LIVE
Loading latest headlines...

রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৯

কুরআনের আলোকে * মুমিন ও কাফের *

রবিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে

 কুরআনের আলোকে  মুমিন ও কাফের
আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَّمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ، وَاللهُ بِمَا    تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ- ‘তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের ও কেউ মুমিন। আর তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সবই দেখেন’ (তাগাবুন ৬৪/২)
অত্র আয়াতে বিশ্বাসগত দিক দিয়ে মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। হয় সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হিসাবে ‘মুমিন’ হবে, অথবা অবিশ্বাসী হিসাবে ‘কাফের’ হবে। আল্লাহর উপর বিশ্বাসী হ’লে তার সার্বিক জীবন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী গড়ে উঠবে। আর অবিশ্বাসী হ’লে তার সার্বিক জীবন শয়তানী খোশ-খেয়াল অনুযায়ী গড়ে উঠবে। পরিণতির দিক দিয়েও এক দল জান্নাতী হবে, এক দল জাহান্নামী হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, فَرِيقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيقٌ فِي السَّعِيرِ- ‘সেদিন একদল হবে জান্নাতী ও একদল হবে জাহান্নামী’ (শূরা ৪২/৭)
https://www.printfriendly.com/p/g/PJfvME
একটি মৌলিক দর্শন :  
فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَّمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ ‘অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের ও কেউ মুমিন’ বলার মধ্যে একটি মৌলিক দর্শনের সন্ধান রয়েছে যে, আল্লাহ কাফের-মুমিন এবং কুফর ও ঈমান সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু বান্দা তার ইচ্ছামত কুফর বা ঈমানকে বেছে নেয় ও সেমতে সে কাজ করে। যেটি আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‘আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সবই দেখেন’। আর সে হিসাবে তার পুরস্কার ও শাস্তি হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَّإِمَّا كَفُورًا- ‘আমরা তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ হৌক কিংবা অকৃতজ্ঞ হৌক’ (দাহর ৭৬/৩)
ক্বাযা ও ক্বদর :
তবে সবকিছুই হয় ক্বাযা ও ক্বদর তথা আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণ অনুযায়ী এবং সবই হয় তাঁর অনুমতিক্রমে ও তাঁর জ্ঞাতসারে। তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর জানার বাইরে বান্দা কিছুই করতে পারে না। এই সঠিক বিশ্বাস থাকলে অদৃষ্টবাদ ও অদৃষ্টকে অস্বীকারের ভ্রান্তি থেকে মানুষ নিরাপদ থাকবে। এই বিশ্বাস থাকলে বান্দা আনন্দে আত্মহারা হবেনা বা ব্যর্থতায় দিশেহারা হবেনা। যেমন আল্লাহ বলেন,مَآ أَصَابَ مِنْ مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلاَ فِي أَنْفُسِكُمْ اِلاَّ فِي كِتَابٍ مِّنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيرٌ- لِكَيْلاَ تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلاَ تَفْرَحُوا بِمَآ آتَاكُمْ وَاللهُ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ- ‘পৃথিবীতে বা তোমাদের জীবনে এমন কোন বিপদ আসে না, যা তা সৃষ্টির পূর্বে আমরা কিতাবে লিপিবদ্ধ করিনি। নিশ্চয় এটা আল্লাহর জন্য সহজ’। ‘যাতে তোমরা যা হারাও তাতে হতাশ না হও এবং যা তিনি তোমাদের দেন, তাতে উল্লসিত না হও। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কোন উদ্ধত ও অহংকারীকে ভালবাসেন না’ (হাদীদ ৫৭/২২-২৩)। তিনি বলেন,قُلْ لَنْ يُّصِيبَنَا اِلاَّ مَا كَتَبَ اللهُ لَنَا هُوَ مَوْلاَنَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ- ‘তুমি বল, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের নিকট পৌঁছবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (তওবা ৯/৫১)
ফাসেকদের অবস্থান :
আল্লাহ এখানে কেবল কাফের ও মুমিন বলেছেন, কিন্তু ফাসেক বলেননি। কারণ ফাসেকদের বিষয়টি উক্ত বক্তব্যের মধ্যেই বুঝা যায়। আল্লাহ মুমিন ও কাফের বলে ঈমান ও কুফরের দুই প্রান্তসীমাকে বুঝিয়েছেন। মধ্যবর্তী ফাসেকী অবস্থাকে উহ্য রেখেছেন (কুরতুবী)। ফাসেকরা ছগীরা অথবা কবীরা গোনাহগার হবে। মুমিনরাও তেমনি নিম্নস্তরের ও উঁচু স্তরের হবে।
ত্রুটিপূর্ণ মুমিনগণ ‘ফাসেক’। কিন্তু ‘কাফের’ বা ইসলাম থেকে খারিজ ও ‘মুরতাদ’ নয়। যেমন বনু মুছত্বালিক্বদের নিকট থেকে ‘যাকাত’ সংগ্রহের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অলীদ বিন ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বকে প্রেরণ করেন। কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে এসে বলেন যে, তারা ‘মুরতাদ’ হয়ে গিয়েছে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। তখন রাসূল (ছাঃ) খালেদ বিন অলীদকে পাঠিয়ে জানতে পারেন যে, তারা আদৌ মুরতাদ হয়নি। বরং মুমিন ও পূর্ণ আনুগত্যশীল রয়েছে। ফলে রাসূল (ছাঃ) তাদের দমনে সৈন্য পাঠানো থেকে বিরত হন। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে নাযিল হয়,يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَآءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ- ‘হে মুমিনগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহ’লে তোমরা সেটা যাচাই কর, যাতে অজ্ঞতাবশে তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধন না করে বস। অতঃপর নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হও’ (হুজুরাত ৪৯/৬)। ভুল তথ্য প্রদানের জন্য ঐ ব্যক্তিকে কুরআনে ‘ফাসেক’ বলা হয়েছে। কিন্তু তাকে কাফের বা ‘মুরতাদ’ বলা হয়নি। রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যাও করেননি। একইভাবে মক্কা বিজয়ের অভিযানের খবর ফাঁস করে কুরায়েশ নেতাদের নিকট গোপনে পত্র প্রেরণকারী ছাহাবী হাতেব বিন আবু বালতা‘আহকে রাসূল (ছাঃ) ‘কাফের’ বলেননি বা তাকে হত্যা করেননি। বরং কৈফিয়ত নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।[1]
পাপ ও পুণ্যের স্তর বিন্যাস :
বস্ত্ততঃ ঈমান ও কুফরের স্তর বিন্যাস পাপ ও পুণ্যের কম-বেশীর কারণে হয়ে থাকে। এর আলোকেই ছগীরা ও কবীরা গুনাহ সাব্যস্ত হয়। যা তওবার মাধ্যমে মাফ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَآئِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلاَّ اللَّمَمَ؛ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ، ‘যারা বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কর্ম সমূহ হ’তে বেঁচে থাকে ছোট-খাট পাপ ব্যতীত; (সে সকল তওবাকারীর জন্য) তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমার অধিকারী’ (নাজম ৫৩/৩২)। তিনি সবাইকে তওবার আহবান জানিয়ে বলেন,وَتُوبُوا إِلَى  اللهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- ‘আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে যাও! যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (নূর ২৪/৩১)
মুমিন ও কাফেরের স্তরভেদের কারণে জান্নাতে ও জাহান্নামেও স্তরভেদ রয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে সর্বোচ্চ জান্নাতুল ফেরদাঊস প্রার্থনা করতে বলেছেন।[2]
শাফ‘আতকে অস্বীকার :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল, কবীরা গোনাহগার মুমিনগণ রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আতের ফলে ক্রমে ক্রমে জাহান্নাম থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। উক্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, شَفَاعَتِي لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِي- ‘আমার শাফা‘আত হবে আমার উম্মতের কবীরা গুনাহগারদের জন্য’।[3] আল্লাহ বলেন,يَوْمَئِذٍ لاَّ تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلاَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلاً- ‘সেদিন দয়াময় (আল্লাহ) যাকে অনুমতি দিবেন এবং যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন, সে ব্যতীত কারু সুফারিশ কোন কাজে আসবে না’ (ত্বোয়াহা ২০/১০৯; সাবা ৩৪/২৩; নাজম ৫৩/২৬)। খারেজী ও মু‘তাযেলীগণ কবীরা গুনাহগার মুমিনদের জন্য শাফা‘আতকে অস্বীকার করেন। কেননা তাদের মতে কবীরা গুনাহগার মুমিন চিরস্থায়ী জাহান্নামী’।[4]
চরমপন্থী ও শৈথিল্যবাদী আক্বীদা :
খারেজী-মু‘তাযেলী ও তাদের অনুসারীগণ মানুষকে কেবল মুমিন ও কাফের দুই ভাগে ভাগ করেন। মধ্যবর্তী ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদার তথা ফাসেক মুমিনদেরকে তারা কাফের বলেন। উক্ত চরমপন্থী আক্বীদার লোকদের মাধ্যমেই ইসলামের নামে যুগে যুগে জঙ্গীবাদের উদ্ভব ঘটেছে।
অন্যদিকে ‘মুরজিয়া’দের মতে আমল ঈমানের অংশ নয়। সেহেতু কবীরা গোনাহ তাদের ঈমানের কোন ক্ষতি করবেনা। এই আক্বীদায় বিশ্বাসীরা দ্বিধাহীন ভাবে কবীরা গোনাহ করে যায়। এরা হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা করেনা। এদের কারণেই সমাজ পাপে ডুবে যাচ্ছে। মানবতা বিধবস্ত হচ্ছে। এদেরকে ‘শৈথিল্যবাদী’ বলা হয়। মুসলিম উম্মাহ উপরোক্ত দুই ভ্রান্ত মতবাদের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সঠিক আক্বীদা :
উপরোক্ত দুই চরমপন্থী মতবাদের মধ্যবর্তী সঠিক আক্বীদা এই যে, কবীরা গোনাহগার মুমিন ঈমান হ’তে খারিজ নয়। সে তওবা না করে মারা গেলেও স্থায়ীভাবে জাহান্নামী নয়। কেননা আল্লাহ পাক চাইলে শিরক ব্যতীত বান্দার যেকোন গুনাহ মাফ করতে পারেন (নিসা ৪/৪৮)
আয়াতটির তাফসীর :
