষ রাসুল মুহাম্মাদ (স:) কর্তৃক প্রদত্ত খুৎবা বা ভাষণ। হজ্জ্বের দ্বিতীয় দিনে আরাফাতের মাঠে অবস্থানকালে অনুচ্চ জাবাল-এ-রাহমাত টিলার শীর্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি এই ভাষণ দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ (স:) জীবিতকালে এটা শেষ ভাষণ ছিলো, তাই সচরাচর এটিকে বিদায় খুৎবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।[১] ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ছিলো।
 

পরিচ্ছেদসমূহ
  •     সংরক্ষণ
  •     তাৎপর্য
  •     হাদিস সাহিত্যে ভাষণের বর্ণনা
  •     তথ্যসূত্র
  •     বহিঃসংযোগ

সংরক্ষণ
তাৎপর্যসম্পাদনা

ইসলাম ধর্ম যে ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে পূর্ণতা পেয়েছিলো, তারই চূড়ান্ত ঘোষণা ছিলো মুহাম্মাদ (স:) এর এই ভাষণ। এ কারণে সেদিন ভাষণ প্রদানকালে কুরআনের সূরা মায়িদাহ'র ৩ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিলো[৩] : “আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকারীকে সুসম্পন্ন করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।     ”

এই ভাষণে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিলো। মুসলিম জাতির সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মদ (স:) চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল উপাসনামূলক অনুশাসন ছিলো না, বরং মানবসমাজের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও এতে ছিলো। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সাম্য ইত্যাদি সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম সব বিষয়ই এই ভাষণের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এই ভাষণে তাকওয়া বা দায়িত্বনিষ্ঠতার কথা গুরুত্ব দেয়া হয়েছিলো এবং পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব বা হক্কুল্লাহ ও মানবসম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব বা হক্কুল ইবাদের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছিলো। মুহাম্মদ [স.] এই ভাষণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিদ্রোহ এবং কুপরামর্শ প্রদানকারী শয়তানদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এই ভাষণে বিভিন্ন ধরনের সুদপ্রথা রহিত করে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিলো। নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো এই ভাষণে। মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন, বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সামাজিক কুসংস্কার থেকে মানুষের মুক্তি লাভের ওপর জোর দেয়া হয়েছিলো। মুহাম্মদ [স.]-এর এই ঐতিহাসিক ভাষণে স্বর্গ-মর্তের সকল কিছুর ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিলো এবং মানুষকে এসবকিছুর আমানতদার হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর মালিকানায় সবার অধিকার স্বীকৃত বলে উত্তরাধিকার আইনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছিলো। আমানতের খেয়ানতকারীর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিলো। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব এবং বদান্যতা ও মানবতার পরম ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো।[৪]
হাদিস সাহিত্যে ভাষণের বর্ণনাসম্পাদনা


সহিহ মুসলিম[৫], তিরমিজি[৬], সুনান আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ[৭], সুনান ইবনে মাজাহ[৮] গ্রন্থে উল্লেখিত যাবির ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত বিদায় হজ্বের ভাষণের নিম্নোক্ত দীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়াও ইবনে ইসহাক ও আল জাহিজও প্রায় অপরিবর্তিতভাবে একই বর্ণনা প্রদান করেছেন।
উপস্থিত জনমণ্ডলী! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। হয়তো আমি আর কখনো এখানে তোমাদের সঙ্গে একত্রিত হতে পারব না।
 
হে জনমণ্ডলী! আজকের এই দিন (জুমার দিন), এই মাস (জিলহজ মাস) ও এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র; তোমাদের জানমাল, ইজ্জত-আবরু, মান-সম্মান কিয়ামত পর্যন্ত এমনই পবিত্র। কারো কাছে যদি কোনো আমানত রক্ষিত থাকে, তাহলে সে যেন তা আমানতকারীর কাছে পৌঁছে দেয়। আজ থেকে সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তোমাদের কেবল মূলধনের ওপর অধিকার রইল। তোমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করবে না, নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না। সর্বপ্রথম আমি হজরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ রহিত করছি। অন্ধকার যুগের সব কৌলীন্য বিলুপ্ত করা হলো। শুধু কাবাঘরের তত্ত্বাবধান ও হাজিদের পানি পান করানো ছাড়া। আজকের পর তোমাদের ভূখণ্ডে শয়তানের উপাসনার ব্যাপারে সে নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু ব্যাপার, যেগুলোকে তোমরা বড় পাপ মনেই করো না। তার অনুসরণ করলে শয়তান খুশি হবে। জনমণ্ডলী! তোমাদের নিজ স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তদ্রূপ তাদেরও তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে ভোগে লিপ্ত না হয়। যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের তাদের প্রতি কঠোরতা করার অনুমতি দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে। এবং মৃদু প্রহার করবে। তাতে তারা বিরত হলে নিয়মমাফিক তাদের ভরণপোষণের প্রতি লক্ষ রাখবে। স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। তারা তোমাদের সাহায্যকারিণী। তোমরা তাদের আল্লাহর নির্ধারিত কালিমা বাক্যের (ইজাব-কবুল) মাধ্যমে নিজেদের জন্য হালাল করেছো। সুতরাং তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো। জনমণ্ডলী! সব মুমিন পরস্পর ভাই ভাই। কারো জন্য অন্যের সম্পদ বৈধ নয়। তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয়, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেও না। পরস্পর খুনাখুনি করো না। আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে কখনো বিভ্রান্ত হবে না। তা হচ্ছে_আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কোরআন) ও তাঁর রাসুলের হাদিস। জনমণ্ডলী! তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের পিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। তোমাদের মাঝে যারা সর্বাধিক মুত্তাকি, খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। তাকওয়া ছাড়া কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। জনমণ্ডলী : আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। উত্তরাধিকারীর জন্য কোনো ওসিয়ত প্রযোজ্য নয়। অন্যদের জন্য এক-তৃতীয়াংশের অধিক ওসিয়ত করা বৈধ নয়। আমাদের কিয়ামত দিবসে জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমাদেরও জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তোমরা আমার ব্যাপারে কী বলবে? আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌছে দিয়েছি? উপস্থিত সাহাবায়েকেরাম উত্তর দিলেন, আমরা সাক্ষ্য দেব যে আপনি আপনার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন। হিত কামনা করেছেন। অতঃপর রাসুল (সা.) আকাশের দিকে হাত তুলে তিনবার বললেন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন। তারপর বললেন, তোমরা এখানে যারা উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে (কথাগুলো) পৌঁছে দেবে।

