LIVE
Loading latest headlines...

শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

কিয়ামতের আলামত

শনিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে


ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আকাশ-যমিনের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর জন্যে যিনি জীবন-মরণের একমাত্র মালিক। তিনি সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করার জন্যে এবং সীমা লংঘণকারীদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্যে সমস্ত মাখলুকের মৃত্যু ও পুনরুত্থান  অবধারিত করেছেন। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর বংশধর ও সৎকর্মশীল সাথীদের উপর।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা এ পৃথিবীতে আগমণ করেছি। তাঁর ইচ্ছাতেই আমরা আবার এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। একদল আসছে। অন্য দল বিদায় নিচ্ছে। মানব জাতির এ আগমণ-প্রস্থানকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তুলনা করা চলে। এক ঝাঁক ঢেউ সমুদ্র সৈকতে এসে শেষ হয়ে যায়। তার পিছ ধরেই অন্য এক ঝাঁক ঢেউ আগমণ করে তীরে এসে শেষ হয়। চলমান নদীর সাথে মানুষের চলার গতির যথেষ্ট মিল রয়েছে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আপনি এখন যে পানি অবলোকন করছেন সেটি একটু আগে বয়ে যাওয়া পানি নয়। অথচ নদী সেটিই। এমনিভাবে বর্তমান পৃথিবীতে আপনি যাদের সাথে বাস করছেন তাদের কেউ পাঁচ শত বছর পূর্বের মানুষ নয়। তারা এ পৃথিবীতে আপনার মতই বসবাস করেছিল। তারা চলে যাওয়ার পর আপনি এখন তাদের স্থান দখল করে বসেছেন। আপনিও চলে যাবেন। আপনার স্থানে অন্যরা আসবে।
মানব জাতির চলার এ গতি একদিন থেমে যাবে। সেদিন পৃথিবীতে বসবাসরত সকল মানুষ একসাথেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। রাতের তারকাগুলো নিভে যাবে। সাগরের ঢেউ থেমে যাবে। নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যাবে। এখানেই শেষ নয়; বরং এটি মানব জাতির একস্থান থেকে অন্য স্থানে গমণ মাত্র। অচিরেই এমন একদিন আসবে যেদিন আমরা সবাই নতুন এক জগতে ফেরত যাব। সেখানে আমাদের সকল কাজের হিসাব নেয়া হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
)وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ(
“আর তোমরা সেই দিনকে ভয় কর যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে। তখন যে যা অর্জন করেছে তা সম্পূর্ণরূপে প্রদত্ত হবে। আর তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবেনা”। (সূরা বাকারাঃ ২৮১)
এই দিনকে কুরআনের ভাষায় বিভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথায়ও আখেরাত দিবস, কোথায় বিচার দিবস, কোথায়ও মহান দিবস, মহাপ্রলয় ইত্যাদি। কুরআন মাযীদের এমন কোন পাতা খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে পরকালের অর্থাৎ কিয়ামত দিবসের কথা আলোচিত হয়নি। কারণ কিয়ামত দিবস এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং আখেরাতের শাস্তি কিংবা নেয়া’মতের উপর বিশ্বাসই মানুষকে সকল প্রকার কল্যাণের পথে নিয়ে যায় এবং সকল অন্যায় পথ হতে বিরত রাখে। এজন্যই পবিত্র কুরআনে বারবার কিয়ামত দিবসের কথা আলোচনা করা হয়েছে। মানুষের চরিত্র সংশোধনের জন্যে এবং তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্যে পরকালের প্রতি ঈমানের যে প্রভাব রয়েছে, মানব রচিত কোন বিধানেই তা খোঁজে পাওয়া যাবেনা। এজন্যেই যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং যে ব্যক্তি তাতে বিশ্বাস করেনা তাদের উভয়ের চরিত্রে আকাশ-পাতাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
কিয়ামতের আলামতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আখেরাতের উপর ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কুরআন ও সুন্নাহর অনেক স্থানে আল্লাহর উপর ঈমান আনার পরেই আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়নের কথা বলা হয়েছে এবং কিয়ামতের আলামতগুলোও বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখিত হয়েছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে কিয়ামতের ছোট-বড় সকল আলামত মুখস্থ করিয়েছেন। সাহাবীগণ তা শিখেছেন এবং তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
 ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকেই আলেমগণ এ বিষয়ে অনেক কিতাব রচনা করেছেন। অথচ বাংলা ভাষায় কিয়ামতের আলামত বিষয়ে কোন নির্ভরযোগ্য কিতাব আছে বলে আমার জানা নেই। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে এ বিষয়ে কিছু লিখার কাজে হাত দিলাম। বইটি পড়ে কিয়ামত দিবসের প্রতি মুসলিম ভাই-বোনদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে এবং মজবুত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এই ছোট খেদমতটুকু তাঁর সন্তুষ্টির  জন্যে কবূল করেন এবং বইটির রচনা ও প্রকাশে যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করেন।

          