দরসে বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় মু‘তাযেলী মুফাসসির আল্লামা যামাখশারী (৪৬৭-৫৩৮ হি.) বলেন, فَمِنْكُمْ آتٍ بِالْكُفْرِ وَفَاعِلٌ لَهُ وَمِنْكُمْ آتٍ بِالْإِيمَانِ وَفَاعِلٌ لَهُ ‘অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী নিয়ে আগমন করে ও তার জন্য সে কাজ করে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমান নিয়ে আগমন করে ও তার জন্য সে কাজ করে’। তিনি বলেন,فَمَا أَجْهَلَ مَنْ يَّمْزُجُ الْكُفْرَ بِالْخَلْقِ وَيَجْعَلُهُ مِنْ جُمْلَتِهِ، وَالْخَلْقُ أَعْظَمُ نِعْمَةٍ مِّنَ اللهِ تَعَالَى عَلَى عِبَادِهِ، وَالْكُفْرُ أَعْظَمُ كُفْرَانٍ مِّنَ الْعِبَادِ لِرَبِّهِمْ سُبْحَانَهُ- ‘তার চেয়ে বড় মূর্খ আর কে আছে, যে কুফরকে সৃষ্টির সঙ্গে মিশ্রিত করে এবং একে তার মধ্যে শামিল করে? অথচ ‘সৃষ্টি’ হ’ল বান্দার উপর আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এবং ‘কুফর’ হ’ল বান্দার পক্ষ হ’তে আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা’ (কাশশাফ)
উক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি আহলে সুন্নাতের আক্বীদাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের বিশুদ্ধ আক্বীদা হ’ল, কুফরী সহ বান্দার স্বেচ্ছাকৃত ভাল-মন্দ সকল কর্মের মূল স্রষ্টা হ’লেন আল্লাহ। আর বান্দা হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত কর্মশক্তির ভাল-মন্দ প্রয়োগের ফলাফল অর্জনকারী (মুহাক্কিক কাশশাফ)। যেমন আল্লাহ বলেন, وَاللهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ- ‘আল্লাহ তোমাদের ও তোমাদের কর্মসমূহ সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৬)। চাই সে কর্ম ভাল হৌক বা মন্দ হৌক। ভাল করলে ভাল ফল পাবে এবং মন্দ করলে মন্দ ফল পাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَآءَ فَعَلَيْهَا وَمَا رَبُّكَ بِظَلاَّمٍ لِّلْعَبِيدِ- ‘যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, সে তার নিজের জন্যই সেটা করে। আর যে অসৎ কর্ম করে তার প্রতিফল তার উপরেই বর্তাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক তার বান্দাদের প্রতি যুলুমকারী নন’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৬)। এটা না থাকলে আল্লাহ কেবল ভাল-র স্রষ্টা হবেন। মন্দের স্রষ্টা আরেকজনকে মানতে হবে। যা স্পষ্ট শিরক।
যামাখশারীর উক্ত আক্বীদা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর তাফসীর গ্রন্থের অধিকাংশ স্থানে। যেমন নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীরে।-
يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلاَ تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য তার রাসূলের। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতামূলক কোন কাজই আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। সর্বোপরি কুফরী সকল সৎকর্ম বিনষ্ট করে দেয়। যেমন অন্যত্র এসেছে,قُلْ أَطِيعُوا اللهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ- ‘তুমি বল, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে (তারা জেনে রাখুক যে) আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৩২)। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা কাফেরদের স্বভাব। যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন না।
উপরোক্ত আয়াতে ঈমানদারগণকে ‘কাফির’ বলা ও তাদের ‘সমস্ত আমল বিনষ্ট হওয়া’ কথাগুলি অবাধ্য মুসলিমদের প্রতি কঠোর ধমকি হিসাবে এসেছে এবং অবাধ্যতা যে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা তাদেরকে ইসলাম থেকে খারিজ ‘প্রকৃত কাফির ও মুরতাদ’ বুঝানো হয়নি। কেননা আল্লাহ তাদেরকে ‘মুমিন’ বলে সম্বোধন করেছেন। আর তিনি মুমিনের কোন নেক আমল বিনষ্ট করেন না (আলে ইমরান ৩/১৯৫)। তবে যদি সে ঈমান আনার পরেও ‘মুরতাদ’ হয়ে যায়, তাহ’লে তার বিগত সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। যেমনটি অত্র আয়াতের শেষে এবং পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে (ইবনু কাছীর)
মুহাম্মাদ ৩৩ আয়াতের শেষে বর্ণিত وَلاَ تُبْطِلُوآ أَعْمالَكُمْ ‘আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’-এর ব্যাখ্যায় যামাখশারী বলেন,لاَ تُحْبِطُوا الطَّاعَاتِ بِالْكَبَائِرِ كقوله تعالي يَآأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُواْ لاَ تَرْفَعُواْ أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبـِىِّ …أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لاَ تَشْعُرُونَ- ‘তোমরা কবীরা গোনাহসমূহের মাধ্যমে তোমাদের সৎকর্মসমূহকে বিনষ্ট করো না। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপরে তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না …যাতে তোমাদের কর্মফল সমূহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। অথচ তোমরা বুঝতে পারবে না’ (হুজুরাত ৪৯/২)
এটি তাঁর মু‘তাযেলী আক্বীদা অনুযায়ী ব্যাখ্যা। যাদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফের। সে একটি কবীরা গুনাহ করলেও তার যাবতীয় সৎকর্ম বিনষ্ট হবে। তারা ফাসেকদের চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার আক্বীদা পোষণ করেন। সেকারণ ফাসেকের ঈমান বা সৎকর্ম তাদের মতে কোন কাজে আসবে না (মুহাক্কিক কাশশাফ)। অথচ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের আক্বীদা হ’ল, কবীরা গোনাহগার মুমিন কাফের নয়। বরং ফাসেক। সে তওবা না করে মারা গেলেও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। কারণ আল্লাহ শিরক ব্যতীত বান্দার যেকোন গোনাহ মাফ করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮)
কাফেরদের সঙ্গে জিহাদের মানদন্ড :
আল্লাহ বলেন,قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ- ‘তোমরা যুদ্ধ কর আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা আল্লাহ সীমালংঘন কারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন সেনাদল প্রেরণ করতেন, তখন বলতেন,اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَلاَ تَغُلُّوا وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تُمَثِّلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلاَ أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ- ‘তোমরা আল্লাহর নামে তাঁর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[5] ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, এক যুদ্ধে এক মহিলাকে নিহত দেখতে পেয়ে রাসূল (ছাঃ) দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং নারী ও শিশুদের থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেন।[6]
রাসূল (ছাঃ)-এর মাক্কী ও মাদানী জীবন পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। তবে সেটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কখনো নিরস্ত্র হবে, কখনো সশস্ত্র হবে। নিরস্ত্র জিহাদ মূলতঃ প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত ও হক-এর উপরে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র জিহাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ, পর্যাপ্ত সামর্থ্য, বৈধ কর্তৃপক্ষ এবং স্রেফ আল্লাহর ওয়াস্তে নির্দেশ দানকারী আমীরের প্রয়োজন হবে। নইলে ছবর করতে হবে এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّى دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ- ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। যখন তারা এগুলি করবে, তখন আমার পক্ষ হ’তে তাদের জান ও মাল নিরাপদ থাকবে ইসলামের হক ব্যতীত এবং তাদের (অন্তর সম্পর্কে) বিচারের ভার আল্লাহর উপর রইল’।[7] যেমন মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যা করেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে।
অত্র হাদীছে বুঝানো হয়েছে যে, কাফির-মুশরিকরা যুদ্ধ করতে এলে তোমরাও যুদ্ধ করবে। কিংবা তাদের মধ্যকার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে। কিন্তু নিরস্ত্র, নিরপরাধ বা দুর্বলদের বিরুদ্ধে নয়। কাফির পেলেই তাকে হত্যা করবে সেটাও নয়। এই যুদ্ধ কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে হবে না। কেননা উক্ত হাদীছটি অন্য বর্ণনায় এসেছে,أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ الْمُشْرِكِينَ… ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে’।[8] অথচ চরমপন্থীরা মুসলমানদেরকেই হত্যা করে এবং তারা সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَلَّى صَلاَتَنَا، وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا، وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا، فَذَلِكَ الْمُسْلِمُ الَّذِى لَهُ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ، فَلاَ تُخْفِرُوا اللهَ فِى ذِمَّتِهِ- ‘যে ব্যক্তি আমাদের তরীকায় ছালাত আদায় করে, আমাদের কেবলাকে কেবলা বলে গ্রহণ করে এবং আমাদের যবেহ করা পশুর গোশত খায়, সে ব্যক্তি ‘মুসলিম’। তার (জান-মাল ও ইযযত রক্ষার জন্য) আল্লাহ ও তার রাসূলের দায়িত্ব রয়েছে। অতএব তোমরা আল্লাহর দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করোনা’।[9] এতে বুঝা যায় যে, প্রকাশ্য ইসলামী আমলের মাধ্যমেই ব্যক্তি ‘মুসলিম’ সাব্যস্ত হবে।
অত্র হাদীছে শৈথিল্যবাদী মুরজিয়াদের প্রতিবাদ রয়েছে। যারা বলেন, ঈমানের জন্য কেবল স্বীকৃতিই যথেষ্ট। আমলের প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে বিদ‘আতীদের কাফের না বলারও দলীল রয়েছে (মিরক্বাত, মির‘আত)