সহিহ মুসলিমের বর্ণনাটি নিম্নরূপঃ[৫]
 “হে মানব মন্ডলী!
তোমরা হৃদয়ের কর্ণে ও মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ কর। আমি জানিনা, আগামী বছর এ সময়ে, এ- স্থানে, এ-নগরীতে সম্ভবত তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ আর হবে কি না। “হে মানব সকল! সাবধান! সকল প্রকার জাহেলিয়াতকে আমার দুপায়ের নিচে পিষ্ঠ করে যাচ্ছি। নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হল। প্রথমে আমি আমার বংশের পক্ষ থেকে রবিয়া বিন হারেস বিন আবদুল মোত্তালিবের রক্তের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রে দুধ পান করেছে, হুযাইল তাকে হত্যা করেছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ’সুদ’ কে চির দিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। হে লোক সকল! বল আজ কোন দিন? সকলে বলল “আজ মহান আরাফার দিন, আজ হজ্বের বড় দিন” সাবধান! তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত তার মাল সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান আজকের দিনের মত, এই হারাম মাসের মত, এ সম্মানিত নগরীর মত পবিত্র আমানত। সাবধান! মানুষের আমানত প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে। হে মানব সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সকলের পিতা হযরত আদম (আঃ)। আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। ‘তাকওয়াই’ শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে। হে লোক সকল! পুরুষদেরকে নারী জাতীর উপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় কর। নারীদের উপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে তেমনি পুরুষদের উপর রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে নারীরা স্বামীর গৃহে ও তার সতীত্বের মধ্যে অন্য কাউকেও শরিক করবেনা, যদি কোন নারী এ ব্যপারে সীমা লংঘন করে, তবে স্বামীদেরকে এ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে যে, তারা স্ত্রীদের থেকে বিছানা আলাদা করবে ও দৈহিক শাস্তি দেবে, তবে তাদের চেহারায় আঘাত করবে না। আর নারীগণ স্বামী থেকে উত্তম ভরণ পোষণের অধিকার লাভ করবে, তোমরা তাদেরকে উপদেশ দেবে ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে। হে উপস্থিতি! মুমিনেরা পরষ্পর ভাই আর তারা সকলে মিলে এক অখন্ড মুসলিম ভ্রাতৃ সমাজ। এক ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না। তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করবেনা। হে মানুষেরা! শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথ ভ্রষ্ট করতে সমর্থ হবে না, তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সর্তক থাকবে ও তার অনুসারী হবেনা। তোমরা আল্লাহর বন্দেগী করবে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, যাকাত আদায় করবে ও তোমাদের নেতার আদেশ মেনে চলবে, তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করবে। সাবধান! তোমাদের গোলাম ও অধীনস্তদের বিষয়ে আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকেও সেভাবে পরতে দেবে। হে লোক সকল! আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলার পয়গাম পৌছে দিয়েছি? লোকেরা বলল, “হ্যা” তিনি বললেন “আমার বিষয়ে তোমাদের জিঞ্জাসা করা হবে, সে দিন তোমরা কি সাক্ষ্য দিবে, সকলে এক বাক্যে বললেন, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন, উম্মতকে সকল বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সমস্ত গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে দিয়েছেন এবং অহীর আমানত পরিপূর্ণ ভাবে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন” অত:পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ শাহাদাত আঙ্গুলি আকাশে তুলে তিনবার বললেন, “হে আল্লাহ তা’আলা আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি স্বাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন”। হে মানুষেরা! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সম্পদের মিরাস নির্দিষ্টভাবে বন্টন করে দিয়েছেন। তার থেকে কম বেশি করবেনা। সাবধান! সম্পদের তিন ভাগের এক অংশের চেয়ে অতিরিক্ত কোন অসিয়ত বৈধ নয়। সন্তান যার বিছনায় জন্ম গ্রহণ করবে, সে তারই হবে। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত। (অর্থাৎ সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা বিবাহিত দম্পতির হতে হবে। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই)। যে সন্তান আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা এবং যে দাস নিজের মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে, তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানব জাতির অভিশাপ এবং তার কোন ফরয ও নফল ইবাদত কবুল হবে না। হে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না কর। কেননা আমি আল্লাহর আযাবের মোকাবিলায় তোমাদের কোন উপকার করতে পারবো না। তোমাদের দেখেই লোকেরা আমল করে থাকবে। মনে রেখ! সকলকে একদিন আল্লাহ তা’আলার নিকট হাজির হতে হবে। সে দিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না, পরস্পর হানাহানিতে মেতে উঠবনা। আমি আখেরী নবী, আমার পরে আর কোন নবী আসবেনা। আমার সাথে অহীর পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে। হে মানুষেরা! আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। আমাকেও আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি যতদিন তোমরা এই দুটি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহর কিতাব ও অপরটি রাসূলের (সঃ) সুন্নাহ। হে মানব মন্ডলী! তোমরা আমির বা নেতার আনুগত্য করো এবং তার কথা শ্রবণ করো যদিও তিনি হন হাবশী ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তাঁর কথা শুনবে, তাঁর নির্দেশ মানবে ও তাঁর প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবে, তখন থেকে তাঁর কথাও শুনবেনা এবং তাঁর আনুগত্যও করা যাবেনা। সাবধান! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এই বাড়াবড়ির কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। (এ নির্দেশনাটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কোন বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোরজবস্তি করে ইসলামে দীক্ষা দেয়া যাবে না। তবে একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামী জীন্দেগী অবলম্বন করে জীবন যাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই)। আবার বললেন, আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌছে দিয়েছি? সকলে বললেন, “নিশ্চয়ই”। হে উপস্থিতগণ! অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ পয়গাম পৌছে দেবে। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহতের উপর তোমাদের চেয়ে বেশী গুরুত্বের সাথে আমল করবে। “তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক” বিদায়।


