LIVE
Loading latest headlines...

বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০ 0
বার দেখা হয়েছে

  

০১.    অর্থ কী?
‘অর্থ’ শব্দের একটি অর্থ উদ্দেশ্যে বা তাৎপর্য হলেও এখানে অর্থ মানে- ধন দৌলত, পয়সা কড়ি, বিত্ত সম্পত্তি, বিষয় ঐশ্বর্য, সংগতি, পূঁজি। জীবিকা, জীবনোপকরণ, সহায় সম্বল, অবলম্বন।
ইংরেজি ভাষায় অর্থকে বলা হয় wealth, money.
আরবি ভাষায় অর্থ সম্পদ, জীবিকা, জীবন-সামগ্রী ইত্যাদি বুঝানোর জন্যে ব্যবহার হয়- مَالٌ (মাল) বহুবচনে  اَمْوَالٌ। এছাড়া مَتَاعٌ (মাতা’) رِزْقٌ (রিয্ক) শব্দগুলোও ব্যবহার করা হয়। কুরআনে অর্থ সম্পদ ও জীবিকা বুঝানোর জন্যে উক্ত শব্দগুলো ছাড়াও রূপক অর্থে فَضْلُ الله (আল্লাহ্র অনুগ্রহ) এবং نِعْمَةُ اللهِ (আল্লাহ্র দান) শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।
মূলত জীবন ধারণ ও জীবন যাপনের জন্যে মানুষের যেসব উপায় উপকরণ এবং সহায় সম্বল প্রয়োজন হয় সেগুলোকে বা সেগুলোর বিকল্পকেই অর্থ সম্পদ বা জীবিকা বলা হয়।

০২.    অর্থনীতি কী?
অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ণয় করা কঠিন। অর্থনীতি যেহেতু একটি সামাজিক বিজ্ঞান, তাই সমাজ বিশ্লেষণের বিভিন্ন দৃষ্টিভংগিতে সমাজ বিজ্ঞানীগণ অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। সমাজ কাঠামোর একটি ধারা হলো অর্থনৈতিক ধারা। এ ধারার যারা বিশেষজ্ঞ পন্ডিত, তাদের মধ্যে এ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith ), অধ্যাপক মর্শাল (Prof. Marshall), অধ্যাপক এল. রবিন্স (Prof. L. Robbins), জন স্টুয়ার্ট মিল, কেয়ার্নক্রস, অধ্যাপক ক্যানান, স্যামুয়েলসন প্রমূখ অর্থনীতির বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
এ্যাডাম স্মিথের মতে: “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে।”
অধ্যাপক মর্শালের মতে : “অর্থনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে।”
অধ্যাপক ক্যানান বলেন: “অর্থনীতি হলো মানুষের বস্তুগত কল্যাণের কারণ অনুসন্ধানকারী বিষয়।”
কোয়র্নক্রস বলেন: “মানুষের কার্যক্রমের যে অংশ অর্থের সাথে জড়িত, তার আলোচনাই অর্থনীতির বিষয়বস্তু।”
মূলত: অর্থ সংগ্রহ, অর্জন, আহরণ, বৃদ্ধি, বন্টন, ভোগ, ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে চর্চা, শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা এবং এ সবের নিয়মনীতির শাস্ত্রকেই অর্থ শাস্ত্র, অর্থ বিদ্যা, অর্থবিজ্ঞান, অর্থতত্ত্ব বা অর্থনীতি (economics) বলা হয়।
অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতিকে ইতিবাচক এবং নীতিবাচক-এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদগণ বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
ইতিবাচক পন্থীরা বলতে চান : যা আছে, যা হচ্ছে, এবং যা ঘটছে, তার সমাধান নির্দেশনাই অর্থনীতির কাজ।
নীতিবাচক পন্থীরা বলতে চান: কী হওয়া উচিত, আর কী হওয়া উচিত নয় এবং কী করা উচিত, আর কী করা উচিত নয়, সেই নির্দেশনা প্রদানই অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।

০৩.    অর্থনীতির ইসলামি সংজ্ঞা
ইসলাম অর্থনীতির আলাদা অস্বাভাবিক কোনো সংজ্ঞা প্রদান করেনা। ইসলাম বলে: সম্পদের মূল মালিক মহান আল্লাহ, মানুষ সম্পদের আমানতদার এবং অর্থ মানব জীবনের অখন্ড ও অবিভাজ্য বিষয় সমূহের একটি মাত্র। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে : “আল্লাহ নির্দেশিত জীবন দর্শনের ভিত্তিতে মানুষের জীবিকা আহরণ, আহরিত সম্পদের ন্যায্য বন্টন এবং সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যয় ও ভোগ ব্যবহারের নির্দেশনাই অর্থনীতি।” আমাদের মতে এটাই অর্থনীতির সঠিক সংজ্ঞা হওয়া উচিত। ইসলামি অর্থনীতি একই সাথে ইতিবাচক এবং নীতিবাচক। ইসলামি অর্থনীতিতে উন্নয়ন ও সমস্যার সমাধান নির্দেশনা প্রদান করা হয় আদর্শ ও ন্যায় নীতির ভিত্তিতে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. এম. নেজাতুল্লাহ সিদ্দীকির মতে : Islamic economics is the Muslim thinkers’ response to the economic challenges of their times. In this endeavour they are aided by the Quran and the Sunnah as well as by reason and experience. (Lectures on Islamic Economic Thoughts, IRTI, Islamic Development Bank, Jeddah, 1992, P 69)

০৪.    ইসলামি অর্থব্যবস্থার ভিত্তি
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার মতোই অর্থব্যবস্থাও তিনটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো :
১.    দর্শনগত ভিত্তির উপর পরিচালিত হওয়া।
২.    মাকাসিদে শরিয়া (শরিয়ার উদ্দেশ্য সমূহ) অর্জনের জন্যে তৎপর থাকা।
৩.    হিকমা বা কর্মকৌশল ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ।
১. দর্শনগত ভিত্তির অর্থ: দর্শনগত ভিত্তি বলতে বুঝায় বিশ্বাস ও আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া দৃষ্টিভংগি ও ধ্যান ধারণা। ইসলামি জীবন ব্যবস্থার দর্শনগত ভিত্তি তিনটি। সেগুলো হলো :
১.    তাওহীদ (আল্লাহ্র একত্ব এবং এক আল্লাহ্র দাসত্ব ও আনুগত্য)।
২.    খিলাফত (প্রতিনিধিত্ব অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি)।
৩.    আদল (ন্যায়, নায্য ও সুষমনীতি; Justice)।
এই তিনটি মূলনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এক আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাসই মানব জীবনে শক্তি ও প্রেরণার মূল উৎস। তাঁকে মহাবিশ্বের স্রষ্টা, মালিক ও পরিচালক মেনে নিয়ে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের জীবন যাপন করাই মানব জীবন সাফল্যের একমাত্র করিডোর। এই পৃথিবী এবং মানুষ তাঁর সৃষ্টির একটি অংশ মাত্র। তিনি কোনো কিছুই অর্থহীন সৃষ্টি করেননি। মানুষের ইহকালীন কর্মতৎপরতাকে তিনি পরকালীন সাফল্যের ভিত্তি বানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং মানুষকে সাফল্যের জন্যে অবশ্যি তাঁর প্রদত্ত বিধানমতো চলতে হবে এবং শুধুমাত্র তাঁরই কাছে চাইতে হবে।
ইসলামে খিলাফতের ধারণাও বিশ্বজনীন। মানুষ পৃথিবীর মূল কর্তা নয়। পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। পৃথিবীর সম্পদ ও কর্তৃত্ব মানুষের কাছে আল্লাহর আমানত। সব মানুষ এক আদমের সন্তান। সুতরাং ক্ষমতা ও সম্পদশালী ব্যক্তিদের দায়িত্ব হলো সকল মানুষের কল্যাণে নিজেদের ক্ষমতা ও সম্পদকে নিবেদিত করা। খিলাফতের মূল স্পীরিট হলো :
১.    বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব বোধ : সব মানুষ একই সূত্রে গাঁথা। সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি। সবাই এক আদমের সন্তান।
২.    মানবতার প্রতি সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ।
৩.    ক্ষমতা ও ধনসম্পদ তার কাছে আল্লাহ্র গচ্ছিত আমানত। এগুলোকে মানব কল্যাণে নিয়োজিত করাই তার মূল দায়িত্ব।
৪.    বিনয় ও আনুগত্য। যেহেতু মানুষ পৃথিবীতে কোনো কিছুরই মালিক নয়, আমানতদার, তাই মূল মালিকের প্রতি আনুগত্য এবং বিনয়ী জীবন যাপন করাই তার কর্তব্য।
আদল কথাটিও ব্যাপক অর্থবোধক। এর ইংরেজি অনুবাদ Justice. বাংলায় ন্যায়, নায্য ও সুষমনীতি ও আচরণ বলা যায়। এর তাৎপর্য হলো, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের শক্তি, ক্ষমতা ও সম্পদ মানব কল্যাণে নিয়োজিত করবে। সে তার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে ন্যায়, ইনসাফ, সুবিচার ও কল্যাণ কামনা দ্বারা তাড়িত হবে।
অর্থনীতিসহ ইসলামের সকল কাজে এই তিনটি বিশ্বাস ও চিন্তাগত ভাবধারা মানবদেহের অভ্যন্তরে শোনিত ধারার মতো প্রবহমান থাকতে হবে।
২. মাকাসিদে শরিয়া (objectives of shariah) : মাকাসিদ শব্দটি বহুবচন। এর একবচন মাকসাদ। মাকসাদ মানে- উদ্দেশ্য (objective)। ইসলামের ভিত্তিতে জীবন যাপনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা যে নিয়ম কানুন ও বিধি বিধান প্রদান করেছেন, তা-ই একমাত্র মানব কল্যাণের শরিয়া। মানুষের ইহ জাগতিক এবং পারলৌকিক সার্বিক কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যেই মহান আল্লাহ শরিয়া প্রদান করেছেন। ইসলামি শরিয়ার মূল উৎস (source) হলো আল কুরআন ও সুন্নতে রসূল সা.।
কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে মাকাসিদে শরিয়া বা ইসলামি শরিয়ার উদ্দেশ্য সমূহ নিম্নরূপ :
১.    ঈমান ও তাওহীদ : অর্থাৎ মুমিনদের ঈমান ও আকিদা-বিশ্বাসের সংরক্ষণ।
২.    আদল : ন্যায় বিচার ও সুষমনীতি নিশ্চিত করণ।
৩.    ইহসান ও ফালাহে ’আম : মানবতার কল্যাণ ও সাফল্য।
৪.    হায়াতে তাইয়্যেবা : সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন।
৫.    মানবতার কল্যাণ, সাফল্য এবং সুন্দর-স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের জন্যে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।
৬.    জীবনের নিরাপত্তা।
৭.    মানব বংশ সংরক্ষণ।
৮.    সম্পদের নিরাপত্তা।
৯.    মর্যাদা তথা মান সম্মান ও ইয্যতের নিরাপত্তা।
১০.    মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ও বিকাশের সুবিধা নিশ্চিত করণ।
১১.    চিন্তা, চলাফেরা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করণ।
১২.    সামগ্রিক মানবাধিকার সংরক্ষণ।
৩. হিকমা (কর্মকৌশল ও প্রজ্ঞা) : শরিয়ার উদ্দেশ্য সমূহ অর্জনের জন্যে হিকমা প্রয়োগ অপরিহার্য। হিকমা মানে- যথার্থ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও কর্মকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো। মূলত টিকে থাকা, উন্নয়ন, সাফল্য অর্জনের কৌশল ও সঠিক পদক্ষেপকে হিকমা বলা হয়। কুরআন বলছে, রসূল সা. তাঁর সাথিদের মানবিক ও নৈতিক সত্তার উন্নয়ন এবং কিতাব শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে হিকমাও শিক্ষা দিতেন :
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ 
অর্থ: অবশ্যি আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করেছেন তাদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে একজন রসূল পাঠিয়ে, যিনি তাদের প্রতি আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করেন, তাদের তাযকিয়া (মানবিক ও নৈতিক গুণাবলীর উন্নয়ন সাধন) করেন, তাদের আল কিতাব (কুরআন) এবং হিকমা শিক্ষা দান করেন। (সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ১৬৪)
মূলত ইসলামের দৃষ্টিতে মানব সমাজের গোটা অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সংরক্ষণের ভিত্তি হলো এই তিনটি। সুতরাং ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তিও এই তিনটি।

০৫.    ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য সমূহ
ইসলামি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহই এর মূলনীতি। সেগুলো হলো:
০১.    অর্থ সম্পদের মূল মালিক ও যোগানদাতা এই পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের স্রষ্টা, মালিক ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ।
০২.    মানুষ সম্পদের মূল মালিক নয়, আমানতদার এবং ব্যবহারকারী বা ভোক্তা মাত্র। সুতরাং সে সম্পদের উৎপাদন, উপার্জন এবং ভোগ ব্যবহার করবে সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা মাফিক।
০৩.    মানুষের আর্থ সামাজিক বিষয়াদি তার বিশ্বাস, আদর্শ ও মূল্যবোধের সাথে একীভূত ও অবিভাজ্য। সুতরাং তার আর্থ সামাজিক বিষয়াদির উন্নয়ন ও ইতিবাচক নির্দেশনার ভিত্তি হবে নীতিবাচক তথা তার বিশ্বাস, আদর্শ এবং শরিয়া তথা কুরআন, সুন্নাহ, যুক্তি, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা।
০৪.    ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম মূল নীতি হলো, জাতি ধর্ম, ভাষা বর্ণ এবং কুল গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণ সাধন বা মানব কল্যাণ।
০৫.    ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আদল তথা ইনসাফ, সুবিচার ও ভারসম্যপূর্ণতা (Justice and balance)।
০৬.    ইসলামি অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সংঘাত নয়, বরং পারস্পারিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা ও কল্যাণকামিতা (ইহ্সান)।
০৭.    ইসলামি অর্থ ব্যবস্থায় যুল্ম ও নিবর্তনমূলক সকল পন্থা ও প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ।
০৮.    ইসলামি অর্থব্যবস্থা উৎপাদন, উপার্জন ও উন্নয়নমুখী।
০৯.    ইসলামি অর্থব্যবস্থায় অর্থ সম্পদের কৃপণতা, অলস পূঞ্জীভূত করণ এবং অনুৎপাদনশীল সঞ্চয় নিষিদ্ধ।
১০.    ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদের অপব্যবহার, অপব্যয় এবং অপচয় নিষিদ্ধ।
১১.    ইসলামি অর্থনীতি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়।
১২.    ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকারের স্বীকৃতি।
১৩.    ইসলামি অর্থব্যবস্থা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নির্দেশনা সম্বলিত সার্বজনীন জনহিতৈষী ব্যবস্থা।
১৪.    অর্থ হবে ধ্বংস ও অকল্যাণ থেকে মানুষ ও মানবতার মুক্তির হাতিয়ার।
১৫.    ব্যক্তি মালিকানার অধিকার। পুরুষ নারী প্রত্যেকেই বৈধ পন্থায় অর্জিত নিজ সম্পদের স্বত্বাধিকারী সে নিজে। বৈধ অন্থায় স্বাধীনভাবে এর বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও ব্যয় ব্যহারের অধিকার তার জন্যে সংরক্ষিত।
১৬.    যাকাত : অভাবী ও বিপদগ্রস্তদের অধিকার হিসেবে ধনীদের নগদ ও বিনিয়োগকৃত অর্থ, ফল ফসল এবং গবাদি পশুসহ সর্বপ্রকার বর্ধনশীল সম্পদের যাকাত প্রদান করা বাধ্যতামূলক।
১৭.    সুদ ও সুদী কারাবার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
১৮.    উত্তরাধিকার বিধান : শরিয়া নির্ধারিত নিকট আত্মীয়দের মধ্যে উত্তরাধিকার বন্টন বাধ্যতা মূলক।
১৯.    ইসলামি অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো, মাকাসিদে শরিয়া বা ইসলামি শরিয়ার উদ্দেশ্য সমূহ বাস্তবায়ন।
২০.    ইসলামি অর্থব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, বিশ্বাসী হিসেবে দুনিয়ায় সুন্দর, স্বচ্ছন্দ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবন যাপনের মাধ্যমে আখিরাতের সাফল্য অর্জন।
ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নীতিমালা সংক্রান্ত ধারণা বিষয়ে আল কুরআনের কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করা হলো :
لَهُ مَقَالِيدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاءُ وَيَقْدِرُ ۚ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ 
অর্থ: মহাবিশ্ব এবং পৃথিবীর ভান্ডারের চাবিকাঠির মালিকানা ও কর্তৃত্ব আল্লাহ্র। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তার জীবিকায় (অর্থ সম্পদে) প্রশস্ততা দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা সীমিত দিয়ে থাকেন। তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞানী। (সূরা ৪২ আশ শূরা : আয়াত ১২)
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا 
অর্থ: আল্লাহ সেই মহানুভব সত্ত্বা যিনি পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তোমাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৯)
وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيهَا مَعَايِشَ 
অর্থ: (হে মানুষ!) আমরা পৃথিবীতে তোমাদের কর্তৃত্ব দান করেছি এবং সেখানেই রেখে দিয়েছি তোমাদের জীবনের উপকরণ (অর্থাৎ পৃথিবীর বুকেই তোমরা জীবিকা সন্ধান সংগ্রহ করো)। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ১০)
وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبُوا ۖ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبْنَ ۚ وَاسْأَلُوا اللَّهَ مِن فَضْلِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا 
অর্থ: আল্লাহ যেসব জিনিস দিয়ে তোমাদের একজনকে আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেটার জন্যে তোমরা লালসা করোনা। পুরুষ যা উপার্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ (অর্থ সম্পদ, সহায় সম্বল) প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী। (সূরা ৪ আন্নিসা : আয়াত ৩২)
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
অর্থ: এবং তাদের (বিত্তবানদের) অর্থ সম্পদে অধিকার রয়েছে সাহায্যপ্রার্থী এবং বঞ্চিতদের। (সূরা ৫১ আয্ যারিয়াত : আয়াত ২৯)
مَّا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ 
অর্থ: আল্লাহ জনপদবাসীদের থেকে তাঁর রসূলকে যা  (যে সম্পদ) দিয়েছেন- তা আল্লাহর, আল্লাহর রসূলের, রসূলের স্বজনদের, এতিমদের, অভাবীদের এবং পথচারীদের জন্যে। এর উদ্দেশ্য হলো, অর্থ সম্পদ যেনো কেবল তোমাদের মধ্যকার বিত্তবানদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়। (সূরা ৫৯ আল হাশর: আয়াতাংশ ৭)
إِذَا تَدَايَنتُم بِدَيْنٍ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى فَاكْتُبُوهُ 
অর্থ: তোমরা যখন পরস্পরের মধ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে লেনদেনের (ঋণ দেয়া নেয়ার) ফায়সালা করবে, তখন তা লিখিতভাবে করবে। (সূরা ২ আল বাকারা ; আয়াত ২৮২)
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ 
অর্থ: তিনিই মহান আল্লাহ, যিনি পৃথিবীতে তোমাদের প্রতিনিধি বানিয়েছেন এবং তোমাদের একজনকে আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। উদ্দেশ্য হলো, তিনি তোমাদের যা কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করবেন। (সূরা ৬ আল আন’আম : আয়াত ১৬৫)
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ 
অর্থ: ওদের জিজ্ঞেস করো, কে হারাম করলো আল্লাহ্র সেই সব সৌন্দর্যকে, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্যে উৎপন্ন করেছেন এবং উত্তম জীবনোপকরণ সমূহকে? (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ৩২)
إِن تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ ۖ وَإِن تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۚ وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَيِّئَاتِكُمْ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ 
অর্থ: তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান করো, তাও ভালো। আর যদি গোপনে দরিদ্রদের দাও, তবে তা অধিকতর ভালো। এমনটি করলে তোমাদের বহু পাপ মুছে দেয়া হবে। তোমরা যাই করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। (সূরা ২ বাকারা : ২৭১)
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ 
অর্থ: এই সাদাকা (যাকাত) নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো ফকিরদের জন্যে, মিসকিনদের জন্যে, সাদাকা আদায়-বন্টন বিভাগের কর্মচারীদের জন্যে, তাদের জন্যে (ইসলামের পক্ষে) যাদের মন আকৃষ্ট করা উদ্দেশ্য হবে, দাস মুক্তির জন্যে, ঋণে নিমজ্জিতদের সাহায্যের জন্যে, আল্লাহর পথে এবং পথিকদের সাহায্যের জন্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত একটি ফরয। (সূরা ৯ তাওবা : ৬০)
وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا  إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ 
অর্থ: আত্মীয় স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং অভাবী ও পথিকদের দাও তাদের প্রাপ্য। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অপব্যয় করোনা। কারণ অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৬-২৭)
يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ 
অর্থ: হে আদম সন্তান! সালাত আদায়কালে তোমাদের উত্তম পবিত্র পোশাক পরে সৌন্দর্য গ্রহণ করো। আর আহার করো, পান করো, কিন্তু অপচয় করোনা। আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা ৭ আল আ’রাফ: আয়াত ৩১)
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَىٰ عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَّحْسُورًا 
অর্থ: তুমি (কার্পণ্য করে) নিজের হাতকে গলায় বেঁধে রেখোনা, আবার (উজাড় করে খরচ করে ফেলার জন্যে) তা সম্পূর্ণ প্রসারিত করেও দিওনা। এমনটি করলে তিরস্কৃত হবে এবং খালি হাতে বসে পড়বে। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৯)
وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَ‌ٰلِكَ قَوَامًا 
অর্থ: (আল্লাহ্র প্রিয় লোকদের বৈশিষ্ট্য হলো:) তারা ব্যয় করার ক্ষেত্রে অপচয়-অপব্যয় করেনা, আবার কার্পণ্যও করেনা; বরং উভয় চরম পন্থার মাঝখানে তারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। (সূরা ২৫ আল ফুরকান : আয়াত ৬৭)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ
অর্থ: হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল এবং উত্তম পবিত্র। তোমরা তাই খাও- ভোগ করো। তবে শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা। (সূরা ০২ : ১৬৮)