নিবেদক
আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী






সত্যবাদিতা অবলম্বন ও মিথ্যা পরিত্যাগ

শনিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
পাঠ সংক্ষেপ
খুতবার উদ্দেশ্য :
১-মুসলিম উম্মার আচার-আচরণে সততা ও সত্যবাদিতার প্রতিষ্ঠা, ২-মিথ্যা থেকে হুঁশিয়ার করা,
৩-মানুষের মাঝে আস্থা বীজবপন করা

الْحَمْدُ لِلَّهِ نَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا، مِنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، أَرْسَلَهُبِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ، مَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ رَشَدَ، وَمَنْ يَعْصِهِمَا فَإِنَّهُ لَا يَضُرُّ إِلَّا نَفْسَهُ وَلَا يَضُرُّ اللهَ شَيْئًا، اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِهِوَأَصْحَابِهِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيِنِ، أَمَّا بَعْدُ :

মুহতারাম মুসল্লীবৃন্দ! সত্য কথা বলা ও সৎভাবে জীবনযাপন করা মহৎ মানুষের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য। মিথ্যা কথা বলা ও অসৎ জীবন যাপন করা অসৎমানুষের লক্ষণ। সত্যবাদিতা হলো ঈমানের পূর্ণতাদানকারী একটি মহৎ গুণ। ইসলামের দাবি হলো সততানির্ভর জীবন, যে জীবনে থাকে না কোনোঅসত্যের চিহ্ন। সত্যবাদিতা নির্ভেজাল ও নির্মল ঈমানের জন্ম দেয় এবং সত্যবাদী ব্যক্তিরাই প্রকৃত অর্থে দুনিয়া-আখিরাতে সফলকাম হয়ে থাকে।সত্যবাদী-সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তিরাই আল্লাহর ওপর যথোপযুক্ত তাওয়াক্কুল ও ভরসা রাখে; দুর্যোগ ও দুর্ভোগের সময় ধৈর্যের পরিচয় দেয়; স্বচ্ছলতার সময়ঐকান্তিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। সত্যবাদীরাই কল্যাণকর কাজে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং অকল্যাণকর কাজে তারা হয়প্রতিবাদী-বিদ্রোহী। এ সব কারণেই আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতি ও সত্যবাদী লোকদের সংস্রব অবলম্বন করার জোর নির্দেশদিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে : يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (সূরাআত-তাওবা  : ১১৯)।

সাদেকীন অর্থ যারা বোধ ও বিশ্বাসে সত্যবাদী, কাজে-কর্মে সত্যবাদী এবং লেনদেন, বেচাকেনাসহ সকল ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী। মুসলিম উম্মাহর সকলসদস্যের জন্য এটা আবশ্যক যে তারা জীবন চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যকে ফুটিয়ে তুলবে। সত্যের চর্চা ও অনুশীলকে সার্বক্ষণিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে।সত্যবাদিতা ধরে রাখতে গিয়ে যদি আর্থিক ক্ষতিও সহ্য করতে হয় তবু তারা সত্যকে ধরে রাখবে। আর এভাবেই তরা সক্ষম হবে আল্লাহর পক্ষ হতেঅফুরান  বরকত লাভের। যেমন হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا، أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا، فَإِنْ صَدَقَاوَبَيَّنَا، بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا، مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا ‘ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই (ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া নাকচ করার) ইখতিয়ার রাখে যতক্ষণ না তারাপরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা যদি সত্য বলে এবং ক্রটি-বিচ্যুতি বলে দেয়, তাহলে উভয়ের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দেয়া হয়। আর যদি তারা মিথ্যাবলে এবং পণ্যের দোষ লুকিয়ে রাখে তাহলে তাদের বেচাকেনার বরকত ধ্বংস করে দেয়া হয়’ (মুসলিম)।

সততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। সত্যবাদী ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন। ইরশাদহয়েছে : هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا‘ আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকার করবে।তাদের জন্য জান্নাতে রয়েছে; যার তলদেশে প্রবাহিত হবে নদী। তারা তাতেই থাকবে চিরকাল’ (সূরা আল মায়েদা : ১১৯)।

অর্থাৎ পার্থিব জগতে তাদের সততা পারলৌকিক জীবনে উপকারী হবে। বিচার দিবসে আল্লাহর ভয়াবহ শাস্তি থেকে সত্যবাদিতাই তাদেরকে বাঁচিয়ে দেবে।ইরশাদ হয়েছে :وَبَشِّرِ الَّذِينَ آَمَنُوا أَنَّ لَهُمْ قَدَمَ صِدْقٍ عِنْدَ رَبِّهِمْ‘এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর যে, তাদের রবের নিকট তাদের জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা’ (ইউনুস : ২)।

যারা সত্যকে ধারণ করে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নেয় তাদেরকে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে: وَالَّذِي جَاءَبِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ‘আর যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং যে তা সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই হলো মুত্তাকী’ (যুমার : ৩৩)।

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, শুধু নিজে নিজে সত্যবাদী হলেই চলবে না বরং যারা সত্যবাদী তাদেরকে সত্যবাদী বলে সত্যায়ন করাও জরুরী। কারণঅনেকেই অহংকারবশত বা হিংসার বশবর্তী হয়ে সত্যবাদীকে সত্যায়ন করতে অস্বীকার করে।