তথ্যসূত্রসম্পাদনা
Last Sermon of our Beloved Prophet (saw)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
The Last Sermon of the Prophet Khutbatul Wada
The Farewell Sermon[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
The Farewell Address of the Holy Prophet Muhammad PBUH
Sahih Muslim. Kitab al-Hajj. Hadith 159. Sunnah.com
Al-Tirmidhi Hadith, Number 104
Musnad Ahmad।
"সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০১৪-০১-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-১৪।
বহিঃসংযোগ


হালাল রিযিক উপার্জন এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকা

রবিবার, ডিসেম্বর ০১, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
হালাল রিযিক উপার্জন এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকা
পাঠ সংক্ষেপ
হালাল রিযক উপার্জন-অন্বেষণ একটি আবশ্যিক বিষয়। কেননা কিয়ামতের দিন মানুষকে তার জায়গা থেকে সামান্যতম সরতে দেয়া হবে না যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে তার সম্পদের উৎস ও ব্যয়ের খাত সম্পর্কে। অতএব নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জন্য জরুরি হালাল ও পবিত্র উপার্জন বেছে নেয়া, সৎপথে সম্পদ আহরণ করা। হালাল ও বৈধ পথে ব্যয় করা। আর যা কিছু হারাম বা সন্দেহযুক্ত তা থেকে দূরে থাকা। কারণ হারাম উপার্জন ভক্ষণ থেকে যে শরীর বেড়ে ওঠে তার নিশ্চিত ঠিকানা হলো জাহান্নাম।


প্রথম খুৎবা

إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَتُوْبُ إِلَيْهِ وَنَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا وَسَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسْولُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ أَجْمَعِيْنَ، أَمَّا بَعْدُ :

সুপ্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আল্লাহ তাআলা আপনাকে আমাকে অঢেল নিয়ামতের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন। খাদ্য-পানীয়,আলো-বাতাস, জীবন জীবিকা সবই তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন সুচারুরূপে। তিনি আমাদেরকে এতোই দিয়েছেন যা গুণে কখনো শেষ করা যাবে না। এমনকি আমরা যদি তাঁর নেয়ামত-সামগ্রী গণনা করতে যাই তাহলে শেষ তো করতে পারবই না বরং আমরা নিজেরাই ক্লান্ত হয়ে পড়বো। আর এসব নিয়ামতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো ইসলামের নিয়ামত, হিদায়েতের নিয়ামত, সিরাতুল মুস্তাকীমের পথ দেখানোর নিয়ামত যা মানুষকে রেখে দেয় দুনিয়া ও আখিরাত - উভয় জগতের সুখ-সমৃদ্ধি ও অফুরান্ত কল্যাণের মধ্যখানে।