০৬.    ইসলামি অর্থনীতির উদ্দেশ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য
ইসলামি অর্থনীতি মানব কল্যাণের অন্যতম উপাদান। সমাজ থেকে অকল্যাণের পথ বন্ধ করে কল্যাণের স্রোতধারা বইয়ে দেয়াই ইসলামি অর্থনীতির কাজ। নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যাবলি হাসিলের প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুটি এবং আখিরাতের সাফল্য অর্জনই ইসলামি অর্থনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য :
১.    ফালাহ: ব্যাক্তির সাফল্য ও কল্যাণ সাধন,
২.    ইহ্সান: মানবতার কল্যাণ সাধন,
৩.    আদল: সমাজে অর্থ সম্পদের ন্যায্য ও সুষম প্রবাহ সৃষ্টি,
৪.    সমাজে ন্যায়নীতির প্রচলন,
৫.    দেশ ও সমাজকে ফিতনা ফাসাদ তথা ধ্বংসকর কর্মকান্ড থেকে রক্ষা করা।
এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের নিমোক্ত আয়াতগুলো অকাট্য দলিল :
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ ۖ وَلَا تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا ۖ وَأَحْسِن كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ 
অর্থ: আল্লাহ তোমাকে যে অর্থ সম্পদ দিয়েছেন তার দ্বারা আখিরাতের আবাস (জান্নাত) অনুসন্ধান করো এবং পার্থিব জীবনে তোমার বৈধ (ভোগের) অংশও ভুলে থেকোনা। (মানুষের) কল্যাণ করো, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আর (অর্থ সম্পদ দ্বারা) দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না। (সূরা ২৮ আল কাসাস : আয়াত ৭৭)
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَالْبَغْيِ ۚ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ 
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন আদল ও ইহসান করার এবং নিকটাত্মীয়দের দান করার। আর তিনি নিষেধ করছেন অশ্লীলতা, অসৎকর্ম এবং সীমালংঘন থেকে। তিনি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। (সূরা ১৬ আন্ নহল : আয়াত ৯০)
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ: সালাত সমাপ্ত হলে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং (কাজ ও শ্রম দানের মাধ্যমে) আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা, অর্থ-সম্পদ) সন্ধান (সংগ্রহ) করো, আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো। আশা করা যায় তোমারা ফালাহ (কল্যাণ) লাভ করবে। (সূরা ৬২ আল জুমুয়া : আয়াত ১০)
وَأَنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ وَأَحْسِنُوا ۛ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
অর্থ: তোমারা আল্লাহর পথে ব্যয় করো, আল্লাহর পথে খরচ না করে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করোনা। মানুষের প্রতি ইহসান করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদের (কল্যাণকারীদের) ভালোবাসেন। (সূরা ২ বাকারা : আয়াত ১৯৫)

০৭.    ইসলামে অর্থ উপার্জনের তাকিদ
প্রধানত তিনটি সূত্রে মানুষ অর্থ সম্পদ অর্জন করে। সেগুলো হলো :
১.    উত্তরাধিকার সূত্রে
২.    ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরি বাকুরি তথা কাজ করে উপার্জনের মাধ্যমে,
৩.    দান লাভের মাধ্যমে।
যারা শুধু প্রথমটির উপর নির্ভর করে, সেই সাথে দ্বিতীয় মাধ্যমটি গ্রহণ করেনা, তারা কর্মবিমূখ-অলস। ইসলামে এ ধরণের লোকেরা নিন্দনীয়। এরা ক্রমান্বয়ে তৃতীয় মাধ্যমটি অবলম্বনের দিকে অগ্রসর হয়।
সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা ব্যবসা না করে, বা কাজ না করে, বা শ্রমের মাধ্যমে উপার্জন না করে শুধু দান লাভ বা ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভর করে, ইসলামের দৃষ্টিতে তারা খুবই নিন্দা ও তিরস্কারযোগ্য।
ইসলামে প্রশংসনীয় লোক হলো তারা, যারা দ্বিতীয় মাধ্যমটি গ্রহণ করে। অর্থাৎ যারা ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকুরি বাকুরির মাধ্যমে কিংবা শ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করে।
অর্থ উপার্জনে আত্মনিয়োগ করা মুমিনদের জন্যে অত্যাবশ্যক। এর নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَ‌ٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ  فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ 
অর্থ: হে মুমিনরা! জুমাবারে যখন  সালাতের দিকে ডাকা (আযান দেয়া) হয়, তখন তোমরা বিজনেস রেখে দ্রুত আল্লাহ্র যিক্র (সালাত)-এর দিকে আসো। এতেই রয়েছে তোমাদের জন্যে কল্যাণ যদি তোমরা জ্ঞান খাটাও। অতপর সালাত শেষ হবার সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ো জমিনে (তোমাদের পেশায়) এবং সন্ধান করো আল্লাহ্র অনুগ্রহ (জীবিকা), আর বেশি বেশি আলোচনা করো আল্লাহ্র কথা। এভাবেই অর্জন করবে তোমরা ফালাহ (কল্যাণ ও সাফল্য)। (সূরা ৬২ জুমুয়া : আয়াত ৯-১০)
নিদ্রা এবং রাত দিন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :
وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا  وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا  وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا
অর্থ : আমি তোমাদের নিদ্রাকে বানিয়ে দিয়েছি বিশ্রাম ও প্রশান্তি লাভের উপায়। রাতকে বানিয়ে দিয়েছি আবরণ। আর দিনকে বানিয়ে দিয়েছি জীবিকা উপার্জনের উপযুক্ত সময়। (সূরা ৭৮ জুমুয়া : আয়াত ৯-১১)
এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
مَا اَكَلَ اَحَدٌ طَعَامًا خَيْرًا مِنْ انْ يَأكُلَ مِنْ عَمَلٌ يَدَيْهِ 
অর্থ: “নিজের উপার্জনের চাইতে উত্তম জীবিকা কেউ কখনো ভোগ করেনি।” (সহীহ বুখারি)
اِنَّ اَطْيَبَ مَا اَكَلْتُمْ مِنْ كَسْبَِكُمْ وَاِنَّ اَوْلاَدِكُمْ مِنْ كَسَبِكُمْ 
অর্থ: “তোমাদের সর্বোত্তম জীবিকা নিজের উপার্জন। আর তোমাদের সন্তানের উপার্জনও তোমাদের উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত।” (তিরমিযি, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ, আবু দাউদ)
অর্থ উপার্জন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, রসূলুল্লাহর সা. এ হাদিসটি তার নির্দেশক :
طَلَبُ كَسَبِ الْحَلاَلِ فَرِيْضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيْضَةٌ 
অর্থ: “অন্যান্য ফরযের মতোই হালাল উপার্জনও একটি ফরয।” হাদিসটি বায়হাকি তাঁর শোয়াবুল ঈমানে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা বর্ণনা করেছেন।
মুসনাদে আহমদে রাফে বিন খাদিজ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞাসা করা হলো : কোন্ ধরণের উপার্জন সর্বোত্তম? তিনি বললেন : “ব্যক্তির সশ্রমে হালাল ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন।”

০৮.    হালাল ও বৈধ উপার্জনকারীর পরকালীন সাফল্য

হালাল উপার্জন একটি ইবাদত। কারণ হালাল উপার্জনকারী আল্লাহ্র হুকুম পালন করে। আল্লাহ যা কিছু হারাম করেছেন এবং যা কিছু নিষেধ করেছেন, সে সেগুলো পরিত্যাগ করে। যেসব মুমিন ব্যক্তি হালাল ও বৈধ পন্থায় জীবিকা তথা অর্থ সম্পদ উপার্জন করে, পরকালে আল্লাহ তায়ালা তাদের মর্যাদা দান করবেন। জাবির রা. বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
رَحِمَ اللهُ رَجُلاً سَمْحًا اِذَا بَاعَ وَاِذَا شْتَرٰى وَاِذَا قْتَضٰى 
অর্থ: আল্লাহ তায়ালা ঐ উপার্জনকারীর প্রতি রহম করেন, যে বেচা কেনা এবং পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে সহনশীল হয়। (সহীহ বুখারি : ব্যবসা বাণিজ্য অধ্যায়)
আলী রা. বর্ণনা করেন, আমি রসূলুল্লাহ সা. কে বলতে শুনেছি : “যেদিন আল্লাহ্র আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবেনা, সেদিন সেই ছায়ায় ঐ ব্যক্তিকে স্থান দেয়া হবে, যে আল্লাহ্র অনুগ্রহ (জীবিকার) সন্ধানে বের হয় এবং তা সংগ্রহ করে পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে আসে।” (মুসনাদে যায়েদ ইবনে আলী, Economic Teaching of Prophet Muhammad 3:3)
আবু সায়ীদ খুদরি রা. বলেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
اَلتَّاجِرُ الصَّدُوْقُ الْاَمِيْنُ مَعَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ 
অর্থ: সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সিদ্দিক এবং শহীদগণের সংগি হবে।” (তিরমিযি, দারেমি, দারু কুতনি, ইবনে মাজাহ। মিশকাত শরীফ হাদিস নম্বর : ২৬৭৪)

০৯.    হারাম ও অবৈধ উপার্জনের ভয়াবহ পরিণতি
কুরআন মজিদে অবৈধ উপার্জনকারীদের ভয়াবহ পরকালীন শাস্তির কথা উল্লেখ হয়েছে। রসূলুল্লাহ সা.-এর হাদিসেও অবৈধ উপার্জনের চরম নিন্দা করা হয়েছে। এখানে আমরা দুটি হাদিস উল্লেখ করছি। আবু বকর রা. বর্ণনা করেন রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِىَ بِالْحَرَامِ 
অর্থ: যে শরীর (যে ব্যক্তি) হারাম (উপার্জন ভোগ) দ্বারা লালিত ও বিকশিত হয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবেনা। (বায়হাকি, মিশকাত হাদিস নম্বর ২৬৬৭)
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
اِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لاَّ يَقْبَلُ اِلاَّ طَيِّبًا وَاِنَّ اللهَ اَمَرَ الْمُؤمِنِيْنَ بِمَا اَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِيْنَ  فَقَالَ يٰاَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَعْمَلُوْا صَالِحًا وَّقَالَ يٰاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَكُمْ ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلُ يُطِيْلُ السَّفَرَ اَشْعَثَ اَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ اِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَ مَطْعَمُه حَرَامٌ وَّمَشْرَبُه حَرَامٌ وَّمَلْبَسُه حَرَامٌ وَّغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَاَنّٰى يُسْتَجَابَ لِذَالِكَ 
অর্থ: আল্লাহ উত্তম-পবিত্র। তিনি উত্তম এবং পবিত্র (পন্থা ও বস্তু) ছাড়া গ্রহণ করেন না। তিনি মুমিনদের সেই নির্দেশই দিয়েছেন, যে নির্দেশ দিয়েছেন রসূলগণকে। তিনি তাদের বলেছেন : ‘হে রসূলরা! তোমরা উত্তম ও পবিত্র জীবিকা আহার করো, ভোগ করো এবং আমলে সালেহ করো।’ তিনি আরো বলেছেন : ‘হে মুমিনরা! আমার প্রদত্ত উত্তম ও পবিত্র জীবিকা ভোগ-আহার করো।’ অতপর রসূলুল্লাহ সা. বললেন : দেখো, এক ব্যক্তি দূর দুরান্ত সফর করে আসে। তার চুল এলোমেলো, দেহ ধূলোমলিন। সে হাত উঠিয়ে প্রার্থনা করে : ‘হে প্রভু, হে প্রভু!’ অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম (অর্থাৎ হারাম উপার্জনের), হারাম উপার্জনই সে ভোগ করে। কী করে কবুল হবে তার দোয়া? (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হাদিস নম্বর ২৬৪০)