সত্যবাদিতা এমন মহৎ গুণ যে আল্লাহ তাআলা নিজেই এ গুণে গুণান্বিত বলে উলে¬খ করেছেন। সত্যবাদিতা হলো আল্লাহর গুণ। ইরশাদ হয়েছে : قُلْصَدَقَ اللَّهُ ‘বল, ‘আল্লাহ সত্য বলেছেন’(আল ইমরান: ৯৫)।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :  وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا ‘আর কথায় আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী কে’? (নিসা : ৮৭)।

আমাদের একটি ভুল ধারণা এই যে সত্যবাদিতা শুধু কথার জগতে সীমিত। পক্ষান্তরে সত্যবাদিতার ক্ষেত্র সুদূরবিস্তৃত। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, সত্যবাদিতা মৌলিকভাবে তিন প্রকার-

এক. কথার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা। অথাৎ মানুষের জিহ্বা সত্যবাদিতা শেকড়ে সুদৃঢ়ভাবে স্থির থাকবে যেভাবে স্থির থাকে ধানের শীষ ধান গাছে।

দুই. কর্মের ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা : অর্থাৎ ব্যক্তির আমল ও কর্ম স্থির থাকবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এঁকে দেয়া সীমানার ভেতর যেমন স্থির থাকে মাথাশরীরের ওপরের অংশে।

তিন. সার্বিক অবস্থার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা। অর্থাৎ অন্তরের আমল ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল ইখলাসের ভিত্তিমূলে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এই তিনপ্রকারের সত্যবাদিতায় নিজকে দাঁড় করাতে পারলেই বলা সঙ্গত হবে যে কোনো ব্যক্তি সিদ্ক বা সততা-সত্যবাদিতা নিয়ে এসেছে বা সত্যবাদিতার গুণেযথার্থভাবে গুণান্বিত হয়েছে। আর এই তিন প্রকারের সত্যবাদিতায় ব্যক্তি যতই অগ্রসর হবে তার সিদ্দীকিয়াতের মাত্রাও ততো বেড়ে যাবে। আবু বকরসিদ্দীক রাযি. এর সিদ্দীকিয়াতের সর্বোচ্চ শেখরে অধিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে এই তিন প্রকারের সত্যবাদিতায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের উৎকর্ষ সাধনই কারণ ছিল।এ তিন প্রকারের সত্যবাদিতার সারমর্ম হলো নিম্নরূপ-

কথার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতার অর্থ- সকল প্রকার মিথ্যা থেকে নিজের যবানকে হিফাযত করা। সদাসর্বাদ সত্য বলা এবং এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতাঅবলম্বন করা; কেননা মানুষ জিহ্বাকে ব্যবহার করে কি কি কথা বলেছে তা কিয়ামতের দিন আল¬াহ তাআলা স্বয়ং জিহ্বাকেই জিজ্ঞাসা করবেন।ইরশাদ হয়েছে : يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘যেদিন তাদের জিহ্বাগুলো, তাদের হাতগুলো ও তাদের পাগুলো তারা যা করত,সে ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে (সূরা আন-নূর : ২৪)।

কর্মে সত্যবাদিতা হলো ব্যক্তির অন্তর ও বহির একরকম হওয়া। ভেতরে একরকম বাইরে অন্যরকম এরূপ না হওয়া। আবদুল ওয়াহেদ ইবনে যায়েদ আলবসরী, হাসান আল বসরী রহ. সম্পর্কে বলেন, হাসান আল বসরী যখন কোনো কাজের নির্দেশ দিতেন তিনি অন্যদের তুলনায় সে কাজে অধিক আমলকারীথাকতেন। আর যদি তিনি কোনো বিষয় থেকে কাউকে বারণ করতেন তবে তিনি অন্যদের তুলনায় সে বিষয়ে অধিক দূরত্বে অবস্থান করতেন। অন্তর ওবহির সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে হাসান আল বসরীর মতো অন্য কোনো মানুষকে আমি দেখিনি’।

সার্বিক অবস্থার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের সত্যবাদিতা। যেমন ইখলাস ও ভয়, তাওবা ও আশা, যুহদ, আল্লাহ ও তার রাসূলের মহব্বত,আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ইত্যাদির ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা। এ কারণে ‘আ‘মালুল কুলূব’ বা অন্তরাশ্রিত সকল আমলের মূল হলো সত্যবাদিতা। মুমিন যখনএসব অবস্থায় সত্যবাদী হয় তখন সে উঁচু পর্যায়ে চলে যায়। আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা বেড়ে যায়। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّواوُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِيالرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي  الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ  ‘ ভালো কাজ এটা নয়যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ  হলো যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ওনবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতেএবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদীএবং তারাই মুত্তাকী’ (সূরা আল বাকারা:১৭৭)।

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ

দ্বিতীয় খুৎবা

الْحْمْدُ لِلَّهِ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ السَّلَامِ، رَفَعَ مَنَارَ الْإِسْلَامِ، وَعَمَّ خَلْقَهُ بِالنِّعَمِ الْعِظَامِ، أَحْمَدُ رَبِّيْ وَأَشْكُرُهُ، وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ وَأَسْتَغْفِرُهُ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَاشَرِيْكَ لَهُ ذُوْ الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ، وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا وَسَيِّدَنَا مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلَى عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِأَجْمَعِيْنَ ، أَمَّا بَعْدُ: فَاتَّقُوا اللهَ تَعَالَى وَأَطِيْعُوْهُ، وَتَقَرَّبُوْا إِلَيْهِ بِمَا يُرْضِيْهِ.