প্রিয় ভাইয়েরা! আমাদের মধ্যে কে না চায় দুনিয়া-আখেরাতে উত্তম জীবন পেতে, দুনিয়া-আখিরাতে সৌভাগ্যবান হতে? কে না চায় আপদম্ক্তু-নিষ্কন্টক জীবনযাপন করতে? আমাদের মধ্যে কেউ কি চায় অন্যের গলগ্রহ হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে? তাহলে আসুন এমন একটি বিষয় আমরা মনেপ্রাণে গ্রহণ করি, যাতে রয়েছে দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ। আর তা হলো হালাল রিযক তালাশ করা।

প্রিয় ভাইয়েরা! আল্লাহ তাআলা যা কিছু তাইয়িব বা পবিত্র তা আমাদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। আর যা কিছু অপবিত্র বা খাবায়েছ তা থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে বলেছেন। পবিত্র বলতে বুঝায় যা নিজে পবিত্র হওয়ার পাশাপাশি হালাল পন্থায় উপার্জিত এবং যাতে শরীর অথবা আকল-বুদ্ধির জন্য নেই কোনো ক্ষতিকর দিক।

প্রিয় ভাইয়েরা! রিযক অন্বেষণ করা, জীবনধারণের উপকরণ সন্ধান করা, ইসলামী শরীয়তের একটি স্পষ্ট নির্দেশ। মানবাত্মাও প্রকৃতিগতভাবে রিযক অন্বেষণের পেছনে ছুটে চলে। আর আল্লাহ তাআলা দিনকে করেছেন জীবিকা অর্জনের সময়কাল। তিনি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করতে এবং তাঁর দেয়া রিযক ভোগ করতে। শুধু তাই নয়, বরং যারা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দেয়া রিযকের সন্ধানে বিচরণ করে তাদেরকে তিনি বিজাতীয় শত্র দের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধে নিয়োজিত মুজাহিদদের সাথে যুক্ত করে একই আয়াতে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :
{وَآَخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَآَخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ}

আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে, আর কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে। অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড় (সূরা আল-মুযযাম্মিল:২০)।

শরীয়তের দৃষ্টিতে রিযক অন্বেষণে শ্রম ব্যয়ের গুরুত্ব এখান থেকেও বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যকে সর্বোত্তম খাদ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
(مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ، خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلَامِ، كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ)

নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ খায়নি। আর নিশ্চয় আল্লাহর নবী দাউদ আ. নিজ হাতের উপার্জন থেকেই খেতেন (বুখারী)।

প্রিয় ভাইয়েরা! হালাল রিযক উপার্জন করে মানুষের দ্বারস্থ হওয়া থেকে বেঁচে থাকাই বিশাল সম্মাান ও মর্যাদার বিষয়। এমনকী উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. বলেন :
مَا مِنْ مَوْضِعِ يَأْتِيْنِي الْمَوْتُ فِيْهِ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ مَوْطِنٍ أَتَسَوَّقُ فِيْهِ لِأَهْلِيْ؛ أَبِيْعُ وَأَشْتَرِيْ.

আমার মৃত্যু এমন জায়গায় আসার চেয়ে অধিক প্রিয় জায়গা আর নেই যেখানে আমি আমার পরিবারের জন্য বাজার করা তথা কেনা- বেচায় রত থাকব।

লুকমান হাকীমের একটি প্রজ্ঞাময় উপদেশ এ রকম, হে বৎস, তুমি হালাল রিযক উপার্জন করে দারিদ্র্য থেকে ধনাঢ্যতা অর্জন করো। কেননা কোনো ব্যক্তির দরিদ্র হওয়ার অর্থই হল তিনটি বদগুণে জড়িয়ে যাওয়া- এক. দীন পালনে ক্ষীণতা। দুই. আকল-বুদ্ধির দুর্বলতা। তিন. পৌরুষত্বের বিদায়।

প্রিয় ভাইয়েরা! নিশ্চয় পবিত্র উপার্জন ও নির্ভেজাল সম্পদ আহরণে নিহিত রয়েছে দীনদারী ত্র&ldquoটিমুক্ত হওয়া, মানসম্মানের সুরক্ষা, মন ও হৃদয়ের প্রফুল্লতা, চেহারার বিমর্ষহীনতা ও ইজ্জতের মাকাম অর্জনে ধন্য হওয়া।

তবে যে বিষয়টি আমাদেরকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে তা হলো, আমারা যা উপার্জন করছি পবিত্র কি না, হালাল কি না। কেননা আল্লাহ তাআলা যা পবিত্র ও হালাল কেবল তাই ভক্ষণ করার। নির্দেশ দিয়েছেন। আর যা অপবিত্র ও হারাম তা থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে:
{يا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُواْ مِنَ الطَّيّبَاتِ وَاعْمَلُواْ صَالِحاً نى بما تعملون عليم}

হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভালো বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সর্ম্পকে আমি সম্যক জ্ঞাত (সূরা আল মুমিনূন:৫১)।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :
{يا أَيُّهَا الَّذِينَ ءامَنُواْ كُلُواْ مِن طَيّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُواْ للَّهِ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ.}

হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযক দিয়েছি তা থেকে এবং আ¬ল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর (সূরা আল বাকারা:১৭২)।

আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যসমূহের একটি হলো, যা কিছু পবিত্র তা হালাল বলে ঘোষণা দেয়া। আর যা কিছু অপবিত্র-খাবীছ তা হারাম বলে ঘোষণা দেয়া। ইরশাদ হয়েছে :
{وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ}

এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে (সূরা আল আরাফ:১৫৭)।

উপর ন্তু যারা পবিত্র ও উত্তম কেবল তাদের জন্যই তো রয়েছে পরকালে জান্নাতের ঘোষণা। ইরশাদ হয়েছে :
{الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيّبِينَ يَقُولُونَ سَلامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُواْ الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ.}

ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটায় উত্তম অবস্থায়, তারা বলে, তোমাদের ওপর সালাম। জান্নাতে প্রবেশ কর, যে আমল তোমরা করতে তার কারণে (সূরা আন নাহল:৩২)।

প্রিয় ভাইয়েরা! পবিত্র ও হালাল রিযক অন্বেষণ-উপার্জন করা আদৌ কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়। তা রবং এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। কেননা কাল কিয়ামতের ময়দানে বান্দাকে তার জায়গা থেকে সরতে দেয়া হবে না যতক্ষণ না তাকে প্রশ্ন করা হবে যে, সে তার জীবিকা কোত্থেকে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করে ছে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
(لَنْ تَزُولَ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَسْأَلَ عَنْ أَرْبَعٍ: عَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاهُ، وَعَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ، وَفِيمَا أَنْفَقَهُ)

বান্দার দুপা তার জায়গা থেকে সরবে না যতক্ষণ না তাকে চারটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে : 
(এক) তার জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে, সে কিসে তা কাটিয়েছে (দুই) তার যৌবন সম্পর্কে যে, সে তা কিসে জীর্ণ করেছে (তিন) তার সম্পদ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে, সে তা কোথা হতে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে (চার) তার ইলম সম্পর্কে যে, সে তার ইলম অনুযায়ী কী আমল করেছে (তাবারানী, হাসান)।

তাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হলো গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা যে, সে তার জীবিকা কোত্থেকে কীভাবে উপার্জন করছে। সে যা উপার্জন করছে তা হালাল কি না, পবিত্র কি না তা অবশ্যই যাচাই করে দেখতে হবে, যাতে সে হালাল খেতে সক্ষম হয় এবং হালাল পথে ব্যয় করতে সক্ষম হয়।

আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর একটি ঘটনা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। একদা আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর এক চাকর তাঁকে কিছু খাবার দিল। খাওয়া শেষ হলে এটা কোথা থেকে এসেছে এ প্রশ্নের জবাবে সে বলল, আমি জাহিলী যুগে এক ব্যক্তির ভাগ্য গণনা করেছি। অথচ আমি ভাগ্য গণনায় পারদর্শী নই। আমি লোকটিকে ধোঁকা দিয়েছি। আর সে আমাকে এটা দিয়েছে। আর তাই আপনি এইমাত্র খেলেন। এ কথা শুনে আবু বকর সিদ্দীক রাযি. নিজ মুখে হাত ঢুকিয়ে বমি করে দিলেন। পেটে যা ছিল সব বের করে দিলেন(জাওয়ামিউল কালিম: হাদীস নং ১৪৩২)।

অন্য এক বর্ণনানুযায়ী। আবু বকর সিদ্দীক রাযি. তখন বলেলেন :

لَوْ لَمْ تَخْرُجْ إِلا مَعَ نَفْسِي لأَخْرَجْتُهَا
যদি তা বের করতে গিয়ে আমার জীবন দিতে হতো তবে আমি তাই করতাম (জাওয়ামিউল কালিম: হাদীস নং ৬৪)।

উমর রাযি. একবার কিছু দুধ পান করলেন। তিনি তা খুব ভালো মনে করলেন। যে লোকটি তাঁকে পান করতে দিয়েছিল তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুধ তুমি কোথায় পেয়েছ? উত্তরে লোকটি বলল,আমি যাকাতের উটের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেগুলো তখন পানির কাছে ছিল। অতঃপর আমি তাদের দুধ থেকে কিছু নিলাম। এ কথা শুনে উমর রাযি. তাঁর হাত মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বমি করে দিলেন।