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পরস্পরে কাফের গণ্য করার ধারাবাহিক ইতিহাস :
উম্মতের মধ্যে প্রথম বিদ‘আতের সূচনা হয় পরস্পরকে ‘কাফির’ বলার মাধ্যমে। খারেজীরা হ’ল উম্মতের প্রথম ভ্রান্ত ফের্কা, যারা কবীরা গোনাহগার মুসলিমকে ‘কাফের’ বলে এবং তাকে হত্যা করা সিদ্ধ বলে। এদের সাথে সাথেই সৃষ্টি হয় আরেকটি চরমপন্থী ভ্রান্ত ফের্কা শী‘আ দল। যারা বলে, রাসূল (ছাঃ)-এর পরে মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, আবু যর গেফারী ও সালমান ফারেসী (রাঃ) ব্যতীত সকল ছাহাবী ‘মুরতাদ’ বা ধর্মত্যাগী।
প্রথম যুগের চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আদের অনুকরণে আধুনিক যুগে কয়েকজন চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে। যাদের যুক্তিবাদী লেখনীতে প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন দেশে ইসলামের নামে চরমপন্থী দলসমূহের উদ্ভব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে এসব দলের যে আক্বীদা প্রচারিত হয়, তা হ’ল ‘দ্বীন আসলে হুকূমতের নাম। শরী‘আত ঐ হুকূমতের কানূন। আর ইবাদত হ’ল ঐ কানূন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’। তাদের মতে ‘ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ-যাকাত, যিকর ও তাসবীহ সবকিছু উক্ত বড় ইবাদতের জন্য প্রস্ত্ততকারী অনুশীলনী বা ট্রেনিং কোর্স মাত্র’। তারা বলেন, ইসলাম কোন বণিকের দোকান নয় যে, ইচ্ছামত কিছু মাল কিনবে ও কিছু ছাড়বে। বরং ইসলামের হয় সবটুকু মানতে হবে, নয় সবটুকু ছাড়তে হবে’। তাদের ধারণায় ‘আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্য দু’টিই সমান। যদি ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদি ইবাদত হুকূমত কায়েমের লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হয়, তাহ’লে আল্লাহর নিকট এ সবের কোন ছওয়াব মিলবে না’। তারা বলেন, এই দাওয়াত যারা কবুল করবে না, তাদের অবস্থা হবে নবীযুগে ইসলামী দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী ইহূদীদের মত’।
তাদের উক্ত আক্বীদা বিগত যুগের চরমপন্থী খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত দলসমূহের অনুরূপ। সে যুগে তারা ছাহাবীদের ‘কাফের’ বলেছিল ও তাদের রক্ত হালাল করেছিল। এ যুগে এরা অন্য মুসলমানদের ‘ইহূদী’ অর্থাৎ কাফের ভাবছে ও তাদের রক্ত হালাল গণ্য করছে। সে যুগে যেমন যেকোন মূল্যে ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এ যুগেও তেমনি ব্যালট বা বুলেট যেভাবেই হৌক ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য এবং এটাই হ’ল তাদের দৃষ্টিতে বড় ইবাদত।
বস্ত্ততঃ উপরোক্ত চিন্তাধারায় সবচেয়ে বড় ভুল হ’ল তিনটি : (১) সর্বাত্মক দ্বীন-এর ধারণা। ফলে তাদের মতে দ্বীনের কোন একটি অংশ ছাড়লেই সব দ্বীন চলে যাবে। (২) দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য পরিষ্কার না হওয়া এবং (৩) আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্যকে এক করে দেখা’। এই দর্শনের ফলে ইসলামী সরকারের বিরোধিতা করা এবং অনৈসলামী বা অমুসলিম সরকারের আনুগত্য করা দু’টিই শিরকে পরিণত হয়। যাতে সরকার ও মুমিন জনগণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হবে। যেমনটি বর্তমানে অনেক স্থানে হচ্ছে।
একই ধারণা প্রচারিত হয় মিসরে। যারা খারেজীদের ন্যায় মুসলিম উম্মাহকে কাফের ও মুমিন দু’ভাগে ভাগ করে বলেন, ‘লোকেরা আসলে মুসলমান নয় যেমন তারা দাবী করে থাকে। তারা জাহেলিয়াতের জীবন যাপন করছে। … তারা ধারণা করে যে, ইসলাম এই জাহেলিয়াতকে নিয়েই চলতে পারে। কিন্তু তাদের এই ধোঁকা খাওয়া ও অন্যকে ধোঁকা দেওয়ায় প্রকৃত অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবে না। না এটি ইসলাম এবং না তারা মুসলমান’। তারা বলেন, ‘কালচক্রে দ্বীন এখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহতে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। … মানুষ প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে সর্বত্র মসজিদের মিনার সমূহে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধ্বনি বারবার উচ্চারণ করে কোনরূপ বুঝ ও বাস্তবতা ছাড়াই। এরাই হ’ল সবচেয়ে বড় পাপী ও ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তির(أثقلُ إثماً وأشدُّ عذاباً يومَ القيامة) অধিকারী। কেননা তাদের কাছে হেদায়াত স্পষ্ট হওয়ার পরেও এবং তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে থাকার পরেও তারা মানুষপূজার দিকে ফিরে গেছে’। তারা বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই বা কোন মুসলিম সমাজ নেই’। তারা মুসলমানদের সমাজকে জাহেলী সমাজ এবং তাদের মসজিদগুলিকে ‘জাহেলিয়াতের ইবাদতখানা’ (مُعَابِدُ الْجَاهِلِيَّةِ) বলে আখ্যায়িত করেন’। তারা আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্যকে সমান মনে করেন এবং অনৈসলামী সরকারের আনুগত্য করাকে ‘ঈমানহীনতা’ গণ্য করেন’। ‘একটি বিষয়েও অন্যের অনুসরণ করলে সে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে’ বলে তারা ধারণা করেন। তারা বলেন, ইসলামে জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল, ইসলাম বিরোধী শাসনের বুনিয়াদ সমূলে ধ্বংস করা এবং সে স্থলে ইসলামের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কায়েম করা’।
বলা বাহুল্য, এইসব খারেজী ও শী‘আপন্থী তাফসীরের কারণে মুসলিম উম্মাহর প্রায় সর্বত্র চরমপন্থী মতবাদ ছরিয়ে পড়েছে। যা বহু তরুণের পথভ্রষ্টতার কারণ হয়েছে। তারা অবলীলাক্রমে মুসলিম সরকার ও সমাজকে কাফের ভাবছে ও তাদেরকে বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। অথচ অন্তর থেকে কালেমা শাহাদাত পাঠকারী কোন মুমিন কবীরা গোনাহের কারণে কাফের হয় না। এটাই হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের সর্বসম্মত আক্বীদা। আর আক্বীদা পরিচ্ছন্ন না হ’লে কখনো আমল পরিচ্ছন্ন হয় না। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক আক্বীদার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মুসলমানদের আমল শুদ্ধ করা।
ত্বাগূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ :
‘ত্বাগূত’ (الطاغوت) অর্থ শয়তান, মূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে, ‘কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে অন্য কোন বাতিলের কাছে ফায়ছালা তলব করা’। মূলতঃ এটি হ’ল মুনাফিকদের স্বভাব (নিসা ৪/৬০-৬১)
এক্ষণে কোন মুসলিম সরকার যদি কুরআন ও সুন্নাহর বিধান বাদ দিয়ে নিজেদের মনগড়া আইন অনুযায়ী দেশ শাসন করে, তবে সে সরকার মুনাফিক ও কবীরা গোনাহগার হবে। কিন্তু যদি সেটাকে আল্লাহর বিধানের চাইতে উত্তম বা সমান বা দু’টিই সিদ্ধ মনে করে ও জেনেবুঝে তাতে খুশী থাকে, তাহ’লে উক্ত সরকার প্রকৃত ‘কাফের’ হিসাবে গণ্য হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে কোন মুসলিম ব্যক্তি বা সরকার কাফের সাব্যস্ত হলেই তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা ফরয নয়।
ত্বাগূতের বিরুদ্ধে কর্তব্য :
উপরোক্ত অবস্থায় মুমিনের কর্তব্য হবে, (১) বৈধভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো। (২) দেশে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (৩) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। (৪) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা। (৫) সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবেনা। তাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে।
উল্লেখ্য যে, মুনাফিকরা বড় কাফের হ’লেও তারা ‘মুরতাদ’ হবে না এবং তাদের উপর দন্ডবিধি জারি হবে না। কেননা তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামকে স্বীকার করে। তবে আখেরাতে তারা কাফেরদের সাথেই একত্রে জাহান্নামে থাকবে (নিসা ৪/১৪০)। বরং তারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে (নিসা ৪/১৪৫)
পর্যালোচনা :
আধুনিক যুগে ভারতবর্ষ ও মিসরে প্রচারিত উপরোক্ত চরমপন্থী আক্বীদার অনুসারী দল সমূহ কবীরা গোনাহগার মুসলমানদেরকে মুসলমান হিসাবে মেনে নিতে চাননি। বরং তাদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলে ধারণা করেছেন। এর ফলে তাঁরা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সাথে সাথে পথচ্যুত করেছেন তাদের অনুসারী অসংখ্য মুসলিম নর-নারীকে। অথচ এর কোন বাস্তবতা এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেও ছিল না। তখনও মুসলমানদের মধ্যে ভাল-মন্দ, ফাসিক-মুনাফিক সবই ছিল। কিন্তু কাউকে তাঁরা কাফির এবং মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলতেন না। সেকারণ আধুনিক বিদ্বানগণ এসব দল ও এদের অনুসারী দলসমূহকে এক কথায় ‘জামা‘আতুত তাকফীর’ (جَمَاعَةُ التَّكْفِيْرِ) অর্থাৎ ‘অন্যকে কাফের ধারণাকারী দল’ বলে অভিহিত করে থাকেন। অথচ এইসব চরমপন্থী আক্বীদার ফলে যিনি মারছেন ও যিনি মরছেন, উভয়ে মুসলমান। আর এটাই তো শয়তানের পাতানো ফাঁদ, যেখানে তারা পা দিয়েছেন।
অতএব মুমিনের কর্তব্য হবে চরমপন্থী তাফসীর সমূহ থেকে বিরত হওয়া ও তাদের সংগঠন থেকে দূরে থাকা। সর্বাবস্থায় আমর বিন মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করা এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের নিকট ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামের মধ্যপন্থী আক্বীদায় বিশ্বাসী হওয়ার ও সে মতে জামা‘আতবদ্ধ হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!
-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