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! ইসলাম সত্যবাদিতা ও সত্যবাদীদের সম্মান করে, মর্যাদা দেয়। আর যারা মিথ্যাবাদী তাদেরকে ঘৃণা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠিনঅবস্থান নেয়। মিথ্যা ভয়ঙ্কর খিয়ানতের আলামত; নিফাক ও কপটতার আলামত। হাদীসে এসেছে : آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ، إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ  أَخْلَفَ،وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি- সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, তার কাছে কিছু আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে’ (বুখারী)। বরং মিথ্যা ইসলামের সাথে কখনো মিলে না, মিলতে পারে না। মুসলমানের প্রকৃতিতে কখনো মিথ্যাচারিতা থাকতে পারে না। খেয়ানত করারপ্রবণতা থাকতে পারে না। ঈমান ও পৌরুষত্ব যতক্ষণ জীবিত থাকে, যতক্ষণ একজন ব্যক্তি দীনের ব্যাপারে, নিজের ইজ্জত-সম্মানের ব্যাপারে সজাগথাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মিথ্যার কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সে যেতে পারে না।

মুহতারাম মুসল্লীবৃন্দ! দুঃখের বিষয় হলো আমরা যদি আজ মুসলমানদের অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখি, তা হলে এ ব্যাপারে চরম উদাসিনতা লক্ষ্য করতেপাই। এর কারণ অধিকাংশ মুসলমানের ঈমানী দুর্বলতা যা উত্তর-আধুনিকতার বর্তমান সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আজ মুসলমানদের মধ্যেপাপ-গুনাহ ছড়িয়ে পড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। মানুষের জীবনে দুনিয়া-প্রীতি বেড়ে গিয়েছে মারাত্মক আকারে। যার কারণে মানুষের কথার জগৎ থেকেসত্যবাদিতা বিদায় হয়েছে। কাজের জগৎ থেকে সত্যবাদিতা বিদায় হয়েছে। যার কারণে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে যার প্রতি শতভাগ আস্থারাখা সম্ভব। কেননা সত্যবাদিতাই হলো আস্থার কারণ। হাদীসে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : فَإِنَّ الصِّدْقَ طُمَأْنِينَةٌ، وَإِنَّالْكَذِبَ رِيبَةٌ ‘নিশ্চয় সত্যবাদিতা হলো আস্থার কারণ, আর মিথ্যাবাদিতা হলো সংশয় সন্দেহের কারণ’ (তিরমিযী)।

বর্তমানে প্রচলিত মিথ্যার আকার প্রকৃতি

এক. ছোট বাচ্চাদের সাথে মাতা-পিতার মিথ্যাচারিতা। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো বাচ্চাদেরকে সত্যবাদিতার পবিত্র বলয়ে মানুষ করা। সকল প্রকারমিথ্যা থেকে তাদেরকে দূরে রাখা; যাতে বাচ্চারা কথায় ও কাজে সত্যাশ্রিত হয়ে, স্পষ্টবাদী হয়ে, নির্ভীক হয়ে বড় হয়ে ওঠে। আবদুল্লাহ ইবনে আমেররাযি. বর্ণনা করেন, ‘আমার মা আমাকে একদিন ডাকলেন। আমি তখন ছোট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন আমাদের মাঝে বসা। মাআমাকে বললেন,‘এসো, আমি তোমাকে একটি জিনিস দেব। তখন রাসূলুল্লাহ   সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন,‘তুমি ওকে কি দিতেচেয়েছ’? মা বললেন, ‘আমি ওকে খেজুর দিতে চেয়েছি’। তিনি বললেন,‘তুমি যদি ওকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমল-নামায় একটি মিথ্যা লিখাহত’। আবু হুরাইরা রাযি. বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : : مَنْ قَالَ لِصَبِيٍّ: تَعَالَ هَاكَ ثُمَّ لَمْ يُعْطِهِ، فَهِيَ كِذْبَةٌ  ‘যেব্যক্তি তার বাচ্চাকে বলল, এসো, নাও। এরপর সে তাকে কিছু দিল না, তবে তা হবে মিথ্যা’ (আহমদ, হাসান)।

 আমাদের উচিত এই পূত-পবিত্র নববী আদর্শের ওপর বাচ্ছাদেরকে মানুষ করা। ইসলামী ভাবধারা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী বাচ্চাদেরকে গড়ে তোলা।