জনৈক নেককার ব্যক্তির স্ত্রী তাঁকে উপদেশ দিয়ে বলেন, হে অমুক! আমাদের রিযকের ব্যাপারে আপনি আল্লাহকে ভয় করুন। কেননা আমরা ক্ষুধায় ধৈর্যধারণ করতে পারব, কিন্তু জাহান্নামে ধৈর্যধারণ করা আমাদের সাধ্যের বাইরে।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! এই তো ছিল সালাফে সালিহীনদের অবস্থা। হারাম বা সন্দেহযুক্ত কোনো কিছু, এমনকি তাঁদের অজ্ঞাতসারে উদরে প্রবেশ করলেও তাঁরা তা বমি করে বের করে দিতেন। পক্ষান্তরে আমাদের বর্তমান যুগের অবস্থা তো এর ঠিক উল্টো। বর্তমান যুগে তো হারাম খাওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। কলাকৌশলে যে যত বেশি সম্পদ একত্রিত করতে পারে মানুষ তাকে তত বেশি চালাক ও বিচক্ষণ বলে। আর হালাল খেয়ে অল্পে তুষ্ট থাকা মানুষকে বর্তমান সমাজে বোকা বলে অভিহিত করা হয়। এমনকি বর্তমান যুগের স্ত্রীরাও তাদের পুরুষদেরকে হারাম সম্পদ দু হাতে লুটে নিতে উৎসাহ যোগায়, প্ররোচনা দেয়। বর্তমান যুগে হারাম খেয়ে কেউ বমি করা তো দূরে থাক, সবাই বরং তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! ব্যক্তি ও সমাজের ওপর হারাম উপার্জনের প্রভাব খুবই মারাত্মক। হারাম উপার্জনের ফলে সকল প্রকার বরকত ছিনিয়ে নেয়া হয়। রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। আর্থিক অনটন-সঙ্কট দেশে-সমাজে শক্তভাবে শিকড় গেড়ে বসে । বেকারত্ব বেড়ে যায়। যুলম অন্যায়, প্রতিহিংসা ও রেশারেশির সয়লাব ঘটে।

প্রিয় মুসল্লীবৃন্দ! যারা হারাম খায়, পরিবার-পরিজন ছেলে-সন্তানদের হারাম অর্থে লালন করে, তারা মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়। তাদের উদাহরণ সাগরের পানি পানকারীর মতো। যতই সে পান করে ততোই তার তেষ্টায় আগুণ ধরে। এরা অল্পে তুষ্ট হতে নারাজ আবার অধিক পেয়েও থেকে যায় অখুশি। এরা হারামকে মনে করে সুস্বাদু-সুখাদ্য। হারাম উপার্জনের জন্য এরা অবলম্বন করে চলে সকল বক্রপথ। সুদ, জুয়া, ছিনতাই, চুরি, মাপে কম দেয়া, পণ্যের দোষত্রটি লুকিয়ে রাখা, যাদু, ভেলকিবাজি, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ, মিথ্যা-কসম, ধোঁকাবাজিসহ হেন কাজ নেই যা এরা করে না। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে চমৎকারভাবে ভবিষদ্বাণী করেছেন।

তিনি বলেন :

(يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ، لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ، أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ؟.)
এমন এক সময় আসবে যখন ব্যক্তি কোত্থেকে নিচ্ছে- হালাল থেকে, না হারাম থেকে তার গুরুত্ব দেবে না (বুখারী)।

হে চাকরিজীবী ভাইয়েরা, হে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, হে ঠিকাদার ভাইয়েরা, হে মুসলিম ভাই ও পর্দার আড়লে থাকা মা-বোনেরা! আসুন আমরা হারাম উপার্জন ও হারাম সম্পদ ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকি। সন্দেহযুক্ত সম্পদ থেকে ফিরে আসি। মানুষের হক যথাযথভাবে ফিরিয়ে দিই। আমরা আমাদের যার যার দায়িত্ব যথাযথরূপে পালন করি। অফিসে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, যে যেখানে আছি নিজ দায়িত্ব উত্তমরূপে পালন করি। বেতন-ভাতা হালাল করে নিই। ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষা করে চলি। পণ্যে ভেজাল মেশানো বন্ধ করি। আসুন আমরা আল্লাহ তাআলা কে ভয় করার মতো ভয় করি। হালাল রিযক হলো পবিত্র রিযক। হালাল রিযক হৃদয়কে করে পুষ্পিত-আলোকিত। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে করে সতেজ। হালাল রিযকের মাধ্যমে দুরুস্ত হয় মানুষের জীবন ও জগৎ। সুস্থ হয় মন ও শরীর। কবুল হয় বান্দার দুআ।

ভাইয়েরা আমার! যুহদ বা দুনিয়াবিরাগ মুমিনের একটি বড় গুণ। আর সবচে বড় যুহদ হলো হারাম পরিত্যাগ করা। হারাম থেকে দূরে থাকা। যে ব্যক্তি হারাম খায়। হারাম লেনদেন করে। মানুষকে যুলম করে তার কোনো তাকওয়াও নেই, যুহদও নেই।

আবু হুরাইরা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন- :
(مَنْ كَانَتْ يَعْنِي عِنْدَهُ مَظْلَمَةٌ فِي مَالِهِ أَوْ عِرْضِهِ، فَلْيَأْتِهِ فَلْيَسْتَحِلَّهَا مِنْهُ قَبْلَ أَنْ يُؤْخَذَ أَوْ تُؤْخَذَ، وَلَيْسَ عِنْدَهُ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ، فَإِنْ كَانَتْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ حَسَنَاتِهِ فَأُعْطِيَهَا هَذَا، وَإِلَّا أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ هَذَا فَأُلْقِيَ عَلَيْهِ)