১০.    হালাল ও বৈধভাবে অর্থ উপার্জনের উপায় সমূহ
হালাল এবং বৈধভাবে অর্থ উপার্জন ও ভোগ ব্যবহারের নির্দেশই ইসলামে দেয়া হয়েছে। ইসলাম নোংরা উপার্জন ও জীবিকাকে নিষিদ্ধ করে এবং উত্তম ও সুন্দর উপার্জন ও জীবিকাকে প্রশংসা করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحَرِّمُوا طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ  وَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي أَنتُم بِهِ مُؤْمِنُونَ 
অর্থ: হে ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহ যেসব ভালো জিনিস তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন তোমরা সেগুলো নিষিদ্ধ করে নিওনা এবং সীমালংঘন করোনা। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ তোমাদের যেসব হালাল ও ভালো জীবিকা-জীবনোপকরণ দিয়েছেন সেগুলো ভোগ আহার করো এবং সেই আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর প্রতি তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছো।  (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৮৭-৮৮)
মূলত নিষিদ্ধ উৎসসমূহ ছাড়া ইসলামের দৃষ্টিতে উপার্জনের বাকি সব উৎসই হালাল বা বৈধ। আয় উপার্জনের নিম্নোক্ত উৎসসমূহ হালাল এবং বৈধ :
০১.    ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে উপার্জন। বৈধ পন্থায় ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে উপার্জনকে ইসলাম সর্বাধিক উৎসাহিত করেছে। ব্যবসা করা যায় :
ক. একক ব্যবসা,
খ. পূজি বিনিয়োগের মাধ্যমে শরিকানা ব্যবসা,
গ. পূজি ও শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে যৌথ বা শরিকানা ব্যবসা।
০২.    কৃষি কাজের মাধ্যমে উপার্জন। যেমন :
ক. নিজের জমিতে ফল ফসল ও অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদন ও উপার্জন,
খ. পরের জমিতে বর্গা চাষের মাধ্যমে উৎপাদন ও উপার্জন,
গ. পরের জমি ভাড়া  (ইজারা) নিয়ে উৎপাদন।
০৩.    পশু পাখি ও মৎস পালনের মাধ্যমে উপার্জন (জলে স্থলে খামার পদ্ধতি)।
০৪.    শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধমে উপার্জন।
০৫.    পেশা গ্রহণের মাধ্যমে উপার্জন। শিক্ষকতা, ডাক্তারি, ওকালতি, ইত্যাদি।
০৬.    সরকারি বেসরকারি চাকুরি গ্রহণের মাধ্যমে উপার্জন।
০৭.    সেবা প্রদানের (সাভির্স চার্জ গ্রহণের) মাধ্যমে উপার্জন।
০৮.    মানসিক এবং শারীরিক শ্রমদানের মাধ্যমে উপার্জন।
০৯.    দালালি (সহযোগিতা) করার মাধ্যমে উপার্জন।
১০.    দান লাভের মাধ্যমে অর্জন।
১১.    হাদিয়া, তোহফা ও অসিয়তের মাধ্যমে লাভ।
১২.    উত্তরাধিকার লাভ।
১৩.    অধিকার হিসাবে অভিভাবক থেকে লাভ।
১৪.    সরকারি সাহায্য লাভ।
১৫.    অন্যান্য।

১১.    নারীর অর্থ উপার্জন ও সম্পদের মালিকানা অর্জন
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে নারীর অর্থোপার্জন এবং খরচের বিষয়টিও আলোচনা করা জরুরি মনে করছি। কারণ, এ নিয়ে অকারণে সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক কল্পকাহিনী।
ইসলাম পুরুষের মতো নারীর অর্জিত সম্পদের মালিকানা নারীকেই দিয়েছে (সূরা আন্নিসা : আয়াত৩২)। পুরুষের মতোই শরিয়া অনুমোদিত প্রক্রিয়ায় নারীর অর্জিত ও উপার্জিত নিজের অর্থ সম্পদের বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও ব্যয় ব্যবহারের অধিকার তার নিজের জন্যে সংরক্ষিত। তবে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনে এবং পরিবার পরিচালনায় অর্থ ব্যয়ের দায়িত্ব পুরুষের । এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ছাড়া নারীর অর্থ ব্যয় হয়না। নারীর আয়ের উৎস অধিক, ব্যয়ের বাধ্যতামূলক খাত একেবারেই সীমিত। তার ব্যয়ের খাত স্বাধীন সেচ্ছোমূলক। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর আয় ও অর্জনের উৎস সমূহ নিম্নরূপ:
০১.    লালন পালন ও পড়া লেখার অর্থ পাবেন পিতার নিকট থেকে।
০২.    বিবাহের অর্থ প্রদান করবেন পিতা এবং স্বামী।
০৩.    বিবাহে স্বামীর নিকট থেকে মোহরানা লাভ।
০৪.    ঘর বাড়ি নির্মাণ খরচ বা বাসা ভাড়া পাবেন স্বামীর নিকট থেকে।
০৫.    খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার অর্থ পাবেন স্বামীর নিকট থেকে।
০৬.    সন্তান লালন পালন এবং তাদের শিক্ষা চিকিৎসা সহ যাবতীয় খরচের অর্থ নেবেন স্বামী থেকে।
০৭.    পিতা মাতা এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ সম্পদ লাভ করবেন।
০৮.    স্বামী এবং সন্তানের মৃতুতেও উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ সম্পদ লাভ করবেন।
০৯.    স্বামী, সন্তান, পিতা, মাতা, ভাইবোন এবং অন্যান্য আত্মীয়দের পক্ষ থেকে দান, উপহার এবং হাদিয়া তোহফা লাভ।
১০.    স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতিক্রমে (যদি বর্তমান থাকে) বৈধ প্রক্রিয়ায় চাকুরির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সুযোগ।
১১.    বৈধ প্রক্রিয়ায় ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সুযোগ।
১২.    শিক্ষকতা, চিকিৎসা ও অন্যান্য স্বাধীন পেশার মাধ্যমে উপার্জনের সুযোগ।
১৩.    হস্তশিল্পসহ ঘরে প্রস্তুতযোগ্য সামগ্রী তৈরির মাধ্যমে উপার্জনের সুযোগ।
১৪.    বিবাহ বিচ্ছেদ কালে তালাক দাতা স্বামীর নিকট থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর  অর্থ  লাভ।
১৫.    তালাক দাতা স্বামীর শিশু সন্তানকে দুধপান করালে বা লালন পালন করলে সে জন্যে অর্থ লাভ।

১২.    নারীদের  খরচের খাত
০১.    পড়া লেখার খরচ : প্রদান করনে পিতা, মাতা, স্বামী,ভ্রাতা। নিজের খরচ নেই, থাকলেও ঐচ্ছিক।
০২.    বিবাহ খরচ : প্রদান করেন পিতা, মাতা, ভ্রাতা, বর। নিজের খরচ ঐচ্ছিক।
০৩.    সন্তান লালন পালন খরচ: এ ক্ষেত্রে মায়ের খরচ ঐচ্ছিক, পিতার খরচ বাধ্যতামূলক।
০৪.    বাসস্থানের খরচ : বহন করেন পিতা, স্বামী, সন্তান। নিজের খরচ ঐচ্ছিক এবং কদাচিৎ।
০৫.    অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা খরচ : বহন করেন পিতা, স্বামী, সন্তান। নিজের খরচ ঐচ্ছিক/ কদাচিৎ।
০৬.    দান সদকা।
০৭.    হাদিয়া, তোহফা, উপহার।
০৮.    যাকাত।
০৯.    কর, খাজনা।
১০.    কাফফারা, ফিদিয়া, মান্নত।
নারীদের অর্থব্যয়ের খাত দশটি। এর মধ্যে ৭টি ঐচ্ছিক এবং তিনটি ক্ষেত্র বিশেষে এবং ঘটনাক্রমে বাধ্যতামূলক।

১৩.    অর্থ উপার্জনের হারাম ও নিষিদ্ধ উপায় সমূহ
ব্যক্তি ও সমাজ তথা মানুষের জন্যে যা কিছু ক্ষতিকর, অকল্যাণকর, তা সবই হারাম, নিষিদ্ধ এবং অবৈধ। ইসলামের এ নীতি অর্থনৈতিক বিষয়াদিসহ মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ইসলামের অর্থনীতি সমন্বিতভাবে ইতিবাচক ও নীতিবাচক । ইসলামের এই নীতিবাদিতা শরিয়ার বিধান এবং শাশ্বত আদর্শিক নীতিবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সে হিসেবে ইসলামে নিুোক্ত উপায় ও পন্থা প্রক্রিয়ায় আয় উপার্জন হারাম, নিষিদ্ধ ও অবৈধ :
১.    রিবা (সুদ) : এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন :
وَاَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَوا 
অর্থ: আল্লাহ হালাল করেছেন ব্যবসা বাণিজ্য এবং হারাম করেছেন রিবা (সূদ)। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৭৫)
২.    রিশওয়াত : অর্থাৎ ঘুষ ও উৎকোচের মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ।
৩.    গরর : অর্থাৎ প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ, তা যে প্রকারেরই হোক।
৪.    ডাকাতি, লুন্ঠন, ছিনতাই ও অপহরণের মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ।
৫.    দখল, জবর দখলের উপার্জন নিষিদ্ধ।
৬.    নিজের খুশিমতো দাম বা বিনিময় দিয়ে স্বত্তাধিকারীর অনিচ্ছা সত্তেও নিয়ে নেয়া নিষিদ্ধ।
এই কয়টি বিষয় সম্পর্কে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে :
وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِّنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ 
অর্থ: তোমরা নিজেদের মধ্যে অবৈধ পন্থায় একে অপরের অর্থ সম্পদ খেয়োনা এবং সেগুলো শাসকদের সামনেও এমন কোনো উদ্দেশ্যে উত্থাপন করোনা, যাতে করে তোমরা জেনে বুঝে পরের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার সুযোগ পাও। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ১৮৮)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَن تَكُونَ تِجَارَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ 
অর্থ: হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থ সম্পদ বাতিল অন্যায় অবৈধ উপায়ে খেয়োনা। তবে পারস্পারিক ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির ভিত্তিতে ব্যবসা করলে ভিন্ন কথা। (সূরা ৪ আন্ নিসা : আয়াত ১৮৮) এ প্রসঙ্গে আরো দ্রষ্টব্য সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৩৩।
৭.    আমানতের খেয়ানত ও আত্মস্যাতের মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ : দ্রষ্টব্য (আল কুরআন ২ : ২৮৩; ৩ : ১৬১)
৮.    জুয়া, বাজি এবং এমন সব উপায় প্রক্রিয়া অবলম্বন করে উপার্জন করা, যার মাধ্যমে ঘটনাচক্রে একজনের অর্থসম্পদ আরেকজনের কাছে চলে যায়। এগুলো হারজিতের ধ্বংসকর খেলা। এতে এক পক্ষ কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়াই আরেক পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তার অর্থ লুটে নেয়। এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯০।
৯.    হারাম বস্তুর উৎপাদন, ক্রয় বিক্রয় ও ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ : যেমন, ক. মদ ও মাদকদ্রব্য, খ. মৃত প্রাণী, গ. শুয়োর, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদির ব্যবসা। দ্রষ্টব্য সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৩,৯০ এবং হাদিস দ্রষ্টব্য।
১০.    লটারি, ভাগ্য গণনা ও জ্যোতিষ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ : দ্রষ্টব্য সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯০।
১১.    অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতি প্রচার ও প্রসারকারী কার্যক্রমের মাধ্যমে উপার্জন: দ্রষ্টব্য আল কুরআন, সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ১৯।
১২.    ইহ্তিকার : ইহ্তিকারের মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ। ইহ্তিকার হলো দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মওজুদ করে রাখা। বাজারে এর বিভিন্ন ধরণের নাম রয়েছে। রসূল সা. এ ধরণের কারবার নিষিদ্ধ করেছেন। তাছাড়া এটা সূরা নিসার ২৯ আয়াতে বর্ণিত বাতিল পন্থায় উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত।
১৩.    রাষ্ট্র ও ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে অর্থোপার্জন নিষিদ্ধ : দ্রষ্টব্য সূরা ২: আয়াত ১৮৮।
১৪.    চুরির মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ : দ্রষ্টব্য আল কুরআন সূরা ৫ : আয়াত ৩৮।
১৫.    দেহ ব্যবসা ও বেশ্যাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ। দ্রষ্টব্য আল কুরআন, সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ২,৩৩।
১৬.    মাপে ও ওজনে কমবেশি করার মাধমে উপার্জন নিষিদ্ধ। অর্থাৎ মেপে বা ওজন করে নেয়ার সময় বেশি নেয়া এবং দেয়ার সময় কম দেয়া। কুরআন মাজিদে এ ধরনের লোকদের জন্যে কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে। দ্রষ্টব্য: সূরা ৮৩ মুতাফ্ফিফিন : আয়াত-১-১০।
১৭.    চোরাই মাল ক্রয় বিক্রয় এবং চোরালানী নিষিদ্ধ।
১৮.    অর্থ সম্পদ ও জমি জমা অনুৎপাদনশীল ফেলে রাখা নিষিদ্ধ।
১৯.    আসলের সাথে নকল ও ভেজাল মিশিয়ে বিক্রয় নিষিদ্ধ।
২০.    আসলের স্যাম্পল দেখিয়ে নকল সরবরাহ করা নিষিদ্ধ।
২১.    আসলের মোড়কে ভেজাল ও নকল মাল বিক্রি করা নিষিদ্ধ।
২২.    ফটকাবাজারি ও মুনাফাখোরী নিষিদ্ধ।
হাদিস থেকে এগুলোর নিষেধাজ্ঞা জানা যায়।
২৩.    এতিমের অর্থ সম্পদ ও সহায় সম্পত্তি ভোগ দখল করা নিষিদ্ধ : আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘যারা অন্যায় ভাবে এতিমদের অর্থ সম্পদ ও সহায় সম্পত্তি ভোগ দখল করে, তারা মূলত আগুন দিয়ে নিজেদের উদর ভর্তি করে। অচিরেই তাদের পোড়ানো হবে জ্বলন্ত আগুনে।’ (সূরা ৪ আন্নিসা : আয়াত ১০)
২৪.     বোনদের বা অন্য কারো উত্তরাধিকার বন্টন করে না দিয়ে নিজের সম্পদের সাথে একাকার করে রেখে ভোগ করা : যারা উওরাধিকার বন্টন করেন না, সূরা আন নিসার ১৪ আয়াতে তাদের অপমানজনক অনন্ত আযাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
২৫.    ধনীদের যাকাত খাওয়া করা নিষিদ্ধ : ধনীদের যাকাত প্রদান করা ফরয। যাকাত পাওয়া অভাবীদের অধিকার। যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ থেকে যাকাত বের করে দেয়না, সে নিজ অর্থ সম্পদের সাথে অভাবীদের যাকাত বা অর্থ সম্পদ একাকার করে ভোগ করে। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা অনুযায়ী এ সম্পদ দ্বারা তার জন্যে আগুনের বেড়ি তৈরি হচ্ছে। (দ্রষ্টব্য সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ১৮০)।
২৬.    দোকানি বা কারো নিকট থেকে কিছু ক্রয় করে দাম না দেয়া। ফলে ক্রয় করা বস্তু তার অবৈধ উপার্জন- যা তার জন্যে সম্পূর্ণ হারাম। এটা যুলুমের উপার্জন। অপরের অধিকার হরণ। (সূরা আন্নিসা : আয়াত ২৯)
২৭.    অন্যায্য বন্টন: উত্তরাধিকার বন্টন হোক, যৌথ কারবারের লাভালাভ বন্টন হোক, যৌথ ক্রয়ের মাল-সম্পদ বন্টন হোক, অথবা অন্য যে কোনো ধরণের বন্টনের ক্ষেত্রে নিজের ভাগে বেশি নেয়া, বেছে বেছে ভালোটা নেয়া, কিংবা নিজে সুবিধাজনকটা নিয়ে নেয়া অবৈধ। এটা যুলুমের মাধ্যমে উপার্জন। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। (দ্রষ্টব্য : সূরা নিসা, আয়াত ১০ ও ৩০)।
২৮.    ধার, করজ, ঋণ বা লোন নিয়ে পরিশোধ না করা। মানুষ সাধারণত ক. উন্নয়ন কাজের জন্যে, খ. ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্যে, কিংবা গ. অভাবের তাড়নায় মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে ঋণ করে থাকে।
ঋণ গ্রহণ করা হয়ে থাকে সাধারণত সরকারি তহবিল, সরকারি ব্যাংক, প্রাইভেট ব্যাংক, সংস্থা এবং সামর্থবান ব্যক্তিদের নিকট থেকে।
কোনো চরম অভাবী বা দেউলিয়াকে ব্যক্তি তার ঋণ মাফ করে দিতে পারে। কিন্তু যারা ঋণ গ্রহণ করে চরম অভাবী বা দেওলিয়া না হয়েও ঋণ পরিশোধ করেনা, কিংবা সময়মতো করেনা, ইসলামের দৃষ্টিতে তারা চরম শাস্তি ভোগ করবে। কারণ তারা অন্যায়ভাবে অন্যদের অর্থসম্পদ গ্রাস করেছে।
২৯.    হারানো বা পড়ে থাকা অর্থ সামগ্রী নিয়ে নেয়া; এ ধরণের কিছু পাওয়া গেলে তা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ উক্ত অর্থ সামগ্রীর স্বত্বাধিকারীকে খুঁজে বের করার জন্যে প্রচার বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করবে। শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া না গেলে এই অর্থ সামগ্রী জনকল্যাণ মূলক তহবিলে জমা হবে।
৩০.    সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে ত্রাস ও আতংক সৃষ্টি করে এবং দাপট দেখিয়ে অর্থ আদায় করা নিষিদ্ধ। যেমন : চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটপাট ইত্যাদি। কুরআন এবং হাদিসে এ ধরণের কাজকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য আল কুরআন, সূরা ২ : আয়াত ১৮৮; সূরা ৪ : আয়াত ২৯)
৩১.    যাদুমন্ত্র বা যাদু টোনার মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ। এটা মানুষের জন্যে ধ্বংসকর বিধায় কুরআন ও হাদিসে এটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৩২.    মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য নির্মাণ, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রসূলুল্লাহ সা. এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।
৩৩.    এ ছাড়াও ব্যক্তি, মানবতা ও ঈমান আকিদার জন্যে ক্ষতিকর সবই নিষিদ্ধ।