দুই. কথায় ও কাজে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া। এরূপ করা নিঃসন্দেহে কবীরা গুনাহ, বড় অন্যায়। শুধু তাই নয় বরং এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর অভিসম্পাদেরউপযোগী। ইরশাদ হয়েছে :فَنَجْعَلْ لَعْنَةَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ ‘মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লা’নত করি’ (সূরা আলে ইমরান:৬১)।

আনাস রাযি. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ، إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَأَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি; কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে খেলাফ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে’(বুখারী ওমুসলিম)।

তিন : ওয়াদা-খলাপি প্রসার পাওয়া। উপরোল্লিখিত হাদীসে ওয়াদা-খেলাপির কথা বলা হয়েছে। আর এ ওয়াদা-খেলাপি বর্তমানে প্রকাশ্য একটি ঘটনায়পরিণত হয়েছে। এমনকি এমন অনেকেই রয়েছেন যারা ওয়াদা-খেলাপিতে খুবই প্রসিদ্ধ। তাদের নাম আসলেই বলে দেয়া যায় যে তারা ওয়াদাখেলাপকরে অভ্যস্ত। ওয়াদা-খেলাপের কিছু আকার প্রকৃতি নিম্নরূপ-

ওজর ছাড়াই ওয়াদাকৃত কোনো স্থানে বা অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হওয়া। ওয়াদাকৃত সময়ে না এসে দেরি করে আসা। উদাহরণত কোনো ব্যক্তি আপনাকেওয়াদা দিল যে তিনি আটটার সময় আসবেন, পরে দেখা গেল তিনি আসলেন নয়টার সময়। আর এসে এই ওজর পেশ করলেন যে আসার পথে আমিএকটি দোকানে ঢুকে কিছু কেনাকাটি করেছি। আর এটা খুবই দুঃখজনক যে যাদের বাহ্যিক বেশভূষা থেকে তাকওয়া পরহেযগার বলে বিশ্বাস হয়, তারওওয়াদা ভঙ্গে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। এটা সত্যিই আফসোস ও পরিতাপের বিষয়।

চার. আমানতের খিয়ানত। বর্তমানে এমন অনেককেই দেখা যায় যারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথার্থরূপে পালন করে না। যেমন অফিসের কাজকর্মেফাঁকি দেয়া। দেরি করে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া। কর্মে ক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়ার পর আলাপচারিত, ফোন করা ইত্যাদিতে সময় কাটিয়ে দেয়া। অসুস্থ নাহয়েও অসুস্থতার ছুটি কাটানো। অথচ এমন ব্যক্তিরা মাস শেষে বেতন-ভাতা ঠিকই হাসিল করে নেয়। কর্মক্ষেত্রে এভাবে মিথ্যাচারিতার আশ্রয়ে পরিশেষেনিজের পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব করে বুঝে নেয়ার কোনো অধিকার ইসলামী শরীয়ত কাউকে দেয়নি।

পাঁচ. বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া। যেমন বিক্রেতা তার পণ্যের কোনো দোষ গোপন করে পণ্যটি বিক্রি করে দিল আর এই বলে ওজর পেশকরল যে এটা বিক্রেতার ওপর অর্পিত দায়িত্ব। অথচ বিক্রেতার উদ্দেশ্য হলো তার পণ্যটি ভালো মূল্যে বিক্রি করা। বিক্রেতা এটা ভুলে যায় যে পণ্যেরদোষত্র“টি গোপন করার অর্থ হলো বেচাকেনার বরকত চলে যাওয়া। হাকীম ইবনে হিযাম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন: الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا، أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا، فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا، بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا، مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا ‘ক্রেতা-বিক্রেতার লেনদেন নাকচ করার অধিকার রয়েছে যতক্ষণ না তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদি তারা সত্য বলে এবং কোনো কিছু গোপননা রাখে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দেয়া হয়। আর যদি তারা গোপন করে এবং মিথ্যা বলে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত ধ্বংস করে দেয়াহয়’(বুখারী ও মুসলিম)।

ছয়. সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য ও প্রয়োজনগ্রস্ততার দাবি করা। আবু হুরায়রা রযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا، فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا. ‘ যে ব্যক্তি সম্পদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সাওয়াল করল সে যেন একটি তপ্ত অঙ্গারসাওয়াল করল’(মুসলিম)।