যদি কেউ তার ভাইয়ের ওপর যুলম করে থাকে, হোক তা মান-ইজ্জত অথবা সম্পদ বিষয়ক, সে যেন আজই তা থেকে দায়মুক্ত হয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যখন কোনো টাকা পয়সার লেনদেন হবে না। সেদিন যদি তার নেক আমল থেকে থাকে তবে যুলম পরিমাণ নেক আমল তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তবে মাযলুম ব্যক্তির গুনাহ নিয়ে তার ওপর চাপানো হবে (আহমদ, সহীহ)।

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ، أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ .


দ্বিতীয় খুৎবা
اَلْحَمْدُ لِلَّهِ عَظِيْمِ الْإِحْسَانِ وَاسِعِ الْفَضْلِ وَالْجُوْدِ وَ الِامْتِنَانِ وَ أَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسْولُهُ صَلَّىَ اللهُ وَسَلَّمَ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعِيْنَ. أَمَّا بَعْدُ:

মুহতারাম হাযেরীন! দুনিয়ার মায়াজালে জড়িয়ে পড়ার ফেতনা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। একজন মুসলমানের প্রেরণা-উদ্দীপনা-উৎকণ্ঠার উৎস হবে দুনিয়া, তা কখনো মেনে নেয়া যায় না। বরং মুসলমানের উচিত দুনিয়াকে আখিরাতের ফসল ফলানোর ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা। হাদীসে এসেছে : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

(تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ، وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ، وَعَبْدُ الْخَمِيصَةِ، إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ، طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ، مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ، وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ، إِنْ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّع)

দীনারের পূজারী, দিরহামের পুজারী ও পোশাকের পূজারী ধ্বংস হোক! তাকে দেয়া হলে সে খুশি। আর না দিলে নারাজ। সে ধ্বংস হোক, অধঃপতিত হোক। সে কাঁটাবিদ্ধ হলে তা আর বের করা হয় না। শুভ সংবাদ ওই বান্দার জন্য, যে আল্লাহর পথে তার ঘোড়ার লাগাম ধরা অবস্থায় আছে, ধূলায়-ধুসর কেশ নিয়ে, ধূলোমলিন দুই পা নিয়ে। যদি সে প্রহরার দায়িত্বে থাকে তবে সে পাহারা দেয়। যদি সৈন্যবাহিনীর পশ্চদ্ভাগে থাকা তার দায়িত্ব হয়ে থাকে তবে সে পশ্চাদ্ভাগে থাকে। যদি সে অনুমতি চায়, তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। যদি সে সুপারিশ করে, তার সুপারিশ কবুল করা হয় না (বুখারী)।

হাদীসে উল্লেখিত দ্বিতীয় প্রকার ব্যক্তি দুনিয়ার লোভ লালসা মুক্ত হয়ে আল্লাহর পথে নিজকে নিবেদিত করে রাখে। দীন রক্ষার ক্ষেত্রে তাকে যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয় যথার্থরূপে সে তার দায়িত্ব পালন করে। শত্রর গতিবিধি দেখার জন্য যদি তাকে পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে সে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে নির্ঘুম রজনী যাপন করে। কখনো বলে না, এ কঠিন দায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি তাকে সৈন্যবাহিনীর পশ্চাদ্ভাগে থাকার দায়িত্ব দেয়া হয়, তবে সে তাই মেনে নেয়। বলে না, এখানে থাকলে আমার কোনো নাম-দাম হবে না। এ ব্যক্তির অর্থের প্রতি লোভ থাকে না। দুনিয়ার জৌলুস অর্জনের প্রতি লোভ থাকে না। নেতৃত্ব অর্জনের প্রতি লোভ থাকে না। সে নীরবে আল্লাহর পথে কাজ করে যায়। সচেতনভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে যায। ফলে মানুষের কাছে সে থেকে যায় অপরিচিত। তাই যদি সে কোনো নেতার দরবারে প্রবেশের অনুমতি চায়, তাকে গুরুত্বহীন মনে করে অনুমতি দেয়া হয় না। সে যদি কারো জন্য সুপারিশ করে তার সুপারিশ আদৌ কোনো গুরুত্ব পায় না। এ হলো সে ব্যক্তি যার কোনো দাবি আল্লাহ তাআলা প্রত্যাখ্যান করেন না।