[1]বুখারী হা/৪২৭৪
[2]তিরমিযী হা/২৫৩১
[3]আবুদাঊদ হা/৪৭৩৯
[4]আক্বীদাহ ওয়াসিত্বিইয়াহ-শরহ ১৫০ পৃ.
[5]মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮
[6]বুখারী হা/৩০১৫
[7]বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১২
[8]নাসাঈ হা/৩৯৬৬
[9]বুখারী হা/৩৯১


ডায়াবেটিস রোগীরা যে ভুলটা করবেন না

রবিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে



পরকালে মানুষকে যে সব প্রশ্নের জবাব দিতে হয়

রবিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
দুনিয়াতে বান্দা যা কিছু করে ও বলে সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হয়। ‘সম্মানিত লেখক ফেরেশতাবৃন্দ সবকিছু লিখে রাখেন’ (ইনফিত্বার ৮২/১১)। ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৮)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُبِيْنٍ ‘আর প্রতিটি বস্ত্তকেই আমি সুস্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষণ করে রেখেছি’ (ইয়াসীন ৩৬/১২)। وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا، اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا. ‘আর ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে বের করে দেখাব একটি আমলনামা, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে। (সেদিন আমরা বলব,) তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১৩-১৪)। ‘সবাইকে তাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’ (নাহল ১৬/৯৩; হিজর ১৫/৯২-৯৩)। পরিশেষে আমল অনুপাতে তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। এমনকি ‘অণু পরিমাণ ভাল কাজ করলে, সে তা দেখতে পাবে এবং অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে সেও তা দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭)। ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে তার দুনিয়াবী ছোট-বড়, গোপন-প্রকাশ্য, কথা ও কর্ম তথা সব আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তন্মধ্যে কিছু বিষয় কিতাব ও সুন্নাহতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলি সম্পর্কে বান্দাকে সেদিন জিজ্ঞেস করা হবে, যাতে বান্দা সেসব বিষয়ে সতর্ক থাকে, সেগুলির হেফাযত করে, নিজে ও অন্যরাও এসবের হেফাযত না করার ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারে ও এগুলিকে বেশি ভয় করে এবং যত্নবান হয়। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্।
https://www.printfriendly.com/p/g/SpHmBs
১. কবরে তিনটি প্রশ্ন করা হবে :
পরকালীন জীবনের সর্বপ্রথম মনযিল কবর। কবরে বান্দাকে তিনটি বিশেষ প্রশ্ন করা হবে। তবে কবরের প্রশ্ন ক্বিয়ামতের দিনের প্রশ্ন হ’তে ভিন্ন। বারা বিন আযিব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, কবরে বান্দাকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। এক. তোমার রব কে? তারপর তাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে, তোমার দ্বীন কি? অতঃপর তৃতীয় প্রশ্নটি করা হবে, এই লোকটি কে ছিলেন, যাকে তোমাদের নিকটে প্রেরণ করা হয়েছিল? বান্দা যদি মুমিন হয়, তাহ’লে এগুলির যথাযথ জওয়াব দিতে পারবে। আর যদি বেঈমান বা কাফির হয়, তাহ’লে বলবে, আফসোস আমি কিছুই জানি না’।[1]
২. ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ছালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে :
হক দু’প্রকার। এক. আল্লাহর হক। দুই. বান্দার হক। আল্লাহর হকগুলির মধ্যে ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হিসাব নেয়া হবে ছালাতের। যেমন আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ النَّاسُ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ أَعْمَالِهِمُ الصَّلاَةُ قَالَ يَقُولُ رَبُّنَا جَلَّ وَعَزَّ لِمَلاَئِكَتِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ انْظُرُوا فِى صَلاَةِ عَبْدِى أَتَمَّهَا أَمْ نَقَصَهَا فَإِنْ كَانَتْ تَامَّةً كُتِبَتْ لَهُ تَامَّةً وَإِنْ كَانَ انْتَقَصَ مِنْهَا شَيْئًا قَالَ انْظُرُوْا هَلْ لِعَبْدِى مِنْ تَطَوُّعٍ فَإِنْ كَانَ لَهُ تَطَوُّعٌ قَالَ أَتِمُّوا لِعَبْدِى فَرِيضَتَهُ مِنْ تَطَوُّعِهِ ثُمَّ تُؤْخَذُ الأَعْمَالُ عَلَى ذَاكُمْ-
‘নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন মানুষের আমলসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম ছালাতের হিসাব নেয়া হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমাদের মহীয়ান গরীয়ান রব ফেরেশতাদেরকে বলবেন অথচ তিনি সর্বাধিক অবগত, ‘তোমরা আমার বান্দার ছালাত দেখ, সে তা পরিপূর্ণ করেছে, না অসম্পূর্ণ রেখেছে’। যদি পূর্ণ হয়, তাহ’লে পূর্ণই লেখা হবে। আর যদি তাতে কিছু কমতি থাকে, তাহ’লে তিনি বলবেন, ‘তোমরা দেখ আমার বান্দার কোন নফল (ছালাত) আছে কি না’। যদি তার নফল ছালাত থাকে তিনি বলবেন, ‘আমার বান্দার ফরযের ঘাটতিকে নফল দ্বারা পূর্ণ কর’। অতঃপর এভাবেই অন্যান্য আমলসমূহকে গ্রহণ করা হবে’।[2]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,فَإِنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأَنْجَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ- ‘তার ছালাত যদি সঠিক হয়, তাহ’লে সে সফলকাম ও কৃতকার্য হবে। আর তা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহ’লে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।[3] অর্থাৎ ছালাত যদি শুদ্ধ হয়, রুকূ, সিজদা, ক্বিয়াম-কুঊদ, খুশু-খুযূ সহ সময় মত আদায় করে। আর যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তথা আদায় করেনি অথবা অশুদ্ধ হয়েছে অথবা গৃহীত হয়নি, তাহ’লে সে ছওয়াব লাভে ব্যর্থ হবে এবং শাস্তি ভোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আর বান্দার হকগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম বিচার করা হবে অন্যায় রক্তপাত বা হত্যার। যেমন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ الصَّلَاةُ، وَأَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ فِي الدِّمَاءِ- ‘সর্বপ্রথম বান্দার ছালাতের হিসাবে নেয়া হবে। আর মানুষের পরস্পরের মাঝে সর্বপ্রথম বিচার করা হবে রক্তপাত বা অন্যায় হত্যার’।[4] উল্লেখ্য, হাদীছের আলোকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর হক ও বান্দার হকের মধ্যে সর্বপ্রথম আল্লাহর হকের হিসাব নেয়া হবে।
৩. পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে :
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ-
‘ক্বিয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত আদম সন্তানের পা তার রবের নিকট হ’তে নড়বে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, সে তা কিভাবে কাটিয়েছে। তার যৌবনকাল সম্পর্কে, সে তা কিভাবে শেষ করেছে। তার সম্পদ সম্পকে,র্ সে তা কোথা হ’তে উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে। আর সে যে জ্ঞান অর্জন করেছে, সে বিষয়ে কি আমল করেছে’।[5]
৪. আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতগুলি সম্পর্কে :
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে দুনিয়াতে অসংখ্য নে‘মত দান করেছেন। তিনি বলেন, وَإِن تَعُدُّوْا نِعْمَةَ اللهِ لَا تُحْصُوْهَا ‘তোমরা যদি আল্লাহর নে‘মতকে গণনা কর, তাহ’লে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না’ (নাহল ১৬/১৮)। আর এ সকল নে‘মত সম্পর্কে তিনি তাঁর বান্দাদের জিজ্ঞেস করবেন, যাতে সে তা স্বীকৃতি দেয় এবং এর হক আদায় করেছে কি না তা জানতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন,ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ ‘তোমরা সেদিন অবশ্যই নে‘মতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (তাকাছুর ১০২/৮)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) একদা দিনে অথবা রাতে বেরিয়ে পড়েন। হঠাৎ আবু বকর ও উমরের সাথে তার দেখা হল। তিনি তাদের দু’জনকে বললেন, ‘কোন প্রয়োজন তোমাদেরকে এই সময়ে বাড়ি থেকে বের করেছে’? তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্ষুধা। তিনি বললেন, ‘আমিও তাই। সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আমাকে সে জিনিসই ঘর থেকে বের করেছে যা তোমাদেরকে বের করেছে। চল দেখি’। ফলে তাঁরাও তাঁর সাথে চলতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তারা একজন আনছারী লোকের বাড়িতে এসে পৌঁছলেন। দেখলেন তিনি বাড়িতে নেই। তবে তার স্ত্রী রাসূল (ছাঃ)-কে দেখতে পেয়ে বললেন, মারহাবা! সুস্বাগতম! রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, অমুক কোথায়? তিনি বললেন, আমাদের জন্য সুস্বাদু পানি আনতে গেছেন। ঠিক তখনি আনছারী লোকটি আসলেন। এসে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দুই সাথীকে দেখে বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ! আজ আমার চেয়ে সম্মানিত অতিথি আর কেউ পায়নি। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তিনি গিয়ে এক গুচ্ছ ফল নিয়ে এলেন, যাতে রয়েছে শুকনো, পাকা ও কাঁচা খেজুর। তারপর বললেন, আপনারা এগুলি থেকে খেতে থাকুন। এই বলে তিনি ছুরি নিলেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘সাবধান দুধওয়ালা (ছাগল) যবাই করো না’। তিনি তাঁদের জন্য (ছাগল) যবেহ করলেন এবং তারা সেই ছাগলের গোস্ত ও থোকা থেকে ফল খেলেন এবং পানও করলেন। যখন তারা তৃপ্ত ও পিপাসামুক্ত হ’লেন, তখন রাসূল (ছাঃ) আবূ বকর ও উমরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা এই নে‘মত সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করেছিল, অতঃপর তোমরা ফেরার পূর্বেই এই নে‘মত পেয়ে ধন্য হ’লে’।[6]
তিরমিযীতে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَالََّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مِنَ النَّعِيمِ الَّذِي تُسْأَلُونَ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ظِلٌّ بَارِدٌ وَرُطَبٌ طَيِّبٌ وَمَاءٌ بَارِدٌ. ‘সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন যে সকল নে‘মত সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে তা হ’ল, শীতল ছায়া, পবিত্র খেজুর ও ঠান্ডা পানীয়’।[7]
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ أَوَّلَ مَا يُسْأَلُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِي الْعَبْدَ مِنْ النَّعِيمِ أَنْ يُقَالَ لَهُ أَلَمْ نُصِحَّ لَكَ جِسْمَكَ وَنُرْوِيَكَ مِنْ الْمَاءِ الْبَارِدِ. ‘নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন বান্দা সর্বপ্রথম যে নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে তা হ’ল তাকে বলা হবে, আমরা কি তোমার শরীরকে সুস্থ রাখিনি এবং ঠান্ডা পানি দ্বারা তোমাকে পরিতৃপ্ত করিনি’?[8]