১৪.    অর্থ সম্পদ ব্যয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যা যা নিষিদ্ধ
মানুষ যেসব অর্থ অর্জন এবং উপার্জন করে, তা সাধারণত নিম্নরূপ খাতসমূহে ব্যয়-ব্যবহার করে থাকে :
১.    নিজের ও পরিবার পরিজনের জন্যে ব্যয় করে।
২.    উৎপাদন ও উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করে।
৩.    যাকাত প্রদান করে।
৪.    ট্যাক্স, খাজনা ও বিভিন্ন প্রকার কর প্রদান করে।
৫.    বিভিন্ন প্রকার দায়িত্ব কর্তব্য (Obligations) ও অধিকার (Rights) আদায়ে প্রদান করে।
৬.    দান করে।
৭.    সঞ্চিত ও পূঞ্জিভূত করে।
৮.    অপচয় ও অপব্যয় (overuse & misuse) করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থ ব্যয় একদিকে যেমন বিরাট নেকি ও পুণ্যের কাজ। অপরদিকে তা বিরাট পাপও অকল্যাণের হাতিয়ার। ইসলাম সব ধরণের কল্যাণের ব্যয়কে উৎসাহিত করে। কিন্তু সব ধরনের অকল্যাণকর কাজে ব্যয় করাকে নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্মোক্ত খাত ও প্রক্রিয়ায় ব্যয় বিনিয়োগ করা অবৈধ ও নিষিদ্ধ :
০১.    সুদী কারবারে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। (আল কুরআন ২ : ২৭৫)
০২.    জুয়া খেলায় বিনিয়োগে নিষিদ্ধ। (আল কুরআন ৫ : ৯০)
০৩.    ভাগ্য গণনায় ব্যয় নিষিদ্ধ। (আল কুরআন ৫ : ৯০)
০৪.    ব্যভিচারের কাজে ব্যয় নিষিদ্ধ। (আল কুরআন ২৪ : ২,৩৩)
০৫.    সর্বপ্রকার অশ্লীলতা প্রসারকারী কাজ কারবারে ব্যয় বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। (আল কুরআন ২৪ : ১৯)
০৬.    সর্বপ্রকার ধোকা প্রতারণার কাজে ব্যয় বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। (হাদিস : যে প্রতারণা করে, সে আমার লোক নয়)।
০৭.    ঘুষ প্রদান নিষিদ্ধ। (আল কুরআন ২ :১৮৮)
০৮.    মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাষ্কর্য তৈরি ও ক্রয়ে ব্যয় বিনিয়োগ নিষিদ্ধ।
০৯.    সর্বপ্রকার হারাম জিনিস ক্রয়ে ব্যয় করা নিষিদ্ধ। বিনিয়োগও নিষিদ্ধ।
১০.    ক্ষতিকর জ্ঞানার্জনে ও প্রশিক্ষণে ব্যয় করা নিষিদ্ধ।
১১.    ভেজাল ও নকল ব্যবসায় বিনিয়োগ নিষিদ্ধ।
১২.    অবৈধ উদ্দেশ্য হাসিলের নিয়্যতে ধার-করজ-ঋণ প্রদান নিষিদ্ধ।
১৩.    খোঁটা দেয়ার উদ্দেশ্যে বা জশ, খ্যাতি ও সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে দান করা নিষিদ্ধ।
১৪.    প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় বা দান না করে কৃপণতা করা নিষিদ্ধ।
১৫.    সর্বস্ব দান করে ফেলা বা ব্যয় করে ফেলা নিষিদ্ধ।
১৬.    অর্থ-সামগ্রী অপচয় (overuse) করা নিষিদ্ধ।
১৭.    অর্থ সম্পদ অপব্যয় (misuse) করা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ নিষ্প্রয়োজনীয় ও নিষিদ্ধ খাতে ব্যয় করা নিষিদ্ধ।
১৮.    কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা নিষিদ্ধ।
১৯.    ভালো কাজের বিরোধিতা বা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যয় করা নিষিদ্ধ।
২০.    ইসলামের বিরোধিতা করা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ।
২১.    যে কোনো ক্ষতিকর, অকল্যাণকর এবং সামাজিক ও সামষ্টিক অনিষ্টকর কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ।

১৫.    যেসব খাতে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক
ইসলামের দৃষ্টিতে অর্জিত অর্থ সম্পদ বিনিয়োগ ব্যতিত যাবতীয় ব্যয়ের খাত সমূহ দুই ভাগে বিভক্ত। সেগুলো হলো :
০১.    বাধ্যতামূলক,
০২.    স্বেচ্ছামূলক।
ইসলামে নিম্নোক্ত খাতসমূহে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক এবং আবশ্যক :
১.    হুকুক : অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কের কারণে যারা অধিকার লাভ করেছে তাদের জন্যে ব্যয় করা। যেমন : সন্তান, পিতামাতা।
২.    নাফকা : এর অর্থ বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে যারা অধিকার লাভ করে তাদের জন্যে ব্যয় করা। যেমন: স্ত্রীদের জন্যে। এমনকি স্ত্রীকে তালাক দিলেও ইদ্দত পালন কালে, গর্ভে সন্তান থাকলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত এবং সন্তানকে দুধ পান করালে দুধ পান শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকে নাফকা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে সূরা আন নিসার ৩৪ এবং সূরা আত তালাকের ৬-৭ আয়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
৩.    বিবাহের মোহর: বিয়ের সময় একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে যে অর্থ প্রদান করেন তার নাম মোহর। মোহর প্রদান করা বাধ্যতামূলক, এ প্রসঙ্গে সূরা আন নিসার ৪ এবং ২০ আয়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
৪.    যাকাত এবং উশর : মূলত উশর যাকাতেরই একটি অংগ। উশর হলো ফল ফসলের যাকাত। বছর শেষে হিসাব নিকাশ করে উদ্ধৃত্ত (balance) অর্থ সম্পদ থেকে শরিয়া নির্ধারিত হারে এবং খাতে একটি অংশ পরিশোধ করাকে যাকাত বলা হয়। সালাত আদায় করার মতোই যাকাত আদায় করা ফরয। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে : ‘তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত পরিশোধ করো।’ (সূরা আল বাকারা : আয়াত ৪৩,৮৩,১০)
৫.    কাফ্ফারা : কেউ কোনো পাপ বা অপরাধ করে ফেললে তা থেকে নিষ্কৃতি পওয়ার জন্যে যে নেক কাজ করতে হয়, তাকে কাফ্ফারা বলা হয়। কুরআন মজিদে তিনটি পাপের ক্ষেত্রে কাফ্ফারার মাধ্যমে নিষ্কৃতি লাভের বিধান দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো : ১. ইচ্ছাকৃতভাবে রমযান মাসের ফরয রোযা ভঙ্গ করলে। ২. যিহার করলে। অর্থাৎ নিজের স্ত্রীকে বা স্ত্রীর কোনো অঙ্গকে নিজের মা বা বোনের কোনো অঙ্গের মতো বলে তুলনা করলে। সূরা মুজাদালার ২-৪ আয়াতে এ সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। ৩. অংগিকার ভংগ করলে। সূরা আল মায়িদার ৮৯ আয়াতে -এ সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে।
এসব ক্ষেত্রে কাফ্ফারা হিসেবে রোযা রাখা কিংবা অভাবীদের খাওয়ানো, অথবা মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তিদানের কথা বলা হয়েছে।
৬.    ফিদিয়া : বার্ধক্যজনিত কারণে এবং এমন রোগের কারণে- যে রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়না রমযান মাসের ফরয রোযা রাখতে না পারলে তার বিনিময়ে কুরআন নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় ও পরিমাণে দান করাকে ফিদিয়া বলা হয়।
৭.    নযর : নযরকে আমাদের দেশে মান্নত বলা হয়। এর অর্থ- উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে কোনো ত্যাগ স্বীকার বা দান করার স্বগত অংগীকার করা। উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে প্রতিশ্রুত ত্যাগ স্বীকার করা বা দান করা বাধ্যতামূলক। যারা জান্নাতে যাবে, সূরা আদ্দাহরের ৭ আয়াতে তাদের একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা নযর (মান্নত) পূর্ণ করে।
৮.    সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা : ঈদুল ফিতরের পূর্বে সামর্থবান ব্যক্তিগণ কর্তৃক অভাবী ব্যক্তিগণকে ঈদ আনন্দে শরিক করার জন্যে সুন্নাহ নির্ধারিত হারে সাহয্য প্রদানকে সাদাকাতুল ফিতর বলা হয়। রসূল সা. এই সাহায্য প্রদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
৯.    কুরবানির গোশত বিতরণ: যারা তামাত্তু হজ্জ করেন তাদেরকে বাধ্যতামূলক কুরবানি করতে হয়। তাছাড়া সকল সামর্থবান মুসলিমকেই কুরবানি করতে তাকিদ করা হয়েছে। কুরবানির গোশতের একটি অংশ অভাবীদের দান করতে বলা হয়েছে।

১৬.    ব্যয়ের কল্যাণময় স্বেচ্ছামূলক খাতসমূহ
কুরআন এবং হাদিসে মুমিনদেরকে ব্যাপকভাবে স্বেচ্ছামূলক দান করতে উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত করা হয়েছে। এসব দানের প্রক্রিয়া ও খাত নিম্নরূপ :
১.    সাধারণ দান : এটাকে সাধারণত, দান, খয়রাত (কল্যাণের কাজ), সদকা ইত্যাদি বলা হয়। অভাবী এবং বিপদগ্রস্তদের সব সময় সর্বাবস্থায় এ দান করা যায়। এ দানের একটি বড় খাত হলো আল্লাহর পথে দান করা। এ দানের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত ও উদ্দীপ্ত করা হয়েছে। কুরআন ও সুন্নায় আহবান জানানো হয়েছে দান করতে :
ক.    দরিদ্র অভাবী আত্মীয় স্বজনকে।
খ.    অভাবী প্রতিবেশীদেরকে।
গ.    ফকির তথা নিঃস্ব সাহায্যপ্রার্থীদেরকে।
ঘ.    সাধারণ অভাবী লোকদেরকে।
ঙ.    অভিভাবকহীন বিধবাদেরকে।
চ.    নিঃস্ব এতিমদেরকে।
ছ.    মযলুমদেরকে।
জ.    বিপদগ্রস্তদের সাহায্যার্থে।
ঝ.    নিগৃহীত, ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদকৃত এবং মুহাজিরদের সাহায্যার্থে।
ঞ.    নিঃস্ব পথিকদেরকে।
ট.    ঋণগ্রস্ত দেউলিয়াদেরকে।
ঠ.    পরের দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্তির কাজে।
ড.    জনকল্যাণের কাজে (অর্থাৎ শিক্ষা, চিকিৎসা, জনপথ তৈরি, সুস্থ পরিবেশ তৈরি, পানি সরবরাহসহ যাবতীয় মানব কল্যাণের কাজে ব্যয় করা)।
ঢ.    মসজিদ নির্মাণের কাজে।
ণ.    আল্লাহর পথে (অর্থাৎ ইসলাম প্রচার প্রসারের কাজে। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্র, হামলা ইত্যাদি প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষার কাজে)। কুরআন মজিদে এ খাতটিকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এসব কাজে ব্যয় করাকে কুরআন মজিদে এবং হাদিসে মুমিনদের জন্যে প্রভুত নেকি, সওয়াব, মর্যাদা, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত লাভের উপায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২.    উপহার বা হাদিয়া হিসেবে দান।
৩.    অসিয়তের মাধ্যমে দান : কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে তার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত অসিয়ত করে (আদেশ / উপদেশ দিয়ে) দান করে যেতে পারেন।
৪.    ওয়াক্ফ : কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার উৎপাদনশীল কোনো অর্থ সম্পত্তি জনকল্যাণের কাজে দান করে যাওয়াকে ওয়াক্ফ বলা হয়। ওয়াক্ফ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকার কিংবা জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে।
৫.    হেবা : হেবা হলো কোনো ব্যক্তিকে স্থায়ী ও নি:স্বার্থভাবে নিজের কোনো সম্পদ দিয়ে দেয়া।
৬.    ফল বা উৎপাদন ভোগের সুবিধা প্রদান : এটা হলো নির্দিষ্ট মওসূম বা সময়ের জন্যে নিজের কোনো বাগান বা গাছের ফল কিংবা গাভীর দুগ্ধ কাউকেও ভোগ করার সুবিধা দান করা।
৭.    আকস্মিক সংকট উত্তরণে সাহায্য করা : এটা হলো হঠাৎ কেউ কোনো সংকটে, সমস্যায় বা বিপদে পড়লে তাকে আর্থিক সাহায্য করা।
দান করার অসীম কল্যাণ সম্পর্কে কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অবহিত করেছেন। এর জন্যে তিনি উপদেশ দিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করা হলো :
وَأَنفِقُوا خَيْرًا لِّأَنفُسِكُمْ ۗ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ 
অর্থ: দান করো। এতেই রয়েছে তোমাদের নিজেদের জন্যে কল্যাণ। যারা মনের সংকীর্ণতা (কৃপণতা) থেকে মুক্ত হয়, তারাই ফালাহ (সফলতা) অর্জনকারী। (সূরা ৬৪ আত্ তাগাবুন : আয়াত ১৬)
لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ 
অর্থ: তোমরা ততোক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণ লাভ করবেনা, যতোক্ষণনা তোমাদের পছন্দের জিনিস দান করো। (সূরা ৩ আলে ইমরান : আয়াত ৯২)
مَّثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍ ۗ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ 
অর্থ: যারা নিজেদের অর্থ সম্পদ আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে, তাদের (দানের) উপমা একটি শস্যবীজ, যা উৎপাদন করে সাতটি শীষ এবং প্রত্যেক শীষে শতদানা। (এভাবেই) যাকে ইচ্ছা আল্লাহ বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। তিনি মহা প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী। (সূরা ২ বাকারা : আয়াত ২৬১)
لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ 
অর্থ: পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরানোতে প্রকৃত পক্ষে পুণ্য নেই। প্রকৃত পুণ্যের কাজ হলো, মানুষ ঈমান আনবে আল্লাহ্র প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, আল কিতাবের প্রতি, নবীদের প্রতি; আর আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থ সম্পদ দান করবে আত্মীয় স্বজনকে, এতিমদেরকে, অভাবীদেরকে, পথিকদেরকে, সাহায্যপ্রার্থীদেরকে এবং মানুষকে গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত করার কাজে; এছাড়া সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিয়ে দেবে। সূরা ২ : ১৭৭
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا  الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَيَكْتُمُونَ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا  وَالَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ رِئَاءَ النَّاسِ 
অর্থ: তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করো, তাঁর সাথে কোনো কিছুকেই শরিক করোনা। আর ইহসান (দয়া ও সহানুভূতিমূলক আচরণ) করো পিতামাতার সাথে, আত্মীয় স্বজনের সাথে, এতিমদের সাথে, অভাবীদের সাথে, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, অনাত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে, সাথি বন্ধুদের সাথে, পথিকদের সাথে এবং তোমাদের অধিনস্ত ভৃত্যদের সাথে। জেনে রাখো, আল্লাহ দাম্ভিক ও অহংকারী লোকদের পছন্দ করেননা, যারা কার্পণ্য কঞ্জুসি করে, মানুষকে কৃপণতার শিক্ষা দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহ (অর্থ সম্পদ) থেকে তাদের যা দান করেছেন তা গোপন করে রাখে। এ ধরণের অকৃতজ্ঞ লোকদের জন্যে আমরা অপমানকর আযাবের ব্যবস্থা করে রেখেছি। (আর ঐ সব লোকদেরও আল্লাহ পছন্দ করেন না) যারা কেবল লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের অর্থ সম্পদ দান করে। (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৩৬-৩৮)
দান সম্পর্কে কুরআন মজিদে আরো বহু আয়াত রয়েছে। এ সম্পর্কে আছে রসূলুল্লাহ সা.-এর অনেক হাদিস। আগ্রহীগণ সেগুলো দেখে নেবেন।
সবশেষে আমরা ইসলামি অর্থনীতির কল্যাণধর্মীতা সম্পর্কে আধুনিক জগতের খ্যাতনামা ইসলামি চিন্তাবিদ ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ আবুল আ’লা মওদূদীর একটি দীর্ঘ বক্তব্যের অংশ বিশেষ উল্লেখ করতে চাই। তিনি লিখেছেন :
“ইসলাম শুধু এতোটুকুই চায়না যে, সমাজ জীবনে কেবল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত এবং অবাধ থাকবে; বরঞ্চ সেইসাথে এটাও চায় যে, এ ময়দানে প্রতিযোগীগণ পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠুর ও নির্দয় হবার পরিবর্তে সহমর্মী ও পিছে পড়ে থাকা মানুষের আশ্রয় প্রদানের মানসিকতা সৃষ্টি করতে চায়। অপরদিকে সমাজে এমন একটি শক্তিশালী সংস্থা গড়ে তুলতে চায়, যে সংস্থা অক্ষম ও অসহায় লোকদের সাহায্যের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। যেসব লোকের জীবিকা উপার্জনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা থাকবেনা, তারা এই সংস্থা থেকে নিজেদের অংশ পাবে; যারা দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে, এই সংস্থা তাদের উঠিয়ে এনে আবার চলার যোগ্য করে দেবে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্যে যাদের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হবে, এই সংস্থা থেকে তারা সাহায্য সহযোগিতা লাভ করবে। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম আইনগতভাবে দেশের গোটা সঞ্চিত সম্পদ থেকে বার্ষিক ২.৫% এবং গোটা বাণিজ্যিক পুঁজি থেকে বার্ষিক ২.৫% যাকাত সংগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েছে। সমস্ত উশরি জমির উৎপন্ন ফসল থেকে ১০% কিংবা ৫% উশর এবং কোনো কোনো খনিজ সম্পদের উৎপাদন থেকে ২০% যাকাত উসুল করতে হবে। এছাড়া গৃহপালিত পশুর উপরও বার্ষিক যাকাত আদায় করতে বলেছে। এই গোটা সম্পদ ইসলাম গরীব, এতিম, বৃদ্ধ, অক্ষম, উপার্জনহীন, রোগী এবং সব ধরণের অভাবী ও দরিদ্রদের সাহাযার্থে ব্যবহার করতে বলেছে। এটা এমন একটা সামাজিক বীমা, যার বর্তমানে ইসলামি সমাজে কোনো ব্যক্তি জীবন যাপনের অপরিহার্য সামগ্রী থেকে কখনো বঞ্চিত থাকতে পারেনা। কোনো শ্রমজীবী মানুষকে অভূক্ত থাকার ভয়ে কারখানা মালিক বা জমিদারের যেকোনো অন্যায় শর্ত মেনে নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হতে হবেনা। আর উপার্জনের প্রতিযোগিতায় নামার জন্যে ন্যূনতম যে শক্তি সামর্থ্য থাকা অপরিহার্য, কোনো ব্যক্তির অবস্থাই তার চেয়ে নীচে নেমে যাবেনা।” (আবুল আ’লা মওদূদী : ইসলামী অর্থনীতি, বঙ্গানুবাদ ৪র্থ মুদ্রণ ২০০৯, শতাব্দী প্রকাশনী ঢাকা।)