সাত. বিবাহের পূর্বে বর ও কনে উভয়েই নিজ নিজ দোষ গোপন করা। এ দোষ চাই দৈহিক হোক অথবা চারিত্রিক। বরং এর বিপরীতের কেবল ভালোদিকগুলো প্রকাশ করা। আর তা অতিরঞ্জিত আকারে বাড়িয়ে বলা। এ বিষয়টি বিবাহের বরকতকে নস্যাৎ করে দেয়।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আমাদের যুগের ব্যবসায়ীরা অধিক পরিমাণে মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত। তারা ক্রেতাদেরকে ফাঁদে ফেলার জন্য নানা ধরনের মিথ্যার আশ্রয়নেয়। পণ্যের ক্ষেত্রে, দামের ক্ষেত্রে তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এর চেয়েও মারাত্মক হলো, অনেক ব্যবসায়ী মিথ্যা কসম খেতেও বিন্দুমাত্র ভায় পায়না। অথচ নবী কারীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যা কসমকে কবীরা গুনাহর মধ্যে শামিল করেছেন। হাদীসে এসেছে, ‘কবীরা গুনাহহলো- আল্লাহর সাথে শরীক করা, মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয়া। মানুষ হত্যা করা। কোনো জিনিসকে কেন্দ্র করে মিথ্যা কসম খাওয়া’ (বুখারী)। ইবনে বাত্তালরা. বলেন: ‘ইয়ামিনে গামুস এমন কসম যা কোনো বস্তুকে কেন্দ্র করে করা হয়, যদিও সে জানে যে সে মিথ্যা বলছে। আর এ ধরনের কসম খাওয়ারউদ্দেশ্য হলো কাউকে রাজি করানো অথব কানো সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। এটা এমন কসম যার কোনো কাফফারা হয় না। উপরšু— যারা পণ্য চালিয়েদেয়ার জন্য মিথ্যা কসম খায় তাদের ব্যবসায় বরকত হয় না। কেননা বরকত তো ঠিক তখনই হয় যখন ক্রেতা-বিক্রেতা সত্যবাদিতার পরিচয় দেয়, পণ্যেদোষত্র“টি গোপন না করে সব কিছু উন্মুক্ত করে দিয়ে তবেই বিক্রি করে।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আমাদের মধ্যে যারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত তাদের উচিত হবে যাদের সাথে তারা ওঠা-বসা করে, লেনদেন করে, তাদের সবারসাথে সত্যবাদিতা বজায় রাখা, সততা বজায় রাখা। তারা যদি এরূপ করতে পারে তবে তাদের রিযক বেড়ে যাবে। ইরশাদ হয়েছে : وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَىآَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘ আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবংতাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমীন থেকে বরকতসমূহ তাদের ওপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারাযা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (সূরা আল আরাফ:৯৬)।

     আর আল্লাহ তাআলার তাকওয়া অবলম্বন আল্লাহর পক্ষ হতে রিযক লাভের একটি নিশ্চিত মাধ্যম। ইরশাদ হয়েছে: وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا.وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেনযা সে কল্পনাও করতে পারবে না’ (সূরা আত-তালাক:২-৩)।

সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা একটি মারাত্মক অপরাধ। মিথ্যা সাক্ষ্য একটি ঘৃণ্য বিষয়। আল্লাহ তাআলা এ জাতীয় কাজ ঘৃণা করেন। ইরশাদ হয়েছে:فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ ‘সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর’ (সূরা আল হাজ্জ:৩০)।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آَثِمٌ قَلْبُهُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না এবং যে কেউ তা গোপনকরে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা আমল কর, অল্লাহ সে ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত’ (সূরা আল বাকারা: ২৮৩)।

সত্যবাদিতার ফায়দা
১-জান্নাতে লাভে ধন্য হওয়া: ‘জান্নাতের আমল কী’? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনিবলেন,‘সত্যবাদিতা’(আহমদ)। আল কুরআন অনুযায়ী কিয়ামতের দিন সত্যবাদিতাই মানুষের উপকারে আসবে, মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে নেবে।আল্লাহ তাআলা বলেন : هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ الْفَوْزُالْعَظِيمُ ‘ এটা সেই দিন যেদিন সত্যবাদীগণকে তাদের সততা উপকার করবে। তাদের জন্য আছে জান্নাতসমূহ যার নীচে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। সেখানেতারা হবে চিরস্থায়ী। অল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এটা মহাসাফল্য। (সূরা আল মায়েদা:১১৯)।

২-কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ হতে তাওফীক আসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কা‘ব ইবনে মালেক রাযি.- তাবুকযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা তিনজনের একজন- কে উদ্দেশ্য করে বলেন: أَمَّا هَذَا فَقَدْ صَدَقَ ‘তবে এ ব্যক্তি, সে নিশ্চয় সত্য বলেছে’ (বুখারী ও মুসলিম)।

৩-ধ্বংস থেকে বেঁচে যাওয়া ও সমস্যা-সঙ্কট দূরীভূত হওয়া। যে তিন ব্যক্তির গুহার মুখ পাথর দ্বারা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসেএসেছে: لَا يُنْجِيكُمْ إِلَّا الصِّدْقُ فَليَدْعُ كُلُّ رَجُلٍ مِنْكُمْ بِمَا يَعْلَمُ أَنَّهُ قَدْ صَدَقَ فِيهِ ‘ তোমাদেরকে মুক্তি দেবে না তবে তোমাদের সততা। তাই তোমাদেরমধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি সে যে বিষয়ে সত্যবাদি ছিল বলে জানে তা উল্লে¬খ করে যেন দুআ করে’ (বুখারী)।

৪-অন্তরে শুদ্ধতা আসা। কেননা যে ব্যক্তি বাইরের কাজে সত্যবাদী সে অন্তরবিষয়ক আমলেও সত্যবাদী।