আর নে‘মতের হক হ’ল এর শুকরিয়া আদায় করা, অর্থাৎ আল্লাহর নে‘মত সম্পর্কে বলা, তাঁর আনুগত্যে এবং বৈধ কাজে সেগুলিকে ব্যবহার করা। যদি কোন ব্যক্তি এগুলি করে, তাহ’লে সে যেন এসবের হক আদায় করল এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। সে আল্লাহর সন্তষ্টি লাভেও ধন্য হবে। আর যদি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে, তাহ’লে সে যেন নে‘মতকে অস্বীকার করল। আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الله لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَأْكُلَ الأَكْلَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا، أَوْ يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا. ‘আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ বান্দার ওপর অবশ্যই সন্তষ্ট হন, যে কোন খাদ্য খেলে এর জন্য তাঁর প্রশংসা করে। অথবা কোন পানীয় পান করলে এর জন্য তাঁর প্রশংসা করে’।
৫. ইলম, শ্রবণ, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে :
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولًا ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, হৃদয় প্রত্যেকটির বিষয়ে তোমরা (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৬)
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, لا تقل رأيت ولم تر، وسمعت ولم تسمع، وعلمت ولم تعلم، فإن الله تعالى سائلك عن ذلك كله ‘তুমি বল না যে, আমি দেখেছি অথচ আদৌ দেখনি। আমি শুনেছি অথচ আদৌ শুননি। আমি জানি অথচ জানো না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এসবকিছু সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করবেন’।
কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর এসবকিছুই মহান রবের দেয়া বড় নে‘মত। আর এগুলি সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন আমাদের জিজ্ঞেস করা হবে, সেগুলি কি আল্লাহর আনুগত্যে ও সৎকাজে ব্যবহার করে এগুলির শুকরিয়া আদায় করা হয়েছে, না এগুলি আল্লাহর অবাধ্য ও পাপাচারের কাজে লাগানো হয়েছে? সুতরাং এগুলির সদ্ব্যবহার করতঃ শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কিন্ত অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে গাফেল। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ هُوَ الَّذِي أَنشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَّا تَشْكُرُونَ ‘বল, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দান করেছেন কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়। কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (মুল্ক ৬৭/২৩)
৬. জিহাদ, ইলম ও সম্পদের মত তিনটি বড় নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে :
ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে আল্লাহ প্রদত্ত যে সকল বড় নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তন্মধ্যে রয়েছে ইলম, সম্পদ ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। তার কাছে জানতে চাওয়া হবে, সে এগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহর যে হক রয়েছে তা যথাযথ আদায় করেছে কি-না? সে কি এগুলির হেফাযত করেছে, না সেগুলি নষ্ট করেছে? আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে লোকটির ফায়ছালা করা হবে সে হ’ল একজন শহীদ। তাকে নিয়ে আসা হবে। তাকে তার নে‘মতগুলি স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে এবং সেও তা চিনতে পারবে। আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি এবিষয়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি তোমার রাস্তায় যুদ্ধ করেছি, এমনকি শাহাদত বরণও করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি যুদ্ধ করেছ এজন্য যে, তোমাকে যেন বীর বলা হয়। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেয়া হবে তাকে টেনেহেঁচড়ে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে। ফলে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আর এক ব্যক্তি যে জ্ঞান অর্জন করেছে এবং তা অন্যকে শিক্ষাও দিয়েছে। আর সে কুরআন তিলাওয়াত করতো। তাকে নিয়ে আসা হবে। তিনি তাকে তার নে‘মতগুলি স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সে তা স্মরণ করবে। তিনি তাকে বলবেন, তুমি এসব নে‘মতের কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি এবং তা অন্যকেও শিক্ষা দিয়েছি। তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন তিলাওয়াতও করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি জ্ঞান অর্জন করেছ যাতে তোমাকে বলা হয় সে আলিম এবং কুরআন পড়েছ যাতে তোমাকে বলা হয় সে ক্বারী। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেয়া হবে তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে, ফলে তাই করা হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ অনেক প্রাচুর্য দান করেছেন। সর্বপ্রকার সম্পদ তাকে দিয়েছেন। তাকেও নিয়ে আসা হবে। তাকে তার নে‘মতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে এবং সেও তা স্মরণ করবে। তাকে বলবেন, তুমি এসবের ব্যাপারে কি আমল করেছ? সে বলবে, যে পথে খরচ করলে তুমি সন্তষ্ট হও এমন সব ক্ষেত্রে আমি তোমার সন্তষ্টির জন্যে খরচ করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি তা করেছ যাতে তোমাকে বলা হয় দানবীর। সুতরাং তা বলা হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেয়া হবে তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে, ফলে তাই করা হবে’।[9]
৭. অঙ্গীকার সম্পর্কে :
ক্বিয়ামতের দিন আমাদের দেয়া অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,وَأَوْفُواْ بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُولًا ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৪)। তিনি আরো বলেন,وَلَقَدْ كَانُوا عَاهَدُوا اللهَ مِن قَبْلُ لَا يُوَلُّونَ الْأَدْبَارَ وَكَانَ عَهْدُ اللهِ مَسْؤُولًا- ‘অথচ তারা ইতিপূর্বে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। বস্ত্ততঃ আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে’ (আহ্যাব ৩৩/১৫)
৮. কুফর ও শিরক সম্পর্কে :
দুনিয়াতে যারা কুফরী করে ও আল্লাহর সাথে শরীক করে, তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। মহান আল্লাহ্ বলেন,تَاللهِ لَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنتُمْ تَفْتَرُونَ  ‘আল্লাহর কসম! তোমরা যে মিথ্যা উদ্ভাবন কর, সে বিষয়ে অবশ্যই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (নাহল ১৬/৫৬)
তিনি আরো বলেন,ثُمَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُخْزِيهِمْ وَيَقُولُ أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنتُمْ تُشَاقُّونَ فِيهِمْ قَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ إِنَّ الْخِزْيَ الْيَوْمَ وَالسُّوءَ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘এরপর ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাদের লাঞ্ছিত করবেন এবং বলবেন, কোথায় আমার শরীকরা যাদের কারণে তোমরা (আমাদের নবীদের সঙ্গে) শত্রুতা করতে? তখন (ফেরেশতা বা মুমিনগণ) যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তারা বলবে, নিশ্চয়ই সকল লাঞ্ছনা ও অমঙ্গল আজ কেবল কাফেরদের জন্যই’ (নাহল ১৬/২৭)
৯. ফেরেশতাগণের প্রতি মিথ্যারোপ সম্পর্কে :
দুনিয়াতে এক শ্রেণীর মানুষ ফেরেশতাগণের প্রতি মিথ্যারোপ করে এবং তাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলে, তারা নাকি নারী জাতি। এমনকি তারা তাদেরকে আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করে। ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। এমর্মে মহান আল্লাহ্ বলেন,وَجَعَلُوا الْمَلَائِكَةَ الَّذِينَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَنِ إِنَاثًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ ‘আর তারা ফেরেশতাদের নারী গণ্য করে, যারা দয়াময়ের বান্দা। তবে কি তারা তাদের সৃষ্টির সময় উপস্থিত ছিল? তাদের (এখনকার) সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হবে এবং (কিয়ামতের দিন) তারা জিজ্ঞাসিত হবে’ (যুখরুফ ৪৩/১৯)
১০. রাসূলগণের দাওয়াতে সাড়া দেয়া সম্পর্কে :
আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাঁদের উম্মতদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তারা তাঁদের দাওয়াত কবুল করেছে কি-না? এমনকি তিনি তাঁর রাসূলগণকেও জিজ্ঞেস করবেন, তাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত রিসালতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন কি-না? তাঁরা স্বীয় উম্মতদের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছেন কি-না? মহান আল্লাহ বলেন, ماذا أجبتم المرسلين. ‘সেদিন তাদের ডেকে আল্লাহ বলবেন, নবীদের আহবানে তোমরা কিরূপ সাড়া দিয়েছিলে?’ (ক্বাছাছ ২৮/৬৫)
তিনি আরো বলেন,فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ. ‘অতঃপর যাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল তাদেরকে এবং রাসূলগণকে অবশ্যই আমরা (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসাবাদ করব’ (আ‘রাফ ৭/৬)
এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু জারীর ত্বাবারী (রহঃ) বলেন, ‘যাদের নিকট আমি আমার রাসূলগণকে পাঠিয়েছি তাদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করব, আমার পক্ষ থেকে রাসূলগণ তাদের নিকট যে আদেশ-নিষেধ নিয়ে এসেছিলেন, তারা তা অনুযায়ী কি আমল করেছে? আমি তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছি তারা কি তা পালন করেছে, আমি যা থেকে তাদেরকে নিষেধ করেছিলাম তারা কি তা থেকে বিরত থেকেছে এবং আমার আনুগত্য মেনে নিয়েছে? না তারা আমার অবাধ্য হয়েছে এবং সেগুলির বিরোধিতা করেছে? আমি যে সকল রাসূলগণকে উম্মতদের নিকট পাঠিয়েছি তাঁদেরকেও জিজ্ঞেস করব, তাঁরা কি তাদের নিকট আমার রিসালত পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে আমি যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম তা কি আদায় করেছেন, না তাঁরা এ ব্যাপারে কমতি করেছেন, ফলে তাঁরা অবহেলা করেছেন এবং তাদের নিকট তা পৌঁছে দেননি’?[10]
পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা যেন আমাদেরকে দ্বীনের ওপরে চলা এবং খাঁটি মুসলিম ও মুমিন হয়ে মৃত্যুবরণ করার তাওফীক্ব দান করেন। সৎ আমল করা এবং কবর সহ পরকালের সকল স্তরে হিসাব সহজ করে দেন। ক্বিয়ামতের দিন যাবতীয় ফিৎনা থেকে আমাদের রক্ষা করে পুলছিরাত পার হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন। তার অশেষ রহমতে আমাদেরকে তাঁর জান্নাত লাভে ধন্য করেন-আমীন।
 মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান

[1]. আবূদাউদ হা/৪৪৫৩; তিরমিযী হা/৩১২০, সনদ ছহীহ।
[2]. আবূদাউদ হা/৮৬৪, সনদ ছহীহ।
[3]. তিরমিযী হা/৪১৩; নাসাঈ হা/৪৬৫; মিশকাত হা/১৩৩০, সনদ ছহীহ।
[4]. নাসাঈ হা/৩৯৭১; ছহীহাহ হা/১৭৪৮; ছহীহুল জামে হা/২৫৭২।
[5]. তিরমিযী হা/২৪১৬; মিশকাত হা/৫১৯৭; ছহীহাহ হা/৯৪৬।
[6]. মুসলিম হা/২০৩৮; মিশকাত হা/৪২৪৬।
[7]. তিরমিযী হা/২৩৬৯; ছহীহাহ হা/১৬৪১।
[8]. তিরমিযী হা/৩৩৫৮; ছহীহাহ হা/৫৩৯; মিশকাত হা/৫১৯৬।
[9]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত হা/২০৫।
[10]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১২/৩০৫-৩০৬ পৃঃ।


বিনা ঔষুধে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, যৌনসমস্যা, অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়া সহ আরও অনেক রোগের সমাধান

রবিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
ডা: জাহাঙ্গীর কবির স্যার




সূরা ফাতিহার ফযীলত :

রবিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
সূরা ফাতিহার ফযীলত :
ভূমিকা :
আল-কুরআন আল্লাহ্র বাণী, যা জিবরাঈল (আঃ) মারফত সুদীর্ঘ ২৩ বছরে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়। আল-কুরআনকে আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির দিশারী বা পথপ্রদর্শক রূপে নাযিল করেছেন। আল-কুরআনের ভূমিকা হ’ল সূরাতুল ফাতিহা। এটিকে আবার আল-কুরআনের সারসংক্ষেপও বলা হয়। তাই সূরা ফাতিহা পবিত্র কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। আলোচ্য নিবন্ধে এ সূরার ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
সূরা আল-ফাতিহার নামকরণ : পবিত্র কুরআনের সূরাগুলোর নামকরণ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত বিষয়। মূলত এ নামগুলো গোটা সূরার নিদর্শন বা প্রতীক মাত্র। পবিত্র কুরআনের সূরাগুলোকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং এক সূরাকে অন্য সূরা থেকে পৃথককরণের লক্ষ্যে একটি বিশেষ নাম দেয়া হয়েছে। সূরা ফাতিহার নামও অনুরূপ একটি। যা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই রাখা হয়েছে। সূরা ফাতিহার অনেক নাম রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হ’ল :
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, সূরাটির নাম ‘উম্মুল কিতাব’ এজন্য রাখা হয়েছে যে, এই সূরার মাধ্যমেই পবিত্র কুরআনের সংকলনকার্য শুরু করা হয়েছে এবং এই সূরা পাঠের মাধ্যমে ছালাত আদায় করা হয়ে থাকে।[1] সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন এজন্য বলা হয়েছে যে, এটা দিয়েই কুরআন শুরু হয়েছে এবং এর মধ্যে সমস্ত ইল্ম শামিল রয়েছে’ (কুরতুবী)। ‘ফাতিহাতুল কিতাব’ ‘উম্মুল কুরআন’ ‘আস-সাব‘উল মাছানী’সহ এই সূরার অন্যূন ৩০টি নাম পবিত্র কুরআন ও বিভিন্ন হাদীছে ছহীহ ও মুরসাল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- ফাতিহাহ্, ফাতিহাতুল কিতাব, ফাতিহাতুল কুরআন, উম্মুল কিতাব, উম্মুল কুরআন, আসাসুল কুরআন, সূরাতুল হাম্দ, শুক্র, কাফিয়াহ, ওয়াফিয়াহ, আস-সাব‘উল মাছানী, মিন্নাহ, দু‘আ, আল-কুরআনুল ‘আযীম[2], সাওয়াল, মুনাজাত, তাফভীয, মাসআলাহ, শিফা, শা-ফিয়াহ[3], রুক্বিয়াহ, রা-ক্বিয়াহ, ছালাত, কান্য, নূর, ওয়াক্বিয়াহ, আল-হাম্দুলিল্লাহ, ইল্মুল ইয়াক্বীন, সূরাতুল হাম্দিল ঊলা, সূরাতুল হাম্দিল কুছরা। উল্লেখ্য, ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত সূরা ফাতিহার নাম সমূহ হচ্ছে- (১) সূরাতুল হামদ (২) উম্মুল কুরআন (৩) উম্মুল কিতাব (৪) আস-সাব‘উল মাছানী (৫) সূরাতুছ ছালাত (৬) আল-কুরআনুল আযীম (৭) সূরাতুল ফাতিহা (৮) সূরাতুর রুকইয়া।[4] প্রকাশ থাকে যে, পবিত্র কুরআনের সূরা সমূহের এক বা একাধিক নামকরণ, মাক্কী ও মাদানী সূরার আগে পিছে সংযোজন ও আয়াত সমূহের বিন্যস্তকরণ সবকিছু ‘তাওক্বীফী’ অর্থাৎ আল্লাহ্র ‘অহি’ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট ও রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সন্নিবেশিত, যা অপরিবর্তনীয়।[5]
সূরা ফাতিহার বৈশিষ্ট্য :
সূরা আল-ফাতিহা কুরআনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূরা। প্রথমত এ সূরা দ্বারাই পবিত্র কুরআন মাজীদ আরম্ভ হয়েছে এবং এ সূরা দ্বারাই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত ছালাত আরম্ভ হয়। অবতরণের দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এটিই প্রথম নাযিল হয়। সূরা আলাক্ব, মুযযাম্মিল ও সূরা মুদ্দাছছিরের ক’টি আয়াত অবশ্য সূরা ফাতিহার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এ সূরার অবতরণই সর্বপ্রথম।
কুরআনের অবশিষ্ট সূরাগুলো প্রকারান্তরে সূরা ফাতিহারই বিস্তারিত ব্যাখ্যা। কারণ সমগ্র কুরআন প্রধানতঃ ঈমান এবং নেক আমলের আলোচনাতেই কেন্দ্রীভূত। আর এ দু’টি মূলনীতিই এ সূরায় সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এ সূরাকে ছহীহ হাদীছে উম্মুল কুরআন, উম্মুল কিতাব, কুরআনে আযীম বলেও অভিহিত করা হয়েছে’।[6] এ সূরার আরো কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নে পেশ করা হ’ল।-
(১) এই সূরা কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদামন্ডিত সূরা। তাওরাত, যবূর, ইনজীল, কুরআন কোন কিতাবে এই সূরার তুলনীয় কোন সূরা নেই।[7]
(২) এই সূরা এবং সূরায়ে বাক্বারাহ্র শেষ তিনটি আয়াত হ’ল আল্লাহ্র পক্ষ হ’তে প্রেরিত বিশেষ নূর, যা ইতিপূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি।[8]
(৩) যে ব্যক্তি ছালাতের মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার ছালাত অপূর্ণাঙ্গ (خِدَاجٌ)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই কথাটি তিনবার বলেন। রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, যখন আমরা ইমামের পিছনে থাকি? জওয়াবে তিনি বলেন, ‘তুমি তখন ওটা চুপে চুপে পড়’।[9] ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘এই সূরার নাম ‘ছালাত’ (الصلاة) বলা হয়েছে একারণে যে, ছালাতের জন্য এটি পাঠ করা শর্ত’ (ঐ, তাফসীর)
(৪) আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, একদা এক সফরে আমাদের এক সাথী জনৈক গোত্রপতিকে শুধুমাত্র সূরায়ে ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিয়ে সাপের বিষ ঝাড়েন ও তিনি সুস্থ হন…[10] এজন্য এ সূরাকে রাসূল (ছাঃ) ‘রুক্বইয়াহ’ (الرُّقْيَةُ) বলেছেন।[11]
(৫) ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-কুরতুবী (মৃঃ ৬৭১হিঃ) বলেন, সূরায়ে ফাতিহাতে যে সকল ‘ছিফাত’ রয়েছে, তা অন্য কোথাও নেই। এমনকি একেই ‘আল-কুরআনুল আযীম’ বা মহান কুরআন বলা হয়েছে (হিজর ১৫/৮৭)।
এই সূরার  ২৫টি কালেমা কুরআনের যাবতীয় ইল্মকে শামিল করে। এই সূরার বিশেষ মর্যাদা এই যে, আল্লাহ এটিকে নিজের ও নিজের বান্দার মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। একে বাদ দিয়ে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। সেজন্যই একে ‘উম্মুল কুরআন’ বা ‘কুরআনের সারবস্ত্ত’ বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন মূলতঃ তিনটি বিষয়ে বিভক্ত। তাওহীদ, আহকাম ও নছীহত। সূরায়ে ইখলাছে ‘তাওহীদ’ পূর্ণাঙ্গভাবে থাকার কারণে তা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু সূরায়ে ফাতিহাতে তিনটি বিষয় একত্রে থাকার কারণে তা ‘উম্মুল কুরআন’ হওয়ার মহত্তম মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছে।[12]
সূরা ফাতিহার ফযীলত :
এ সূরার ফযীলত অপরিসীম। এর ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি এখানে পেশ করা হ’ল-
(১) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ উম্মুল কুরআনের মত তাওরাত ও ইঞ্জীলে কিছু্ নাযিল করেননি। এটিকেই বলা হয়, ‘আস-সাব‘উল মাছানী’ (বারবার পঠিত সাতটি আয়াত), যাকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। আর আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, সে যা চাইবে’।[13]
(২) সাঈদ ইবনু মু‘আল্লা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি মসজিদে ছালাত আদায় করছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ডাক দিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন না। অতঃপর ছালাত শেষে এসে বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আমি ছালাত আদায় করছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ কি বলেননি, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও, যখন তোমাদেরকে ডাকা হয়?’ (আনফাল ২৪)। অতঃপর আমাকে বললেন, মসজিদ থেকে তোমার বের হওয়ার পূর্বেই আমি তোমাকে অবশ্যই কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি শিক্ষা দিব। অতঃপর তিনি আমার হাত ধরলেন। যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হ’তে চাইলেন, তখন আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, আপনি কি আমাকে বলেননি যে, তোমাকে আমি কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি শিক্ষা দিব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সূরাটি হচ্ছে الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ এটিই সাবউল মাছানী এবং কুরআনুল আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে’।[14]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করল, আর সূরা ফাতিহা পড়ল না তার ছালাত অসম্পূর্ণ, কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। ছালাত সম্পূর্ণ নয়। বলা হ’ল, হে আবু হুরায়রা! আমরা কোন কোন সময় ইমামের পিছনে থাকি। তিনি বললেন, আপনি মনে মনে পড়ুন। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ বলেন, আমি ছালাতকে আমার মাঝে ও আমার বান্দার মাঝে ভাগ করে দিয়েছি। অর্ধেক আমার আর অর্ধেক আমার বান্দার। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা সূরা ফাতিহা পড়। কোন বান্দা যখন বলে, আলহামদুলিল্লাহি রাবিবল আলামীন, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। যখন বলে, আর-রহমা-নির রহীম, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে। বান্দা যখন বলে, মালিকি ইয়াউমিদ্দীন। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। বান্দা যখন বলে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ আল্লাহ বলেন, এ হচ্ছে আমার ও আমার বান্দার মাঝের কথা। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। বান্দা যখন বলে, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ، صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّيْنَ আল্লাহ বলেন, এসব হচ্ছে আমার বান্দার জন্য। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়’।[15]
(৪) ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের এক দল এক পানির কূপওয়ালাদের নিকট পৌঁছলেন, যাদের একজনকে বিচ্ছু অথবা সাপে দংশন করেছিল। কূপওয়ালাদের এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনাদের মধ্যে কোন মন্ত্র জানা লোক আছে কি? এ পানির ধারে বিচ্ছু বা সাপে দংশন করা একজন লোক আছে। ছাহাবীগণের মধ্যে একজন (আবু সাঈদ খুদরী) গেলেন এবং কতক ভেড়ার বিনিময়ে তার উপর সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিলেন। এতে সে ভাল হয়ে গেল এবং তিনি ভেড়াগুলি নিয়ে সাথীদের নিকট আসলেন। তারা এটা অপসন্দ করল এবং বলতে লাগল, আপনি কি আল্লাহ্র কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করলেন? অবশেষে তারা মদীনায় পৌঁছে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! তিনি আল্লাহ্র কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা যেসব জিনিসের বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তার মধ্যে আল্লাহ্র কিতাব অধিকতর উপযোগী’।[16] অন্য বর্ণনায় আছে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘তোমরা ঠিক করেছ। ছাগলের একটি ভাগ আমার জন্য রাখ’।[17]
(৫) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর নিকট গেলেন, এ সময় তিনি ছালাত আদায় করছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে ওবাই! তখন ওবাই (রাঃ) মুখ ফিরালেন, কিন্তু কোন সাড়া দিলেন না। অতঃপর ওবাই (রাঃ) হালকা করে ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ফিরে এসে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আস-সালামু আলাইকা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ওয়ালাইকাস সালাম। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে ওবাই! আমি যখন তোমাকে ডাকলাম, আমার ডাকে সাড়া দিতে তোমাকে বাধা দিল কে? ওবাই (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আমি ছালাতের মধ্যে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কেন আল্লাহ অহী করে তোমাদের যা বলেছেন, তা কি তুমি পড়নি? আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমাদের ডাকেন, তোমরা তাঁদের ডাকে সাড়া দাও’ (আনফাল ২৪)। ওবাই (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ হে আল্লাহ্র রাসূল (রাঃ)! আল্লাহ তো এভাবেই বলেছেন, আমি আর কখনও এ কাজ করব না। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি সূরা শিক্ষা দিব, যা (পূর্বে) কখনও নাযিল হয়নি। তাওরাতে হয়নি, যাবূরে হয়নি, ইঞ্জীলে হয়নি। অনুরূপ ফুরকান তথা কুরআন মাজীদেও নাযিল হয়নি। আমি বললাম, জি হ্যাঁ শিখিয়ে দিন হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি আশা রাখছি তুমি মসজিদ হ’তে বের হওয়ার পূর্বেই জানতে পারবে। ওবাই (রাঃ) বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার হাত ধরে হাদীছ বলতে লাগলেন, আর আমি বিলম্ব করছিলাম এই ভয়ে যে, তিনি কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই দরজায় পৌঁছে যাবেন। অতঃপর আমরা যখন দরজার নিকট গেলাম, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! সেই সূরাটি কি যা শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা করেছিলেন? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি ছালাতে কি পড়? ওবাই (রাঃ) বললেন, আমি তার সামনে উম্মুল কুরআন পড়লাম। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তাঁর কসম! আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফাতিহার মত কোন সূরা তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জীল ও ফুরকান নামক কোন গ্রন্থে অবতীর্ণ করেননি। নিশ্চয়ই সূরা ফাতিহা হচ্ছে সাবউল মাছানী’।[18]
(৬) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট জিবরাঈল (আঃ) ছিলেন, হঠাৎ জিবরাঈল (আঃ) উপর দিকে এক শব্দ শুনতে পেলেন এবং চক্ষু আকাশের দিকে করে বললেন, এ হচ্ছে আকাশের একটি দরজা যা পূর্বে কোনদিন খোলা হয়নি। সে দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হ’লেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, ‘আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। যা আপনাকে প্রদান করা হয়েছে। তা আপনার পূর্বে কোন নবীকে প্রদান করা হয়নি। তা হচ্ছে সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাক্বারার শেষ দু’আয়াত। তুমি সে দু’টি হ’তে কোন অক্ষর পড়লেই তার প্রতিদান তোমাকে প্রদান করা হবে’।[19]
উপসংহার : সূরা ফাতিহার সর্বাধিক পরিচিত নাম ‘সূরাতুল ফাতিহা’। তারপরও সূরা ফাতিহার স্থান, মর্যাদা, বিষয়বস্ত্ত, ভাবভাষা, প্রতিপাদ্য বিষয় ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে এর বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে এবং প্রত্যেক নামের সাথেই সূরাটির সামঞ্জস্য বিদ্যমান। এই সূরাটির ফযীলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকেই সূরা ফাতিহার প্রতি আমল করে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফীক দান করেন। আমীন!


* নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. তাফসীর কুরতুবী (বৈরুত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, ১৪২৪ হিঃ/২০০৪ খৃঃ), ১/১৫০।
[2]আহমাদ হা/৯৭৮৭, সনদ ছহীহ।
[3]মিশকাত হা/২১৭০, সনদ যঈফ।
[4]. আব্দুস সাত্তার দেহলভী, তাফসীরে সূরায়ে ফাতিহা (করাচী : মাকতাবা আইয়ূবিয়াহ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৩৮৫/১৯৬৫), পৃঃ ৬৮-৯২। গৃহীত : ‘খাযীনাতুল আসরার’, ‘আল-ইতক্বান’ ও ‘আদ-দীনুল খালিছ’।
[5]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২০৯৮-৯৯; বুখারী হা/৪৫৩৬; তাফসীর কুরতুবী ১/৬০।
[6]কুরতুবী ১/১৪৮-৪৯
[7]. আহমাদ, বুখারী, তিরমিযী, মিশকাত হা/২১৪২।
[8]. মুসলিম হা/৮০৬ অধ্যায়-৬, ‘সূরা ফাতিহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৪৩, মিশকাত হা/২১২৪।
[9]. মুসলিম, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২৩।
[10]বুখারী হা/৫৪০৫।
[11]. বুখারী হা/৫৭৩৬, মুসলিম হা/২২০১ ‘সালাম’ অধ্যায়; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর।
[12]. তাফসীর কুরতুবী ১/১৪৮-৪৯।
[13]নাসাঈ হা/৯১৪; আহমাদ; ৮৪৬৭; তিরমিযী হা/৩১২৫; দারেমী হা/৩৩৭৩
[14]. নাসাঈ হা/৯১৪; আবুদাঊদ হা/১৪৫৮; ইবনু মাজাহ হা/৩৭৮৫; আহমাদ হা/১৫৩০৩; দারেমী হা/১৪৯২
[15]মুসলিম হা/৩৯৫; আবুদাঊদ হা/৮২১; তিরমিযী হা/২৯৫৩; ইবনু মাজাহ হা/৮৩৬
[16]বুখারী হা/৫৪০৫
[17]বুখারী হা/২২৭৬; মুসলিম হা/২২০১
[18]তিরমিযী হা/২৮৭৫
[19]মুসলিম হা/৮০৬; ইবনু হিববান হা/৭৭৮

https://www.printfriendly.com/p/g/GZpueA



ফটো গ্যালারী

1/6
ওহুদ যুদ্ধ - হযরত মহাম্মদ (সা:) এর বিপ্লবী জীবন
2/6
মুসলিম নারীর বিধান
3/6
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা
4 / 6
ইসলামীক জিজ্ঞাসাঃ লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
5/6
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
6/6
উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব

Islam-icon Profile.png