১৭.    যারা ইসলামি অর্থনীতি চর্চা করতে চান তাদের জন্যে ক’টি পরামর্শ
যারা ইসলামের অর্থনীতি ও অর্থ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে ও চর্চা করতে আগ্রহী, এখানে তাদের জন্যে কয়েকটি পরামর্শ পেশ করা হলো :
১.    অর্থনীতিকে একক বা স্বতন্ত্র কোনো শাস্ত্র হিসেবে চিন্তা করবেন না। অর্থ এবং অর্থনীতিকে মানব জীবন ও জীবন-ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য কাঠামোর একটি অংগ, অংশ এবং বিভাগ হিসেবে ভাবুন।
২.    আপনার দেহের একটি অংগকে যেমন অযথা অন্য অংগের উপর প্রধান্য দেয়া উচিত নয়, তেমনি অর্থ এবং অর্থনীতিকে আপনার জীবন ও জীবন ব্যবস্থার অন্যান্য বিভাগের উপর অযথা অগ্রাধিকার দিতে যাবেন না। সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভংগি ও নীতি অবলম্বন করুন।
৩.    ইসলামি অর্থনীতিকে ইসলামি জীবন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ ও বিভাগ হিসেবে গ্রহণ করুন।
৪.    ইসলামি অর্থব্যবস্থার নীতি কাঠামো বুঝার জন্যে এক বা একাধিক বার মনোযোগ সহকারে আল কুরআন পাঠ (অধ্যয়ন, স্টাডি) করুন। সাথে সাথে অর্থ সম্পদ ও জীবিকা সংক্রান্ত আয়াতগুলো নোট করুন। সেই সাথে :
ক.    অর্থ সম্পদকে কিভাবে ঈমান, জীবন ব্যবস্থা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও সাফল্যের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে, তা বিশেষভাবে লক্ষ্য করুন এবং নোট করুন।
খ.    কি কি কারণ ও প্রক্রিয়ায় অর্থ সম্পদ মানব জীবনে ব্যর্থতা ও ধ্বংস ডেকে আনে সে বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন এবং নোট করুন।
গ.    অতপর আপনার মাথায় (মনের মনিকোঠায়) এবং খাতায় অংকিত ধারণাগুলোকে পয়েন্ট আকারে লিপিবদ্ধ করুন এবং চর্চা করুন।
৫.    বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থের ‘অর্থ সম্পদ’ ও ‘ব্যবসা বাণিজ্য’ সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো কুরআনের অনুরূপ পদ্ধতিতে অধ্যয়ন করুন।
৬.    কয়েকটি ফিকহ্ গ্রন্থ পড়ে নিন। যেমন :
ক.    হিদায়া।
খ.    ফিকহুস সুন্নাহ : সাইয়েদ সাবেক।
গ.    হালাল ও হারাম : ইউসুফ আল কারদাভি।
৭.    ইসলামি অর্থনীতি ও অর্থব্যবস্থা সংক্রান্ত বাংলা ভাষায় লিখিত কয়েকটি বই পড়ে নিন। যেমন :
০১.    ইসলামি অর্থনীতি : আবুল আ’লা মওদূদী
০২.    ইসলামি অর্থনীতি : মুহাম্মদ আবদুর রহিম
০৩.    ইসলামি অর্থনীতি : ড. হাসান জামান
০৪.    ইসলামের অর্থনৈতিক মতাদর্শ : ড. মুহাম্মদ ইউসুফুদ্দীন
০৫.    ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ : ড. এম. উমর চাপরা
০৬.    ইসলামী অর্থনীতি : নির্বাচিত প্রবন্ধ : শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
০৭.    ইসলামের যাকাত বিধান : ড. ইউসুফ আল কারদাভি
০৮.    অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামী সমাধান : আবুল আ’লা মওদূদী
০৯.    আল কুরআনের অর্থনৈতিক নীতিমালা : আবুল আ’লা মওদূদী
১০.    ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ : আবুল আ’লা মওদূদী
১১.    সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং : আবুল আ’লা মওদূদী
৮.    আধুনিক কালে যারা ইসলামি অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণা করেছেন, করছেন এবং ব্যাপক লেখালেখি করেছেন তাদের সম্পর্কে জানুন এবং তাদের গ্রন্থাবলী পড়–ন। তাদের কয়েকজন হলেন : মুহাম্মদ আনাস যারকা, আবুল আ’লা মওদূদী, ড. ইউসুফ আল কারদাভি, মুহাম্মদ বাকির সদর, প্রফেসর খুরশিদ আহমদ, ড. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকি, প্রফেসর মুনযের কাহ্ফ, ড. এম. উমর চাপরা, ফাহিম খান, মুনাওয়ার ইকবাল, আকরাম খান, ইউসুফ কামাল, মুস্তফা যারকা, আহমদ আল নাজ্জার, সাবাহ উদ্দিন সায়েম প্রমূখ।
আমাদের বাংলাদেশে যারা এ ক্ষেত্রে অগ্রণি ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন : প্রফেসর ড. এম.এ. মান্নান, প্রফেসর আবদুল হামিদ, প্রফেসর শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রফেসর মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, প্রফেসর ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক প্রমূখ।
৯.    ইসলামি অর্থব্যবস্থার নীতিমালার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানুন। এ সম্পর্কে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু বই পুস্তক বাজারে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি ব্যাংকগুলোর নীতিমালা এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগ পদ্ধতি জেনে নিন। এ সম্পর্কে তাদের পুস্তিকা সমূহও পড়ুন।

সমাপ্ত
১৮. গ্রন্থসূত্র
০১.    আল কুরআন
০২.    সহীহ আল বুখারি
০৩.    সহীহ মুসলিম
০৪.    জামে তিরমিযি
০৫.    মিশকাতুল মাসাবিহ্
০৬.    সাইয়েদ সাবিক : ফিক্হুস্ সূন্নাহ্
০৭.    মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন : আল জামেউল আহকাম ফিক্হুস্ সুন্নাহ
০৮.    বুরহানুদ্দীন ফরগনানি : হিদায়া
০৯.    Muhammad Akram Khan : Economic Teaching of Prophet Mohammad
১০.    আবুল আ’লা মওদূদী : ইসলামী অর্থনীতি
১১.    আবুল আ’লা মওদূদী : সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং
১২.    আবুল আ’লা মওদূদী : ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ
১৩.    আবুল আ’লা মওদূদী : অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামী সমাধান
১৪.    আবুল আ’লা মওদূদী : আল কুরআনের অর্থনৈতিক নীতিমালা
১৫.    Dr. M. Umer Chapra : Islam and the Economic Challenge
১৬.    ড. হাসান জামান: ইসলামী অর্থনীতি
১৭.    ড. ইউসুফ আল কারদাভি : হালাল ও হারাম
১৮.    ড. ইউসুফ আল কারদাভি : মুশকিলাতুল ফাকর ওয়া কাইফা আলাজাহাল ইসলাম
১৯.    ড. ইউসুফ আল কারদাভি : ইসলামের যাকাত বিধান
২০.    মুহাম্মদ আবদুর রহীম : ইসলামী অর্থনীতি
২১.    প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান : প্রিন্সিপলস অব ইকোনমিক্স
২২.    ড. মুহাম্মদ ইউসুফুদ্দীন : ইসলামের অর্থনৈতিক মতাদর্শ
২৩.    আবু উবায়েদ আল কাসিম বিন সাল্লাম : কিতাবুল আওয়াল
২৪.    শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান : ইসলামী অর্থনীতি : নির্বাচিত প্রবন্ধ
২৫.    শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান : সূদ একটি ভয়াবহ অভিশাপ : পরিত্রাণের উপায়
২৬.    এমরান এন. হুসাইন : ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ কেন?
২৭.    মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন : সুদ, সমাজ অর্থনীতি
২৮.    মুহাম্মদ বাকির সদর : ইসলামি ইকতিসাদিয়াত
২৯.    Ayatullah Sayyid Mahmud Taleghani : Society and Economics in Islam
___________________________________________________________________বই সম্পর্কিত তথ্যাবলী
বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা সোসাইটি
ISBN: 978-984-645-053-8

ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা আবদুস শহীদ নাসিম, © author প্রকাশক: বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা সোসাইটি। পরিবেশক : শতাব্দী প্রকাশনী ৪৯১/১ মগবাজার ওয়ারলেস রেলগেইট, ঢাকা-১২১৭, ফোন : ৮৩১১২৯২। ১ম প্রকাশ ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯। কম্পোজ Saamra Computer. মুদ্রণে আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস, ৪২৩ বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।

Book Title : Islami Orthonitite Uparjon O Bayer Nitimala Author : Abdus Shaheed Naseem, Published by Bangladesh Quran Shikkha Society, Distributor: Shotabdi Prokashoni, 491/1 Moghbazar Wireless Railgate, Dhaka-1217, Bangladesh. Phone: 8311292. First Edition: December 2009.

দাম : ১৯ টাকা মাত্র।  Price TK. : 19.00 Only


বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত
নিম্নোক্ত বইগুলো পড়ুন :
    কুরআন বুঝার প্রথম পাঠ
    জানার জন্যে কুরআন মানার জন্যে কুরআন
    মানুষের চিরশত্রু শয়তান
    ঈমান ও আমলে সালেহ্
    ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা

সূচিপত্র______________________________________________
০১.        অর্থ কী?    ৫
০২.        অর্থনীতি কী?    ৫
০৩.        অর্থনীতির ইসলামি সংজ্ঞা    ৬
০৪.        ইসলামি অর্থব্যবস্থার ভিত্তি    ৬
০৫.        ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য সমূহ    ৯
০৬.        ইসলামি অর্থনীতির উদ্দেশ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য    ১৩
০৭.        ইসলামে অর্থ উপার্জনের তাকিদ    ১৪
০৮.        হালাল ও বৈধ উপার্জনকারীর পরকালীন সাফল্য    ১৬
০৯.        হারাম ও অবৈধ উপার্জনের ভয়াবহ পরিণতি    ১৬
১০.        হালাল ও বৈধভাবে অর্থ উপার্জনের উপায় সমূহ    ১৭
১১.        নারীর অর্থ উপার্জন ও সম্পদের মালিকানা অর্জন    ১৮
১২.        নারীদের  খরচের খাত    ১৯
১৩.        অর্থ উপার্জনের হারাম ও নিষিদ্ধ উপায় সমূহ    ২০
১৪.        অর্থ সম্পদ ব্যয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যা যা নিষিদ্ধ    ২৩
১৫.        যেসব খাতে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক    ২৫
১৬.        ব্যয়ের কল্যাণময় স্বেচ্ছামূলক খাতসমূহ     ২৬
১৭.        যারা ইসলামি অর্থনীতি চর্চা করতে চান তাদের জন্যে ক’টি পরামর্শ    ৩০
১৮.        গ্রন্থসূত্র    ৩২



মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০ 0
বার দেখা হয়েছে

লিখেছেন মসজিদে নববীর পরিচালনা-পরিষদ   
Sunday, 14 June 2009

বিস্‌মিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহিম
মসজিদে নববীর সাথে সংশ্লিষ্ট আদবসমূহ
অনুবাদ: নূরুল্লাহ্ তা'রীফ
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালক ‘আল্লাহ্‌ তাআলার’ জন্য। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।

প্রিয় মুসলিম ভাই,
সে মহান আল্লাহর প্রশংসা করুন যিনি আপনাকে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে পৌঁছিয়েছেন। যে মসজিদের এক রাকাত নামাজ অন্য মসজিদের হাজার রাকাত নামাজের চেয়ে বেশী উত্তম, শুধু ‘মসজিদে-হারাম’ ছাড়া। যেখানে কল্যাণকর কিছু শিখতে আসা অথবা শিখানোর উদ্দেশ্যে আসা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার তুল্য। অতএব মসজিদে নববীতে যত বেশী নামাজ আদায় করা যায় সে জন্য আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকা উচিত এবং মসজিদে যে সকল ইলমের আসর রয়েছে সেগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য আপনার আগ্রহ থাকা উচিত, যেন আপনি স্বচ্ছ জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহর ইবাদত পালন করতে পারেন এবং অজানা বিষয়গুলো প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারেন।

বিস্‌মিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহিম
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ) (الانبياء:7
“আর তোমরা যদি না জান তবে আলেমদের জিজ্ঞেস কর।” [সূরা আম্বিয়া-৭] জেনে রাখুন, এ মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু আদব-আখলাক রয়েছে যেগুলো আমাদের বজায় রাখা উচিত। এর কয়েকটি আমরা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি-

(১) মুসলিম নর-নারী পরিপূর্ণ ভাব-গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে, ধীর-স্থিরে, পবিত্রতার সাথে, সুন্দর বেশ-ভূষা নিয়ে মসজিদে আসবেন। বিড়ি-সিগারেট, পেঁয়াজ, রসূন ইত্যাদির র্দুগন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে ভাল ঘ্রাণ নিয়ে তারা আল্লাহর ঘরে আসবেন। কারণ বনী আদম যা থেকে কষ্ট পায় আল্লাহর ফেরেশতারাও তা থেকে কষ্ট পায়।

(২) ডান পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করবেন এবং মসজিদে প্রবেশের দোয়া পড়বেন। বলবেন-
بِسْمِ اللهِ وَ الصَّلاَةُ وَ السَّلاَمُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ، أَعُوْذُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ وَ بِوَجْهِهِ الْكَرِيْمِ وَ سُلْطَانِهِ الْقَدِْيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، اَلَّلهُمَّ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ.
মসজিদে ঢুকে প্রথমে ‘তাহিয়্যাতুল’ মসজিদ দুই রাকাত নামাজ পড়বেন, তারপর যিকির-আযকার, ইবাদত-বন্দেগী বা কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল হবেন।

(৩) আপনি যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে সালাম দিতে যাবেন তখন আদবের সাথে তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে বলবেনঃ
السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُُّ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهُ. أَشْهَدُ أنَّكَ بَلَّغْتَ الرِّسَالََةََ وَ أدَّيْتَ الأمَانَةَ وَ نَصَحْتَ الأُمَّةَ وَ جَاهَدْتَ فِيْ اللهِ حَقَّ جِهَادِه، فَجَزَاكَ اللهُ عَنِّي وَ عَنِ الْمُسْلِمِيْنَ خَيْرَ الْجَزَاء.
“হে নবীজি, আপনার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি রিসালত পৌঁছিয়েছেন, আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন, উম্মতকে নসীহত করেছেন, আল্লাহর রাস্তায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আল্লাহ আপনাকে আমার পক্ষ থেকে এবং সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন।”

এরপর আবু বকর ও উমর রাদিআল্লাহু আনহুমার নাম উল্লেখ করে তাদেরকে সালাম দিবেন। তারপর আপনি মসজিদের যে কোন নিরিবিলি স্থানে গিয়ে আল্লাহর কাছে যা ইচ্ছা দোয়া করুন। এই একীন ও এই বিশ্বাসের সাথে দোয়া করবেন - ভালমন্দের মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌। অতএব অন্য কারো ধর্ণা না ধরে দুনিয়া-আখেরাতের যাবতীয় প্রয়োজন সরাসরি তাঁর কাছে পেশ করুন। প্রিয় নবীজি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] ইরশাদ করেছেন, “যখন তুমি প্রার্থনা কর তখন সরাসরি আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা কর। যখন তুমি সাহায্য কামনা কর তখনও সরাসরি আল্লাহর কাছেই সাহায্য কামনা কর।” বরকতের নিয়তে মসজিদের গ্রিল বা দেয়াল স্পর্শ করবেন না, চুমা খাবেন না। রাসূলকে [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সালাম দেয়ার সময় নামাযে দাঁড়াবার মত হাত বেধে দাঁড়াবেন না এবং দূর থেকে সালাম দিবেন না, কারণ এটা সাহাবায়ে কেরামের আমলের বরখেলাফ।
(৪) মসজিদে থাকাকালীন সময়টাকে পরিপূর্ণ কাজে লাগান। ফরজ নামাজ শেষে নামাজের জায়গায় বসে তাসবীহ পড়ুন, যিকির করুন অথবা কুরআন তেলাওয়াত করুন। সবসময় ভিড়মুক্ত স্থান নির্বাচন করুন, যেন ভিড় সৃষ্টিতে আপনার কোন অংশগ্রহন না থাকে এবং অপর মুসলিম ভাইকে কষ্ট দিয়ে আপনি গুনার-ভাগী না হন।
(৫) কাতারের খালি জায়গা পূর্ণ করার জন্য উৎসাহী হোন। চাপাচাপি না হলে ফজীলত পাওয়ার জন্য সবসময় সামনের কাতারে দাঁড়াবার চেষ্টা করুন। যাতায়াতের পথে অথবা দরজার সামনে বসবেন না। এতে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে অন্য মুসলিম ভায়ের কষ্ট হয়। বাইরের আঙ্গিনায় নামাজ পড়াকালে ইমামের সমান্তরালের সামনে গিয়ে কাতার করবেন না। পিলারগুলোর সাথে লাগানো সাইনবোর্ড দেখে ইমামের সমান্তরাল রেখা জেনে নিন।
(৬) আল্লাহর কিতাবকে যথাযথ সম্মান করুন। কুরআনের উপরে বা ভিতরে কিছু লিখবেন না, এর পাতা নিয়ে অনর্থক খেলা করবেন না। কুরআন শরীফের পাশে জুতা রাখবেন না।
(৭) কফ, থুথু ও ময়লা-আবর্জনা থেকে মসজিদ এবং মসজিদের আঙ্গিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। আপনার শিশুকে মসজিদের আদব-কায়দা শিক্ষা দিন। অনর্থক খেল-তামশা ও হৈ-হুল্লোড় থেকে তাদেরকে বিরত রাখুন।
(৮) মসজিদ থেকে একটু বিলম্বে বের হতে পারেন, যাতে মসজিদের গেটগুলোতে ভিড় অপেক্ষাকৃত কম হয়।
(৯) জেনে রাখুন মসজিদ ঘুমাবার জায়গা নয়। ভিক্ষা করা বা হারানো বস্তু তালাশ করার জন্য মসজিদ নয়।
(১০) খাবার পানি দিয়ে অজু করবেন না এবং মসজিদের কার্পেটগুলোকে গোল করে বালিশ বানাবেন না অথবা গায়ে দিবেন না। এ কার্পেটগুলো নামাজ পড়ার জন্য ওয়াক্‌ফ করা হয়েছে, বিছানা বানাবার জন্য নয়। তদ্রূপ কুরআন শরীফের রেহালগুলো মাথার নীচে দিয়ে ঘুমাবেন না, কারণ এগুলো শুধুমাত্র কুরআন শরীফ রাখার জন্য ওয়াক্‌ফকৃত।