৫-সত্যবাদিতা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের কারণ। ইরশাদ হয়েছে : هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ ‘এটা সেই দিন যেদনি সত্যবাদীগণকে তাদেরসততা উপকার করবে’(সূলা আল-মায়েদা:১১৯)।

৬-সত্যবাদিতা আস্থা ও প্রশান্তির কারণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: فَإِنَّ  الصِّدْقَ طُمَأْنِينَةٌ، وَإِنَّ الْكَذِبَ رِيبَةٌ ‘ নিশ্চয় সত্যবাদিতাহলো আস্থার কারণ, আর মিথ্যাবাদিতা হলো সংশয় সন্দেহের কারণ’ (তিরমিযী)।

৭- ফেতনা সত্যবাদীর কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

৮-সত্যবাদিতা সকল কল্যাণের মূল। আর মিথ্যাচার সকল গোমরাহীর মূল।

৯-মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হতে সত্যবাদীর নিষ্কৃতি। কেননা মিথ্যা বলা, হাদীস অনুযায়ী, মুনাফিকের একটি আলামত।

১০ সত্যবাদিতা সঠিক দূরদৃষ্টি অর্জনে সাহায্য করে।

তাই ভাইয়েরা আমার! আসুন আমরা সকল ক্ষেত্রে সত্যবাদী হই। সততার পরিচয় দেই। সত্যবাদীদরে সঙ্গ অবলম্বন করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকেতাওফীক দান করুন।

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

 হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সাদিকীনদের দলভুক্ত করুন। কথায়-কাজে-আচরণে আমাদের সবাইকে সততার পরিচয় দেয়ার তাওফীক দান করুন।জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে সত্যাশ্রয়ী হয়ে জীবনযাপনের তাওফীক দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে মিথ্যা থেকে হিফাযত করুন।কপটতা ও মুনাফিকী থেকে হিফাযত করুন। আমীন ।

عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : (إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.






আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের মর্যাদা

শনিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব

আমাদের হৃদয়ে মহান আল্লাহর প্রতি যথার্থ ভালোবাসা সৃষ্টি হবে না যদি আমরা তার সম্পর্কে জানতে না পরি। আমরা তাঁকে যথার্থভাবে ভয় করতে পারব না যদি আমরা তাঁকে না চিনি। তার ইবাদতও সঠিকভাবে করত সক্ষম হব না যদি তাঁর পরিচয় লাভ করতে ব্যর্থ হই। আমরা তাঁর আদেশ-নিষেধের যথার্থতাও বুঝতে ব্যর্থ হব তাঁর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে। আর সুমহান আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভের জন্য তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করার কোন বিকল্প নাই। তাই আমরা তাঁর পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যে আমাদের মানবীয় সাধ্যানুপাতে যত বেশী চেষ্টা ও সাধনা করব, সময় ও শ্রম ব্যয় করব তত বেশী সুন্দর, অর্থবহ ও সাফল্য মণ্ডিত হবে আমাদের ইহ ও পারলৌকিক জীবন ইনশাআল্লাহ।

১) আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা মহান আল্লাহর পরিচয় লাভের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম:

উবাই ইবনে কা’ব রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে মুশরিকরা এসে বলল, হে মুহাম্মদ, আপনি আমাদেরকে আপনার রবের বংশ পরিচয় দিন। তখন আল্লাহ তায়ালা নাজিল করলেন:
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

“(হে নবী) আপনি বলে দিন, তিনি আল্লাহ একক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।” (মুসনাদ আহমদ, তিরমিযী)

২) আল্লাহর নামও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম:

আবু হুরায়রা রা., হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ

“আল্লাহর এমন নিরানব্বইটি-এক কম একশটি নাম-রয়েছে, যে ব্যক্তি সেগুলো সংরক্ষণ করবে (তথা মুখস্ত করার পাশাপাশি সেগুলো বুঝে আমল করবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)

৩) আল্লাহর নাম ও গুণাবলী দুয়া কবুলের মাধ্যম:

আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا

“আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। তোমরা সে সব নাম ধরে তাঁর নিকট দুয়া কর।” (সূরা আরাফ: ১৮০)

বুরাইদা ইবনুল হুসাইব রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে এই দুয়াটি বলতে শুনলেন,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ أَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ الْأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

অর্থ: “হে আল্লাহ আমি এই ওসিলায় আপনার নিকট প্রার্থনা করছি যে, আমি সাক্ষ্য দেই, আল্লাহ আপনি ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নাই, আপনি একক এবং মুখাপেক্ষী হীন। যিনি কাউকে জন্ম দেন নি, কারও নিকট থেকে জন্ম নেন নি। যার সমকক্ষ কেউ নেই।” তখন তিনি বললেন:
لَقَدْ سَأَلْتَ اللَّهَ بِالِاسْمِ الَّذِي إِذَا سُئِلَ بِهِ أَعْطَى وَإِذَا دُعِيَ بِهِ أَجَابَ