দুনিয়ার প্রতি মোহাবিষ্ট থাকার একটি অশুভ পরিণতি হলো, হালাল-হারামের বাছ-বিচার না করা। যা সামনে পাওয়া যায়, কোনো রকম যাচাই-বাচাই না করেই তা লুফে নেয়া। আরেকটি অশুভ পরিণতি হলো, ঈমান ও কুফরের দোলাচলে দুলতে থাকা। দুনিয়ার মোহে পড়ে, মানুষ তার ঈমান বিকিয়ে দেয়। দুনিয়ার মোহাবিষ্ট অনেক ব্যক্তিই যদি মুমিন অবস্থায় সকালে উপনীত হয় তবে সন্ধ্যা বেলায় সে কাফের হয়ে যায়। কাফের অবস্থায় সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকাল বেলায় সে মুমিন হয়ে যায়। দুনিয়ার প্রতি মোহাবিষ্ট ব্যক্তি আদর্শিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে। সে টাকা পয়সার অনুরক্ত দাসে পরিণত হয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে বলেছেন। দুনিয়ায় অপরিচিত অথবা মুসাফিরের মতো থাকতে বলেছেন।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! রিযক যার ভাগ্যে যেটুকু লেখা আছে তা শেষ না করে কেউ এ ধরাধাম পরিত্যাগ করে যাবে না। তাই আসুন, আমরা যথার্তরূপে আল্লাহর তাকওয়া ধারণ করি। পবিত্র ও উত্তম পন্থায় রিযকের সন্ধান করি।

 জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
(لا تَسْتَبْطِئُوا الرِّزْقَ، فَإِنَّهُ لَنْ يَمُوتَ الْعَبْدُ حَتَّى يَبْلُغَهُ آخِرُ رِزْقٍ هُوَ لَهُ، فَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ: أَخَذِ الْحَلالِ، وَتَرَكِ الْحَرَامِ)
রিযক দেরিতে আসছে বলে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করো না। কেননা কোনো বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মারা যায় না যতক্ষণ না তার নির্ধারিত শেষ রিযক তার কাছে পৌঁছে যায়। অতঃপর তোমরা হালাল রিযক সুন্দরভাবে তালাশ করো। আর হারাম থেকে বিরত হও (ইবনে হাব্বান, সহীহ)।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আল্লাহ তাআলার তাকওয়া ও ভয়ই সেই মহামূল্যবান চাবি যা বান্দার জন্য সকল রহমত ও বরকতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। তাকওয়াই হলো অঢেল নিয়ামত-উপঢৌকন পাওয়ার পরীক্ষিত হাতিয়ার।

ইরশাদ হয়েছে :
{وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ}

আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমীন থেকে বরকতসমূহ তাদের ওপর খুলে দিতাম কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম (সূরা আল আরাফ:৯৬)।

তাকওয়া হলো সকল খায়ের-ভালাই-র প্রস্রবণ। সকল কল্যাণের আধার। যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তাকে সকল দুশ্চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার পথ করে দেন। সকল সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভের উপায় বের করে দেন। তিনি তাকে এমন জায়গা থেকে রিযকের ব্যবস্থা করেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে। তাকওয়া অবলম্বন করে দুনিয়া তার জন্য কখনো সঙ্কীর্ণ হয় না। জীবন-জীবিকা, রিযক-দৌলত তার জন্য সঙ্কুচিত হয় না।

 ইরশাদ হয়েছে- :

{وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا}
যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন (সূরা তালাক : ২)।

হে আল্লাহর বান্দারা! বরকত ও রহমত হাসিলের আরেকটি কার্যকর মাধ্যম হলো দুআ-প্রার্থনা, আল্লাহর আশ্রয়ে নিজকে সঁপে দেয়া। কেননা তিনি ছাড়া মানুষের জন্য অন্য কোনো আশ্রয়স্থল নেই। তাই যদি রিযকের সঙ্কট দেখা দেয়, রিযকের ব্যাপারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়, আপনার ধার-দেনা বেড়ে যায়, তবে আপনি আল্লাহর পানে ধাবিত হোন। আল্লাহর দরজায় কড়া নাড়ন। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর দরজায় কড়া নাড়ে, আল্লাহ তাঁকে নিরাশ করেন না। তাই আসুন, আমরা আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নিই। কেননা এমন কেউ নেই, যে তাঁর দরজায় নাছোড়বান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে অথচ তিনি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হালাল রিযক অন্বেষণের তাওফীক দান করুন। হারাম থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন।

الْلَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْم إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ وَعَنِ الصَّحَابَةِ أَجْمَعِيْنَ وَعَنِ التَّابِعِيْنَ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيْنَ وَعَنَّا مَعَهُمْ بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ وَعَفْوِكَ وَإِحْسَانِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ.
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সবাইকে হালাল রিযক উপার্জনের তাওফীক দান করুন। হারাম থেকে আমাদের সবাইকে বাঁচান। হালাল রিযকের সকল দরজা আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিন। হে আল্লাহ আপনি আমাদের যথার্থরূপে তাকওয়া অবলম্বনের তাওফীক দিন এবং আমাদের আর্থিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ করে দিন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : (إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.



ফটো গ্যালারী

1/6
ওহুদ যুদ্ধ - হযরত মহাম্মদ (সা:) এর বিপ্লবী জীবন
2/6
মুসলিম নারীর বিধান
3/6
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা
4 / 6
ইসলামীক জিজ্ঞাসাঃ লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
5/6
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
6/6
উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব

Islam-icon Profile.png