পরিশেষে বলতে চাই, মসজিদ নববীর পরিচালনা-পরিষদের সাথে আপনার সহযোগিতা এবং যে কোন ধরণের সু-পরামর্শ বা মন্তব্য এ পবিত্র স্থানের যিয়ারতকারীদের সেবার মানকে আরো উন্নত করতে সহায়তা করবে। অতএব নির্দ্বিধায় এ জাতীয় যে কোন মন্তব্য বা পরামর্শ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করুন। আল্লাহ্‌ আপনার আমল কবুল করে নিন, আপনার প্রতিদান বহুগুনে বৃদ্ধি করুন।

আস্‌সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
মসজিদে নববীর পরিচালনা-পরিষদ
মদীনা মোনাওয়ারা
সৌদি আরব



মুসলিম নারীর বিধান

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০ 0
বার দেখা হয়েছে



লিখেছেন মক্তব তাও‘ইয়াতুল জালিয়াত, আল-জুলফী   
Thursday, 11 June 2009

বিস্‌মিল্লাহির রহমানির রহীম
ইসলামে নারীর মর্যাদা
ইসলামে নারীদের অধিকার সম্পর্কে উপস্থাপনের পূর্বে অন্যান্য জাতির নিকট তাদের মর্যাদা এবং তাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হত, সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা অতি আবশ্যক মনে করছি।

ইউনানদের নিকট মেয়েরা ছিল বেচা-কেনার সামগ্রী। তাদের কোন প্রকার অধিকার ছিল না। সমস্ত অধিকার পুরুষের জন্যই বরাদ্দ ছিল। মীরাস থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। ধনসম্পদে তাদেরকে কোন হস্তক্ষেপ করতে দেয়া হত না। প্রসিদ্ধ দার্শনিক সুক্বরাতেরের বক্তব্য হলো- ‘পৃথিবীর অধঃপতনের বড় ও প্রধান কারণই হলো নারীদের অস্তিত্ব। নারীরা হলো এমন একটি বিষাক্ত বৃক্ষের মত, যার বাহ্যিক অতি সুন্দর কিন্তু চড়ই পাখি যখনই সে বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে।’

রোমকরা নারীদেরকে একটি আত্মাহীন বস্তু বলে গণ্য করতো। নারীদের কোন অধিকার এবং মূল্য তাদের নিকট ছিল না। তাদের কথা হলো- ‘নারীদের রূহ্‌ বা আত্মা নেই’। তাই তাদেরকে খুঁটির সাথে বেঁধে দ্রুতগতিতে ছুটিয়ে তাদের প্রাণ নাশ করা হতো।

হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থা আরো জঘন্য ও নিকৃষ্ট ছিল। তারা নারীকে তার স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিত (যাকে সতীদাহ প্রথা বলা হয়)।

চীনারা বলে- নারীরা এমন যাতনাদায়ক পানি সদৃশ, যা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সমৃদ্ধিকে ধুয়ে-মুছে বিনাশ করে দেয়। প্রত্যেক চীনার তার স্ত্রীকে বিক্রয় করার এবং জীবদ্দশায় তাকে সমাধিস্থ করার অধিকার ছিল।

ইয়াহূদীরা নারীদের মনে করে এক অভিশপ্ত প্রাণী। কারণ, এই নারীই নাকি আদমকে পথভ্রষ্ট করেছে এবং তাকে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে বাধ্য করেছে। অনুরূপভাবে তারা নারীকে অপবিত্রা মনে করে; তাই তারা ধরে নেয়- যখন তার মাসিক হয়, তখন সমস্ত ঘর ও তার স্পর্শীয় সমস্ত বস্তু অপবিত্র হয়ে যায়। অনুরূপ ভাইয়ের উপস্থিতিতে পিতার সম্পদ থেকে সে মীরাসও পেত না।

খৃষ্টানদের নিকট নারী হলো- মানব জাতির সাথে নারীর কোন সম্পর্ক নেই। সাধু বুনাফান্তুর বলেন- ‘যখন কোন নারীকে দেখবে, তখন এটা মনে করবে না যে, তোমরা কোন মানব মূর্তি দেখছ, এমনকি কোন চতুষ্পদ পশুও না; বরং যা দেখেছ তা নিছক শয়তান। আর তা হতে যা শুন, তা হলো আজদাহার বাঁশী’। বৃটিশ আইনানুসারে বিগত শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত নারীরা দেশের নাগরিক হিসাবে গণ্য হত না। সব রকমের মালিকত্ব থেকে তারা হত বঞ্চিতা। এমনকি পরিহিত পোশাকটারও তারা মালিক হত না। ১৫৬৭ খৃষ্টাব্দে স্কটল্যাণ্ড পার্লামেন্টে এ আইন প্রণয়ন করা হয় যে, নারীদেরকে কোন কিছুর উপর আধিপত্য দেয়া বৈধ নয়। অনুরূপ বৃটিশ পার্লামেন্ট সপ্তম হেনরীর যুগে নারীদের জন্য ইঞ্জীল পাঠ নিষিদ্ধ করে দেয়।

কারণ, তারা অপবিত্রা। নারীরা মানুষ কিনা এ ব্যাপারে পর্যকেক্ষণের জন্য ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দে ফ্রান্সে একটি কন্‌ফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে এটাই স্বীকৃতি পায় যে, নারীরা মানুষ, তবে তাদেরকে পুরুষের সেবার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। বৃটিশ আইনানুযায়ী ১৮০৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বামীর জন্য তার স্ত্রীকে বিক্রয় করা বৈধ ছিল। ছয়পেনি (বৃটিশ মুদ্রা) পর্যন্ত তার মূল্য নির্দিষ্ট ছিল।

ইসলাম অবির্ভাবের পূর্বে আরবে নারীরা খুবই তুচ্ছ, ত্যাজ্য ও হেয় প্রতিপন্না ছিল। না তারা মীরাস পেত আর না কোন অধিকার। এমনকি তাদেরকে কোন কিছু গণ্যই করা হত না। আবার অনেকে তদের মেয়েদেরকে জীবন্ত সমাধিস্থ করতো। অতঃপর নারীদেরকে নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিতে এবং নারী-পুরুষ সকলে সমান, পুরুষের ন্যায় তাদেরও অধিকার আছে-এর উদাত্ত ঘোষণা দিতে অবির্ভাব হয় ইসলাম। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوباً وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ -سورة الحجرات: 13
অর্থাৎ, ((হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রী হতে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে জাতি ও ভ্রাতৃগোষ্ঠী বানিয়ে দিয়েছি, যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। বস্তুতঃ আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানী সে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহ্‌ভীরু।)) [সূরা আল-হুজরাতঃ ১৩] তিনি অরো বলেনঃ

وَمَن يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتَ مِن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُوْلَـئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلاَ يُظْلَمُونَ نَقِيراً - سورة النساء: 124
অর্থাৎ, ((আর যে নেক কাজ করবে-সে পুরুষ হোক বা মহিলা হোক-সে যদি ঈমানদার হয়, তবে এই ধরনের লোকই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের বিন্দু পরিমাণ হকও নষ্ট হতে পারবে না।)) [সূরা আন্‌-নিসাঃ ১২৪] তিনি আরো বলেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً - سورة العنكبوت: 8
অর্থাৎ, ((আমি মানুষকে নিজের পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি।)) [সূরা আল-আনকাবূতঃ ৮] রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

أكملُ المؤمنينَ إيماناً أحسنهُم خُلقاً. وخياركُم خياركُم لنسائِهِم - الترمذي: 1172
অর্থাৎ, ((পরিপূর্ণ ঈমানদার তো সে-ই, যার চরিত্র সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীদের প্রতি উত্তম।)) [তীরমিজীঃ ১১৭২] এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলোঃ

من أحق الناس بحسن صحابتي؟ قال: (أمك). قال: ثم من؟ قال: (ثم أمك). قال: ثم من؟ قال: (ثم أمك). قال: ثم من؟ قال: (ثم أبوك). - صحيح البخاري: 5626, مسلم: 2546
অর্থাৎ, ((মানুষের মধ্যে আমার উত্তম ব্যবহারের সর্বাধিক অধিকারী কে? উত্তরে তিনি বললেনঃ তোমার মা। অতঃপর সে বললঃ তারপর কে? তিনি জবাব দিলেনঃ তোমার মা। অতঃপর সে আবার বললঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। তারপর কে? বললেনঃ তোমার বাবা।)) [বুখারীঃ ৫৬২৬, মুসলিমঃ ২৫৪৬] এই হলো নারীদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে ইসলামের ধ্যান-ধারণা।
 

নারীর সাধারণ অধিকার
নারীর এমন সাধারণ অধিকার রয়েছে, যা তার নিজেরও জানা উচিত এবং সকলের এই মৌলিক অধিকার গুলো স্বীকৃতি দেয়া উচিত। ফলে যখনই চাইবে তা পুরাপুরি উপভোগ করতে পারবে। আর এই অধিকারের সার কথা হলোঃ

১)) মালিক হওয়ার অধিকার। নারী ঘর-বাড়ী, চাষাবাদের জমি, শিল্প-কারখানা, উদ্যান, সোনা-রূপা ও বিভিন্ন প্রকারের গবাদি পশুসহ সব কিছুর মালিক হতে পারবে। চাই সে স্ত্রী হোক অথবা মা হোক অথবা কন্যা বা বোন হোক।

২)) বিয়ে করা, স্বামী নির্বাচন, খুলআ’ কামনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার তার রয়েছে। আর এগুলো নারীর প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত অধিকার।

৩)) তার উপর ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যক বস্তুর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ও অনিস্বীকার্য বিষয়। যেমন মহান আল্লাহ্‌ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, তাঁর ইবাদত করার পদ্ধতি শিক্ষা, নৈতিক দায়িত্ব ও করণীয় বিষয়ের জ্ঞান লাভ করা, তার সমাগ্রিক জীবনের শিষ্টাচার সম্পর্কে জানা এবং উৎকৃষ্ট চরিত্রের জ্ঞান অর্জন করা প্রভৃতি। কারণ এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ সকলের জন্যই। তিনি বলেনঃ

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ - سورة محمد: 19
অর্থাৎ, ((জেনে রাখ! আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই।)) [সূরা মুহাম্মাদঃ ১৯] রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

طلب العلم فريضة عَلَى كُلّ مسلم - ابن ماجة: 224
অর্থাৎ, ((প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয।)) [ইবনে মাজাঃ ২২৪]

৪)) নিজের ধন-সম্পদ ও অর্থবিত্ত থেকে স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী সদকা করতে ও স্বামী, সন্তান-সন্ততি এবং পিতা-মাতার জন্য ব্যয় করতে পারবে, যতক্ষণ না সেটা অপচয় ও অপব্যয়ের পর্যায় পৌঁছে। এ ব্যাপারে তার অধিকার সম্পূর্ণরূপে পুরুষের অধিকারের মত।

৫)) ভালবাসা ও ঘৃণা করার অধিকার। সে সৎ ও নির্মল চরিত্রা নারীগণকে ভালবাসতে পারবে। ফলে স্বামী থাকলে তার অনুমতিক্রমে তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা, তাদেরকে উপহার দেয়া, পত্র বিনিময় করা, কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, বিপদ ও দুর্যোগের দিনে সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করা ইত্যাদি করতে পারবে। (এটা নারীর শুধু অধিকার নয়; বরং এটা তার উচ্চ মানসিকতা ও দায়িত্ব সচেতনতার পরিচয়।) অধিকন্তু চরিত্রহীনা মহিলাদের ঘৃণা করবে এবং আল্লাহর নিমিত্তে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে।

৬)) জীবদ্দশায় নিজ ধন-সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের অসিয়ত করতে পারবে এবং কোন অভিযোগ আপত্তি ছাড়া তার মৃত্যুর পর তা কার্যêকর হবে। কেননা, অসিয়ত সাধারণ ব্যক্তিগত অধিকার। এ অধিকার যেমন পুরুষের রয়েছে, তেমনি নারীরও আছে। কারণ আল্লাহর সওয়াব ও প্রতিদান থেকে কেউ অমুখাপেক্ষী হতে পারে না। তবে অসিয়তকৃত অর্থ ও ধনসম্পদ এক তৃতীয়াংশের বেশী হতে পারবে না। আর এতেও পুরুষ ও নারীর অধিকার সমান।

৭)) স্বর্ণ ও রেশম যা চায় পরিধান করতে পারবে। আর এ দু’টি পুরুষদের জন্য হারাম। কিন্তু পরিধানের অধিকার স্বাধীনতার অর্থ কখনো এ নয় যে, পোষাক শূন্য হয়ে যাবে অথবা অর্ধাংশ, এক চতুর্থাংশ কাপড় পরবে কিংবা মাথা, গলা ও বক্ষদেশ উন্মুক্ত রাখবে। হাঁ, যদি এমন কোন ব্যক্তি হয় যার সামনে এগুলো করা যেতে পারে তার ব্যাপার ভিন্ন।

৮)) রূপচর্চার অধিকার অর্থাৎ, আপন স্বামীর মন সন্তুষ্টির জন্য রূপচর্চা করতে পারবে। সুরমা লাগাতে পারবে, গালে ও ওষ্ঠে লাল লিপষ্টিক ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবে, যদি সে ইচ্ছা করে। সর্বোৎকৃষ্ট মনোহারী ও সুন্দর পোশাক এবং হার ও গহনা পরতে পারবে। বাতিল ও সন্দেহ-সংশয়ের স্থান থেকে দূরে থাকার সংকল্পে পোষাক পরিচ্ছদে অমুসলিম নারীদের অথবা বেশ্যা, পতিতা ও দেহ ব্যবসায়ী ভ্রষ্টা নারীদের ফ্যাশন অবলম্বন করবে না।

৯)) পানাহারের অধিকার। যা-ই স্বাদ লাগে ও পছন্দ হয়, তা-ই সে পানাহার করতে পারবে। পানাহারের ব্যাপারে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই। যেমন হালাল বস্তু উভয়ের জন্য হলাল, তেমনি হরাম বস্তুও উভয়ের জন্য হরাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وكُلُواْ وَاشْرَبُواْ وَلاَ تُسْرِفُواْ إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ - ورة الأعراف: 31
অর্থাৎ, ((খাও, পান কর এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীকে ভালবাসেন না।)) [সূরা আল-আ‘রাফঃ ৩১] এ সম্বোধনে উভয় জাতিই অন্তর্ভুক্ত।
 

স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার
স্বামীর উপর স্ত্রীর বিশেষ অধিকার রয়েছে। এ সমস্ত অধিকার স্ত্রীর স্বামীর কিছু অধিকার পালন করার জন্য ওয়াজিব হয়। আর তা হলো, আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা না হলে, স্বামীর আনুগত্য করা, তার খাবার তৈরী করা, বিছানা পরিপাটি রাখা, তার সন্তানদের দুধ পান করানো, তাদের লালন-পালন করা, তার অর্থ-সম্পদ ও মান-মর্যাদা রক্ষা করা, নিজের সম্ভ্রম ও সতীত্ব রক্ষা করা, তার জন্য বৈধতার আওতায় রূপচর্চা করা ও নিজেকে সৌন্দর্যময় রাখা। নিম্নোক্ত জিনিসগুলো স্বামীর উপর স্ত্রীর অত্যাবশ্যকীয় অধিকার, যা আল্লাহ্‌র বাণী প্রমাণ করেঃ

وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ - سورة البقرة: 228
অর্থাৎ, ((নারীদের জন্য সঠিকভাবে সেরূপ অধিকার নির্দিষ্ট রয়েছে, যেমন তাদের উপর পুরুষদের অধিকার রয়েছে।)) [সূরা আল-বাকারাহঃ ২২৮]

আমরা সে অধিকারগুলো তুলে ধরছি, যেন মুমিন নারী তা জেনে নেয় এবং লজ্জা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও ভয়ভীতি ছাড়াই তা দাবী করে। আর স্বামীর দায়িত্ব হলো, সেগুলো পুংখানুপুংখরূপে আদায় করা। হাঁ, স্ত্রী তার অধিকারের কোন কিছু স্বামীকে ক্ষমা করতে পারে।

১)) স্বামী স্বীয় আর্থিক সচ্ছলতা বা সংকটজনক অবস্থা অনুসারে স্ত্রীর সমস্ত ব্যয়ভার গ্রহণ করবে। স্ত্রীর পোশাক, পানহারা, চিকিৎসা ও বাসস্থান এ ব্যয়ভারের আওতায় পড়ে।

২)) স্বামী স্ত্রীর অভিভাবক হেতু তার মান-সম্ভ্রম, দেহ, অর্থ-সম্পদ ও দ্বীন রক্ষা স্বামীর দায়িত্ব। কেননা, কোন কিছুর অভিভাবক হওয়ার মানেই হলো তার দেখা-শুনা, পরিচর্যা ও হেফাযত করা।

৩)) দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে দ্বীনের জরুরী বিষয় শিক্ষা দেয়া। তবে স্বামী তাতে সক্ষম না হলে অন্ততপক্ষে মহিলাদের জন্য আয়োজিত ইলমের সমাবেশগুলোতে যোগদান করার অনুমতি দেবে। তা মসজিদ, মাদ্রাসায় হোক বা অন্য কোথাও। তবে শর্ত এই যে সেখানে ফেত্‌না বা স্বামী-স্ত্রীর ক্ষতি সাধিত না হাওয়ার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত থাকতে হবে।

৪)) স্ত্রীর সঙ্গে সদ্‌ভাবে জীবন-যাপন করা তার অন্যতম অধিকার। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেনঃ

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ - سورة النساء: 19
অর্থাৎ, ((তাদের (স্ত্রীলোকদের) সাথে সদ্‌ভাবে জীবন-যাপন কর।)) [সূরা আন্‌-নিসাঃ ১৯]

স্ত্রীর যৌন কামনা পূরণের অধিকার হরন না করা, গালি ও মন্দ ব্যবহার না করা। ফিৎনার ভয় না থাকলে আত্বীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করতে বাধা না দেয়া, শক্তি ও সামর্থেøর ঊর্ধ্বে কাজের চাপ না দেয়া এবং কথা ও আচরনে সুন্দর ব্যবহার করা সদ্‌ভাবে জীবন যাপন করার আওতাভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

خيركم خيركم لأهله، وأنا خيركم لأهلي - سنن الترمذي: 3985
অর্থাৎ, ((তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে নিজ স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। আর আমি আমার পরিবারের নিকট তোমাদের চেয়ে উত্তম।)) [তিরমিজীঃ ৩৯৮৫] তিনি আরো বলেনঃ

ما أكرم النساء ألا كريم, وما أهانهن إلا لئيم
((আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই নারীদের মর্যাদা দান করে। আর অভদ্র-অসভ্যরাই তাদের তুচ্ছ ভাবে।))

পর্দা
পরিবারকে ধ্বংস ও অবনতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলাম সুষ্ঠ ব্যবস্থা দিয়েছে এবং তাকে চরিত্র ও শিষ্টচারের শক্ত জালের মাধ্যমে সুরক্ষিত করেছে। যাতে পরিবার ও সমাজ এমন সুষ্ঠ ও সুন্দর হয়, যেখানে থাকবে না প্রবৃত্তির উপদ্রব এবং স্বেচ্ছাচারের দৌরাত্ম্য। ফিৎনা সৃষ্টিকারী সকল উত্তেজনামূলক পথকে অবরোধ করতে নারী-পুরুষকে দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ দেয়। আল্লাহ্‌ তা‘আলা নারীর সম্মানার্থে, তার মান সম্ভ্রমকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার হাত থেকে রক্ষার্থে, কুপ্রবত্তি ও অসৎ লোকের কুদৃষ্টি থেকে দূরে রাখতে, যাদের নিকট মান-মর্যাদার কোন মূল্য নেই, তাদের থেকে তাকে হেফাযত করতে, বিষাক্ত দৃষ্টির সৃষ্ট ফিৎনার দরজা বন্ধ করতে এবং তার সম্ভ্রম ও নৈতিক পবিত্রতাকে সম্মান ও শ্রদ্ধার জালে সুরক্ষিত রাখতে পর্দার বিধান দান করেন।

আলেমদের ঐকমত্যানুযায়ী হাত ও মুখমণ্ডল ব্যতীত সর্বাঙ্গ আবৃত রাখা ওয়াজিব। নারীর কর্তব্য হলো, অপরিচিত পর পুরুষের সামনে সৌন্দর্যের প্রকাশ না করা। আর হাত ও মুখমণ্ডলকে আবৃত রাখার ব্যাপারে আলেমরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। প্রত্যেক দলের নিকট তাদের মতের সমর্থনে প্রমাণাদিও রয়েছে। আর পর্দা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে দলীলাদির সংখ্যাও অনেক। প্রত্যেক দল পর্দা সম্পর্কে বর্ণিত প্রমাণাদির কিছু অংশকে স্বীয় মতের সমর্থনে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং তার পরিপন্থী দলীলসমূহকে বিভিন্ন উক্তির দ্বারা খণ্ডন করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعاً فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاء حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ - سورة الأحزاب: 53
অর্থাৎ, ((নবীর স্ত্রীদের নিকট থেকে তোমাদের কিছু চেয়ে নিতে হলে পর্দার বাইরে থেকে চেয়ে পাঠাও। তোমাদের ও তাদের অন্তরের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এটা উত্তম পন্থা)) [সূরা আল-আহযাবঃ ৫৩] তিনি আরো বলেনঃ

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاء الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُوراً رَّحِيماً - سورة الأحزاب: 59
অর্থাৎ, ((হে নবী! তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও ঈমানদার লোকদের মহিলাগণকে বলে দাও, তারা যেন নিজেদের উপর নিজেদের চাদরের আঁচল ঝুলিয়ে দেয়। এটা অধিক উত্তম নিয়ম ও রীতি। যেন তাদেরকে চিনতে পারা যায় ও তাদেরকে উত্যক্ত করা না হয়। আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।)) [সূরা আল-আহযাবঃ ৫৯] তিনি আরো বলেনঃ

وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُوْلِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاء وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ - سورة النور: 31
অর্থাৎ, ((আর হে নবী, মুমিন স্ত্রীলোকদের বল, তারা যেন নিজেদের চোখকে বাঁচিয়ে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাযত করে ও নিজেদের সাজ-সজ্জা না দেখায়, কেবল সেই সব জিনিস ছাড়া যা আপনা আপনিই প্রকাশ হয়ে পড়ে। এবং নিজেদের বক্ষদেশের উপর ওড়নার আঁচল ফেলে রাখে। আর নিজেদের সাজ-সজ্জা প্রকাশ করবে না, কিন্তু কেবল এই লোকদের সামনে, তাদের স্বামী, পিতা, স্বামীদের পিতা, নিজেদের পুত্র, বোনদের পুত্র, নিজেদের মেলা-মেশার স্ত্রীলোক, নিজের দাসী, সেইসব অধীনস্থ পুরুষ যাদের অন্য কোন রকম গরয নাই, আর সেইসব বালক যারা স্ত্রীলোকদের গোপন বিষায়াদি সম্পর্কে এখনো ওয়াকফিহাল হয় নাই। আর তারা নিজেদের পা যমীনের উপর সজোরে ফেলে চলা-ফেরা করবে না এইভাবে যে, নিজেদের যে সৌন্দর্যø তারা গোপন করে রেখেছে লোকেরা তা জানতে পারে।)) [সূরা আন্‌-নূরঃ ৩১] হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

كان النساء يصلين مع رسول الله صلى الله عليه وسلم الفجر فكان إذا سلم انصرفن متلفعات بمروطهن فلا يعرفن من الغلس - سنن النسائي
অর্থাৎ, ((নারীরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ফজরের সালাতে যোগদান করতেন। অতঃপর সালাত শেষে চাদরে নিজেদেরকে আবৃত করে আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করাকালীন অনন্ধকারের জন্য তাদেরকে কেউ চিনতে পারতো না।)) [নাসায়ী] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

كان الرُّكبانُ يمرُّون بنا ونحن مع رسول اللّه صلى اللّه عليه وسلم محرماتٌ، فإِذا حاذوا بنا سدلت إحدانا جلبابها من رأسها على وجهها فإِذا جاوزنا كشفنا - السنن أبو داود: 1833
অর্থাৎ, ((আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইহ্‌রাম অবস্থায় থাকাকালীন সওয়ারীরা যখন আমাদের নিকট হয়ে অতিক্রম করত, তখন আমাদের কেউ তার চাদর মাথা থেকে মুখমণ্ডল পর্যন্ত ঝুলিয়ে নিত। অতঃপর যখন তারা চলে যেত, আমরা মুখমণ্ডল খুলে নিতাম।)) [সুনানে আবু দাউদঃ ১৮৩৩] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে আরো বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

يرحم الله نساء المهاجرات الأول، لما أنزل الله: {وليضربن بخمرهن على جيوبهن}. شققن مروطهن فاختمرن بها - صحيح البخاري: 4480-4481
অর্থাৎ, ((সর্বপ্রথম হিজরতকারীদের স্ত্রীগণের উপর আল্লাহ্‌ রহম করুন। যখন আল্লাহর এই বাণী- “এবং নিজেদের বক্ষদেশের উপর ওড়নার আঁচল ফেলে রাখে” অবতীর্ণ হয়, তখন নিজেদের চাদরকে দু’ভাগ করে একাংশকে ওড়না বানিয়ে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন।)) [বুখারীঃ ৪৪৮০-৪৪৮১]

পর্দার ব্যাপারে বর্ণিত প্রমাণাদির সংখ্যা অনেক। এ ব্যাপারে মতভেদের উল্লেখ না করেও বলা যায় যে, প্রয়োজন বোধে নারী তার মুখমণ্ডল খুলতে পারে এ ব্যাপারে সকলেই একমত। যেমন ডাক্তারের সামনে চিকিৎসার জন্য খোলা ইত্যাদি। অনুরূপ সকলে মনে করেন যে, ফিৎনার আশংকা থাকলে মুখমণ্ডল খুলে রাখা বৈধ হবে না। যারা মুখমণ্ডলকে খুলে রাখা বৈধ মনে করেন, তারা ফিৎনার আশংকাকালীন তা আবৃত রাখা ওয়াজিব বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। আর বর্তমানে যখন ফিৎনা-ফ্যাসাদ ব্যাপক রূপ ধারন করেছে, অসৎ ও ফাসেক প্রকৃতির মানুষ এত আধিক্য লাভ করেছে যে, শহর-বাজার ও সর্বত্র তা ছেয়ে গেছে এবং সৎ ও আল্লাহ্‌ভীরু লোকের হার কমে গেছে, এর থেকে ভয়াবহ ফিৎনার আশংকা আর কি হতে পারে? চরিত্র, পরিবার ও মান সম্মানকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই পরপুরুষের সাথে অবৈধ মেলা-মেশা নারীর উপর ইসলাম হারাম করে দিয়েছে। ইসলাম মানুষের হেফাযত ও ফেৎনা-ফ্যাসাদের সমস্ত পথকে বন্ধ করতে তৎপর। আর নারীর পর্দাহীনভাবে চলা-ফেরায় ও অপরিচিত লোকদের সাথে বাধাহীনভাবে মেলা-মেশায় প্রবৃত্তির তাড়না জেগে উঠে স্বাভাবিক ভাবেই, আর এতে অন্যায়ের পথ সুগম হয়ে যায় এবং অন্যায় ও অনৌচিত্য র্কমকাণ্ড অনায়াসে সংঘটিত হয়ে যায়। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেনঃ

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى - سورة الأحزاب: 33
অর্থাৎ, ((নিজেদের ঘরে অবস্থান কর এবং পূর্বতন জাহেলী যুগের সাজগোজ দেখিয়ে বেড়িও না।)) [সূরা আল-আহযাবঃ ৩৩] তিনি আরো বলেনঃ

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعاً فَاسْأَلُوهُنَّ مِن وَرَاء حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ - سورة الأحزاب: 53
অর্থাৎ, ((নবীর স্ত্রীদের নিকট থেকে তোমাদের কিছু চেয়ে নিতে হলে পর্দার বাইরে থেকে চেয়ে পাঠাও। এটা তোমাদের ও তাদের অন্তরের পবিত্রতা রক্ষার জন্য উত্তম পন্থা।)) [সূরা আল-আহযাবঃ ৫৩]

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষের অবৈধ মেলা-মেশাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি এ পথে উদ্বুদ্ধকারী সকল উপায় উপকরণকেও অবরোধ করে দিয়েছেন, যদিও তা ইবাদাতের ক্ষেত্রে ও ইবাদাতের স্থানেও হয়। কখনো কখনো নারী নিজ বাড়ী থেকে ঐ স্থানে যেতে বাধ্য হয়, যেখান পুরুষের সমাগম। যেমন, তার নিকট তার প্রয়োজন পূরণ করে দেয়ার মত কেউ না থাকাকালীন সময়ে প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য যাওয়া অথবা তার নিজের জন্য বা তার অধীনস্তদের জন্য জীবিকার কেনা-বেচাসহ অন্যান্য প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য যাওয়া; এমতাবস্থায় তার বাড়ী থেকে বের হওয়াতে কোন দোষ নেই। তবে শরীয়তের বিধি-বিধানকে খেয়াল রেখে চলা-ফেরা করতে হবে। যেমন, ইসলামী বেশভূষায় সর্বাঙ্গ ঢেকে, সৌন্দর্যের প্রকাশ না করে বের হওয়া এবং পরপুরুষদের থেকে সব সময় পৃথক থাকা ও তাদের সাথে মিশে না যাওয়া। পরিবার ও সমাজকে (অন্যায় ও অনাচার থেকে) রক্ষার জন্য ইসলাম যে সমস্ত বিধান প্রণয়ন করেছে, তন্মধ্যে অপরিচিত কোন ব্যক্তির সাথে নারীর নির্জনে অবস্থান করাকে হারাম বলে ঘোষণা দেয়া হলো অন্যতম একটি বিধান। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপরিচিত কোন ব্যক্তির সাথে নারীর নির্জনে থাকাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন যদি তার সাথে তার স্বামী বা মাহ্‌রাম (যাদের সাথে তার বিয়ে হারাম) না থাকে। কেননা, শয়তান মানুষের আত্মা ও চরিত্রকে কলংকিত করার কাজে দারুণভাবে তৎপর।
মাসিক ও নিফাস (প্রসবোত্তর রক্তপাত)-এর বিধান

মাসিকের সময় সীমা
১)) অধিকাংশ যে বয়সে মাসিক আসতে দেখা যায় তা হলো ১২ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত। তবে নারীর মাসিক এর আগে অথবা পরেও আসতে পারে, তা নির্ভর করে তার অবস্থা ও আবহাওয়ার উপর।

২)) মাসিকের অল্পাধিক্যের কোন নির্ধারিত দিন নেই।

গর্ভবতীর মাসিক

অধিকাংশ নারীরা যখন গর্ভবতী হয়, তখন তাদের ঋতু বন্ধ হয়ে যায়। তবে যদি গর্ভবতী রক্ত দেখে, আর তা যদি প্রসবের দু’দিন অথবা তিন দিন আগে হয়, আর তার সাথে প্রসব বেদনাও যদি অনুভব করে, তাহলে সেটা নিফাসের রক্ত বলে গণ্য হবে। কিন্তু যদি প্রসবের অনেক দিন অথবা অল্প দিন আগে হয়, আর বেদনা যদি না থাকে, তবে সেটা না নিফাসের রক্ত হবে আর না হায়েযের। তবে যদি অনবরত হায়েযের রক্ত আসতে থাকে, গর্ভবতী হওয়ার পরও যদি তা বন্ধ না হয়, তাহলে সেটা মাসিক বলেই গণ্য হবে।

মাসিকের ব্যতিক্রম
মাসিকের ব্যতিক্রম কয়েক প্রকারের হয়। যেমন-
১)) কম-বেশি হওয়া। অর্থাৎ, নারীর নির্ধারিত অভ্যাস হলো ছয় দিন, কিন্তু মাসিক সাত দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকছে, অথবা তার নিয়ম সাত দিন, অথচ সে ছয় দিনেই পবিত্রা হয়ে গেছে।

২)) আগে-পরে হওয়া। অর্থাৎ, নারীর নিয়ম হলো মাসের শেষে হায়েয আসা, কিন্তু মাসের শুরুতেই হায়েয আসতে দেখলো, অথবা তার নিয়ম মাসের প্রথম দিকেই হায়েয আসা, কিন্তু হায়েয মাসের শেষে আরম্ভ হলো। সে যখনই রক্ত দেখবে, তখনই সে হায়েযজনিতা বলে পরিগণিতা হবে। আর যখনই তা থেকে পবিত্রতা অর্জন করবে, তখনই পবিত্রা বলে গণ্য হবে। তাতে তার নিয়মের বেশী হোক কিংবা কম হোক, আগে হোক কিংবা পরে হোক।

৩)) মাসিকের তৃতীয় ব্যতিক্রম হলো, রক্তের রঙ হলুদবর্ণ বা ঘোলাটে হওয়া। অর্থাৎ, রক্তের রঙ দেখতে আহত স্থান থেকে নির্গত পানির ন্যায় হলুদবর্ণ, অথবা হলদে ও কালো মিশ্র্রিত ঘোলাটে, যদি এটা হায়েয চলাকালীন দিনে, অথবা হায়েযের পর পরই পবিত্র হওয়ার পূর্বেই দেখে, তাহলে তা হায়েয বলে গণ্য হবে এবং এক্ষেত্রে হায়েযের বিধান কার্যকরী হবে। কিন্তু যদি পবিত্রতা অর্জনের পর দেখে, তাহলে তা হায়েয বলে গণ্য হবে না।

৪)) কেটে কেটে রক্ত আসা। যেমন, একদিনে রক্ত দেখে আর একদিনে পরিষ্কার ইত্যাদি। এর দু’টি অবস্থা। যথা-
(ক) যদি এটা মহিলার সাথে সব সময় ঘটে থাকে, তাহলে ইস্তিহাযার রক্ত বলে পরিগণিত হবে এবং এতে ইস্তিহাযার বিধান বাস্তবায়িত হবে।

(খ) যদি এটা সব সময় মহিলার সাথে না ঘটে; বরং কখনো কখনো ঘটে এবং এরপর সে সঠিক পবিত্রাবস্থা পায়। তবে একদিনের কমে যদি রক্ত বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পবিত্রা বলে গণ্য হবে না। হাঁ, এমন কোন জিনিস যদি দেখে যা পবিত্রতাকে প্রমাণ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। যেমন, যদি তার নিয়মের ঠিক শেষের দিকে রক্ত বন্ধ হয়, অথবা সে যদি ‘কাস্‌সাতুল বায়দ্বা’ দেখে। আর ‘কাস্‌সাতুল বায়দ্বা’ হলো, সাদা পানি যা হায়েয বন্ধ হওয়ার পর রেহেম থেকে নির্গত হয়।

৫)) শুকনো ধরনের রক্ত আসা। অর্থাৎ, ঠিক রক্ত নয় রক্তের দাগ বা চিহ্ন দেখে। এটা যদি হায়েয আসার দিনে, অথবা হায়েয বন্ধ হওয়ার পরপরই পবিত্র হওয়ার পূর্বেই দেখে, তাহলে হায়েয বলে গণ্য হবে। আর যদি পবিত্র হওয়ার পর দেখে, তাহলে তা হায়েয হবে না।

মাসিকের বিধান
প্রথমতঃ সালাত। হায়েযজনিতা মহিলার উপর ফরয ও নফল প্রত্যেক সালাতই হারাম। কোন সালাতই আদায় করা ঠিক হবে না। অনুরূপ সালাতগুলির কাযা ও তার উপর ওয়াজিব হবে না। তবে যদি হায়েয আরম্ভ হওয়ার পূর্বে অথবা শেষ হওয়ার পর এতটা সময় পায়, যাতে পূর্ণ এক রাকা‘আত সালাত আদায় করা সম্ভব, তাহলে সেটা তার উপর ওয়াজিব হবে। যেমন, একটি মহিলার সূর্যাস্তের এতটা সময় পর হায়েয আরম্ভ হলো যে, এক রাকাআত সালাত পড়া যেত, এমতাবস্থায় পবিত্রতা অর্জনের পর তাকে মাগরিবের সালাত কাযা করতে হবে। কারণ, সে হায়েযজনিতা হওয়ার পূর্বে এক রাকা‘আত সালাত আদায় করার মত সময় পেয়েছিল। অনুরূপ একটি মহিলা সূর্যোদয়ের এতটা সময় পূর্বে হায়েয থেকে পবিত্রা হলো যে, এক রাকা‘আত সালাত আদায় করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল, এমতাবস্থায় পবিত্রতা অর্জনের পর ফজরের সালাত তাকে কাযা করতে হবে। কারণ, হায়েযের পূর্বে এতটা সময় তার হাতে ছিল, যা এক রাকা‘আত সালাত আদায় করার জন্য যথেষ্ট ছিল। হাঁ, যিকির, তাকবীর, ‘সোবহানাল্লাহ্‌’, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌’ পাঠ করা, খাবার ইত্যাদির সময় ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বলা, ফেকাহ্‌ ও হাদীস পাঠ করা, দো‘আ করা ও দো‘আয় ‘আমীন’ বলা এবং কুরআন শোনা ইত্যাদি কোন কিছুই হায়েযজনিতা মহিলার উপর হারাম নয়। স্বয়ং তার কুরআন পড়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, যদি চোখে দেখে, অথবা মনে মনে পড়ে উচ্চারণ না করে, তাহলে কোন দোষ নেই। যেমন, কুরআন অথবা রেহেল সামনে রেখে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে মনে মনে পড়া। তবে এ অবস্থায় তার কুরআন পাঠ না করাই উত্তম। হাঁ, একান্ত প্রয়োজনে পাঠ করতে পারবে। যেমন, সে শিক্ষিকা, ছাত্রীদের অধ্যয়ন করাতে হয়, অথবা পরীক্ষার সময় পরীক্ষার জন্য পড়ার প্রয়োজন বোধ করে ইত্যাদি।

দ্বিতীয়তঃ সওম। হায়েযজনিতা নারীর উপর ফরয ও নফল সব সওমই হারাম। কোন সওম পালন করা তার পক্ষে ঠিক নয়। তবে ফরয সওমের কাযা তার উপর ওয়াজিব। সওম পালন অবস্থায় যদি তার হায়েয আরম্ভ হয়ে যায়, তাহলে তার সওম বাতিল গণ্য হবে যদিও তা সূর্যাস্তের সামান্য পূর্বে হয়। এদিনের সওমের কাযা করা তার উপর ওয়াজিব, যদি সেটা ফরয সওম হয়। হাঁ, যদি সে সূর্যাস্তের পূর্বে হায়েয অনুভব করে কিন্তু তা নির্গত হয় সূর্যাস্তের পর, তাহলে তার সওম সঠিক বলে গণ্য হবে। যদি হায়েয অবস্থায় ফজর হয়ে যায়, তাহলে এ দিনের সওম শুদ্ধ হবে না, যদিও সে ফজরের সামান্য পরই পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আর যদি ফজরের পূর্বেই পবিত্র হয়ে যায়, তাহলে তার সওম সঠিক বলে গণ্য হবে, যদিও সে ফজরের পরে গোসল করে থাকে।

তৃতীয়তঃ কা‘বা শরীফের তাওয়াফ করা। ফরয ও নফল সব রকমের তাওয়াফই তার উপর হারাম। কোন তাওয়াফই করা ঠিক হবে না। তাওয়াফ ব্যতীত অন্যান্য কাজ যেমন, সাফা-মারওয়ার সা‘ঈ করা, আরাফায় অবস্থান, মুজদালিফা ও মিনায় রাত্রিবাস এবং জামারাসমূহে কংকর মারা ইত্যাদি সহ হজ্জ ও উমরাহর যাবতীয় কাজ সে করতে পারবে। কোন কিছুই তার উপর হারাম নয়। সুতরাং কোন মহিলা যদি পবিত্রাবস্থায় তাওয়াফ আরম্ভ করে, অতঃপর যদি তাওয়াফের পর পরই কিংবা সা‘ঈ করার সময় হায়েয নির্গত হয় তাহলে এতে কোন দোষ নেই।

চতুর্থতঃ
মসজিদে অবস্থান করা। মসজিদে অবস্থান করা তার উপর হারাম। পঞ্চমতঃ সঙ্গম করা। তার সাথে যৌন বাসনা চরিতার্থ করা তার স্বামীর উপর হারাম এবং স্বামীকে এ সুযোগ দেয়াও তার উপর হারাম। তবে আল্লাহরই প্রশংসা যে, সঙ্গম ব্যতীত চুমা ও লজ্জাস্থান ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গের সংস্পর্শের মাধ্যমে প্রবৃত্তি নিবারণের অনুমতি রয়েছে।

ষষ্ঠতঃ
তালাক। হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেয়া স্বামীর উপর হারাম। যদি সে হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়, তাহলে সে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্যকারী এবং হারাম কাজ সম্পাদনকারী বিবেচিত হবে। এমতাবস্থায় তালাক প্রত্যাহার করা ও পবিত্রা না হওয়া পর্যন্ত তাকে নিজের কাছে রাখা তার উপর ওয়াজিব। অতঃপর পবিত্রা হয়ে গেলে ইচ্ছা করলে তাকে তালাক দিতে পারবে। তবে উত্তম হলো দ্বিতীয় হায়েয পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেয়া। দ্বিতীয় হায়েয থেকে পবিত্রা হয়ে যাওয়ার পর ইচ্ছা হলে রাখতেও পারে, আবার তালাক দিতেও পারে।

সপ্তমতঃ
গোসল ওয়াজিব হওয়া। হায়েয সমাপ্তির পর সর্বাঙ্গ শরীরকে ধুয়ে পবিত্রতা অর্জন করা তার উপর ওয়াজিব। মাথার বেণী খোলা অপরিহার্য নয়, কিন্তু যদি এমন শক্ত করে বাঁধা থাকে, যাতে আশংকা বোধ করে যে, চুলের গোড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছাবে না, তাহলে তা খুলতে হবে। যদি সালাতের সময়ের মধ্যে পবিত্রা হয়ে যায়, তাহলে তড়িঘড়ি গোসল করা অপরিহার্য হবে যাতে সঠিক সময়ে সালাতটা আদায় করতে সক্ষম হয়। যদি সে সফরে থাকে আর কাছে পানি না থাকে, অথবা পানি আছে কিন্তু তার ব্যবহারে ক্ষতির আশংকা থাকে, তাহলে সে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করবে। অতঃপর আশংকা দূরীভূত হয়ে গেলে গোসল করে নেবে।

ইস্তিহাযাহ
ইস্তিহাযা হলো, হায়েযের পর ও রক্ত প্রবাহ অব্যাহত থাকা, বন্ধ না হওয়া, অথবা সাময়িকের জন্য বন্ধ হওয়া। কেউ কেউ বলে ১৫ দিনের বেশী রক্ত আসাকে ইস্তিহাযা বলে যদি সেটা তার নিয়ম না হয়।ইস্তিহাযার তিনটি অবস্থা। যেমন-

১)) ইস্তিহাযার পূর্বে তার হায়েযের একটি নির্দিষ্ট সময় ছিল, এমতাবস্থায় সে তার সাবেক নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে সেই দিনগুলিই হায়েযের দিন গণ্য করবে ও হায়েযের বিধান এতেই কার্যকরী হবে, বাকী অন্য দিনগুলি ইস্তিহাযা বলে বিবেচিত হবে এবং ইস্তিহাযা বিধান তাতে পালনীয় হবে। এর উদাহরণ হলো, একটি মহিলার প্রত্যেক মাসের শুরুতেই ছয় দিন রক্ত আসতো, অতঃপর সে ইস্তিহাযায় পতিত হওয়ায় রক্ত প্রবাহ অব্যাহত থাকতে লাগল, এমতাবস্থায় মাসের ছয় দিনই তার হায়েয বলে গণ্য হবে আর বাকীগুলি ইস্তিহাযা। তাই সে নির্দিষ্ট দিনগুলোকেই হায়েয গণ্য করবে। তারপর গোসল করবে ও সালাত আদায় করবে। ছয় দিনের অতিরিক্ত রক্তের কোন পরওয়া করবে না।

২)) ইস্তিহাযার পূর্বে তার হায়েযের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। অর্থাৎ, যখন থেকে সে রক্ত দেখেছে, তখন থেকেই তার এই অবস্থা, এমতাবস্থায় যে ক’টা দিন রক্তের রঙ কালো অথবা গাঢ় হবে, অথবা এমন গন্ধ যা হায়েয প্রমাণ করে, সেই দিন ক’টিই হায়েয বলে গণ্য হবে। বাকী দিনগুলি ইস্তিহাযা হিসেবে পরিগণিত হবে এবং তাতে ইস্তিহাযার বিধান আরোপিত হবে। এর উদাহরণ হলো, একটি মহিলা প্রথম যে দিন থেকে রক্ত দেখে সেদিন থেকেই রক্ত বন্ধ হয় না। কিন্তু কিছু পার্থক্য সে দেখেছে, যেমন- দশদিন রক্তের রঙ দেখেছে গাঢ়, বাকী দিনগুলি পাতলা, অথবা দশদিন রক্তের গন্ধ হায়েযের মত ছিল, বাকী দিনগুলিতে কোন গন্ধ ছিল না, তাই যে দিনগুলিতে রক্তের রঙ কালো ও গাঢ় ছিল এবং হায়েযের গন্ধ ছিল, সেই দিনগুলিই হায়েয বলে গণ্য হবে, বাকীগুলি ইস্তিহাযা।

৩)) তার হায়েযের কোন নির্দিষ্ট সময় ও সঠিক পার্থক্য নেই। যেমন, প্রথম যখন থেকে সে রক্ত দেখেছে, তখন থেকেই তার ইস্তিহাযার রক্ত অব্যাহত আছে। আর রক্তের রঙ এক রকম, অথবা এমন বিভিন্ন ধরনের জটিল রক্তের স্বরূপ যাকে হায়েয বলা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় সে অধিকাংশ নারীর নিয়মানুযায়ী কাজ করবে। তাই প্রত্যেক মাসে যখন থেকে সে হায়েয দেখবে, তখন থেকে ছয়দিন বা সাতদিন হায়েয গণ্য হবে, বাকী ইস্তিহাযা।

ইস্তিহাযার বিধান
ইস্তিহাযার বিধান পবিত্রতার বিধানের মতই, তেমন কোন পার্থক্য নেই। তবে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। তা হলো-
১)) প্রত্যেক সালাতের সময় তাকে ওযু করতে হবে।
২)) যখন সে ওযুর ইচ্ছা করবে, রক্তের দাগ ধুয়ে নেবে এবং রক্তের শোষণ করার জন্য লজ্জাস্থানে কোন সুতির কাপড়ের টুকরা রেখে নেবে।

নিফাসের বিধান
সন্তানাদির ভূমিষ্ঠের সময়, অথবা তার দু’দিন বা তিনদিন আগে-পিছে বেদনাজড়িত যে রক্ত রেহেম থেকে বের হয়, তাকেই নিফাসের রক্ত বলে। আর যখনই এই রক্ত বন্ধ হয়ে যায়, তখনই পবিত্রা বলে গণ্য হয়। তবে যদি ৪০ দিন অতিক্রম করে, তাহলে সে গোসল করে নেবে, যদিও রক্ত প্রবাহ অব্যাহত থাকে। কারণ, ৪০ দিনই হলো নিফাসের সর্বশেষ সময়। তবে ৪০ দিনের পর প্রবাহমান রক্ত যদি মাসিকের রক্ত হয়, তাহলে পবিত্রা না হওয়া পর্যন্ত মাসিকের নিয়ম পালন করবে। তারপর গোসল করবে। আর নিফাস তখনই প্রমাণিত হবে, যখন সৃষ্টির মধ্যে মানব আকৃতির প্রকাশ পাবে। কিন্তু যদি ছোট অসম্পূর্ণ ভ্রূণ হয়, মানবাকৃতির প্রকাশ যদি না থাকে, তাহলে তার রক্ত নিফাসের রক্ত বলে গণ্য হবে না; বরং তা কোন রগের রক্ত বলে গণ্য হবে এবং এমতাবস্থায় ইস্তিহাযার বিধান তাতে কার্যকরী হবে। মানবাকৃতি প্রকাশ হওয়ার সর্ব নিম্ন সময় হলো গর্ভধারন আরম্ভ থেকে ৮০ দিন। আর সর্বোচ্চ হলো ৯০ দিন। আর নিফাসের বিধান হলো উল্লেখিত মাসিকের বিধানের মত।

মাসিক প্রতিরোধক
মাসিক প্রতিরোধক কোন জিনিস নারী ব্যবহার করতে পারে দু’টি শর্তের ভিত্তিতে। যেমন-
১)) তার ব্যবহারে কোন ক্ষতির আশংকা যেন না থাকে, ক্ষতির আশংকা থাকলে তা জায়েয হবে না।
২)) এটা স্বামীর অনুমতিতে হতে হবে যদি তা স্বামীর সম্পর্কিত কোন বিষয় হয়।মাসিক নিয়ে আসে এমন কোন জিনিসও ব্যবহার করতে পারে দু’টি শর্তের ভিত্তিতে। যেমন-
১)) স্বামীর অনুমতি।
২)) কোন পালনীয় ওয়াজিব থেকে রক্ষার বাহানায় যেন এ কাজ না করা হয়। যেমন, সিয়াম পালন করা ও সালাত আদায় করা ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা।
গর্ভধারণ প্রতিরোধক ব্যবহার করা দু’প্রকারের-
(এক) সব সময়ের জন্য প্রতিরোধ করা এটা জায়েয নয়।
(দুই) সাময়িকের জন্য প্রতিরোধ করা। যেমন, নারী যদি অত্যাধিক প্রসবকারিণী হয়, আর প্রসব তাকে দুর্বল করে দেয়, তাহলে দু’বছর অন্তর একবার প্রসব হওয়ার ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা ভাল। আর এটা জায়েয তবে স্বামীর অনুমতি থাকতে হবে এবং নারীর যেন কোন ক্ষতির আশংকা না থাকে।

সমাপ্ত
বিঃ দ্রঃ কিতাবটা ছাপাবার অধিকার তাকে দেয়া হলো, যে বিনামূল্যে বন্টন করতে ইচ্ছুক। আর যে বিক্রয় করার জন্য ছাপাতে চায়, তাকে অফিসের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

ঠিকানাঃ মক্তব তাও‘ইয়াতুল জালিয়াত, আল-জুলফী।
পোষ্ট ব ১৮২, আল-জুলফী ১১৯৩২, সৌদি আরব।
ফোনঃ +৯৬৬ ০৬ ৪২২ ৫৬৫৭, ফ্যাক্সঃ +৯৬৬ ০৬ ৪২২ ৪২৩৪



ফটো গ্যালারী

1/6
ওহুদ যুদ্ধ - হযরত মহাম্মদ (সা:) এর বিপ্লবী জীবন
2/6
মুসলিম নারীর বিধান
3/6
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা
4 / 6
ইসলামীক জিজ্ঞাসাঃ লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
5/6
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
6/6
উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব

Islam-icon Profile.png