“তুমি এমন নাম ধরে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছ, যে নাম ধরে প্রর্থনা করলে তিনি দান করেন এবং যে নাম ধরে ডাকলে তিনি ডাকে সাড়া দেন।” (তিরমিযী, হা/৩৪৭৫, আবু দাঊদ হা/১৪৯৩, ইবনে মাজাহ, হা/৩৮৫৭। আল্লামা আলবানী রহ. এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)

৪) আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করলে তা আমাদের জীবনে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে:
যখন আমরা আল্লাহ নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জানতে পারব তখন তা আমাদের ইবাদত-বন্দেগী, বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণে তার প্রভাব সৃষ্টি হবে। উদাহরণ স্বরূপ, যখন আমরা জানব যে, আল্লাহর নাম ‘আর রহমান’ (পরম করুণাময়) তখন হৃদয় পটে তাঁর রহমতের প্রত্যাশা জাগ্রত হবে।

যখন জানতে পরব যে, তাঁর একটি নাম ‘আস সামী’ (সর্বশ্রোতা) ও ‘আল বাসীর’ (সর্বদ্রষ্টা) তখন আমাদের সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে বা কথাবার্তা বলতে হবে। কারণ, একান্ত নিভৃতে বা অতি সঙ্গোপনে কোন কাজ করলে বা কোন কথা বললেও তিনি তা জেনে যাবেন। এভাবে প্রত্যেকটি নামের তাৎপর্য আমাদের জীবনে প্রভাব সৃষ্টি করে।

আল্লাহর নাম কি নিরানব্বইটিতে সীমাবদ্ধ?
আল্লাহর নাম নিরানব্বই সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাঁর নামের প্রকৃত সংখ্যা তিনি ছাড়া কেউ জানে না। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিম্নোক্ত দুয়াটি:
أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ ، أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ

“আমি আপনার সেই সকল নাম ধরে প্রার্থনা করছি, যে নামগুলো আপনি নিজেই নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন। অথবা সৃষ্ট জগতের কাউকে শিক্ষা দিয়েছেন, অথবা আপনার কিতাবে নাজিল করেছেন অথবা আপনার নিজের কাছেই ইলমে গায়ব (অদৃশ্য জ্ঞান)এ সংরক্ষিত রেখে দিয়েছেন।” (মুসনাদ আহমদ, হা/৩৭০৪, সিলসিলা সহীহাহ, আলবানী)

ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, “এতে প্রমাণিত হয়, আল্লাহ তায়ালার নাম নিরানব্বিইটির অধিক।” (মাজমু ফাতাওয়া ৬ খণ্ড ৩৭৪ পৃষ্ঠা)

আর যে হাদীসে নিরানব্বইটি নামের কথা বলা হয়েছে সেটির ব্যাখ্যায় ইমাম নওবী রহ. বলেন,
اتَّفَقَ الْعُلَمَاء عَلَى أَنَّ هَذَا الْحَدِيث لَيْسَ فِيهِ حَصْر لأَسْمَائِهِ سُبْحَانه وَتَعَالَى , فَلَيْسَ مَعْنَاهُ : أَنَّهُ لَيْسَ لَهُ أَسْمَاء غَيْر هَذِهِ التِّسْعَة وَالتِّسْعِينَ , وَإِنَّمَا مَقْصُود الْحَدِيث أَنَّ هَذِهِ التِّسْعَة وَالتِّسْعِينَ مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّة , فَالْمُرَاد الإِخْبَار عَنْ دُخُول الْجَنَّة بِإِحْصَائِهَا لا الإِخْبَار بِحَصْرِ الأَسْمَاء اهـ

“আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, উক্ত হাদীসে এ কথা নেই যে, আল্লাহর নাম নিরানব্বইটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। হাদীসের এ অর্থ নয় যে, এই নিরানব্বইটি ছাড়া আল্লাহর আর কোন নাম নেই। বরং এ কথার উদ্দেশ্য হল, যে ব্যক্তি এই নিরানব্বইটি নাম সংরক্ষণ করবে (তথা মুখস্ত করার পাশাপাশি বুঝে আমল করবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ এখানে এ নামগুলো সংরক্ষণকারীর জন্য জান্নাতে প্রবেশের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। নামের সংখ্যার সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয় নি।” (শরহে সহীহ মুসলিম)

আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে অসাধারণ আলোচনা ড আবু বকর জাকারিয়া





রিয়াদুস সলেহিন -১ বিবিধ (১ - ৬৮৫)

শনিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
পরিচ্ছদঃ ১
ইখলাস প্রসঙ্গে
প্রকাশ্য ও গোপনীয় আমল (কর্ম) কথা ও অবস্থায় আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধ নিয়ত জরুরী
বিবিধ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥ ﴾ [البينة: ٥]
অর্থাৎ “তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামায কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে। আর এটাই সঠিক ধর্ম।” (সূরা বাইয়িনাহ্ ৫নং আয়াত)

তিনি আরো বলেন,
﴿ لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ ﴾ [الحج: ٣٧]
অর্থাৎ “আল্লাহর কাছে কখনোও ওগুলির গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া (সংযমশীলতা)।” (সূরা হাজ্জ্ব ৩৭ নং আয়াত)

তিনি আরো বলেন,
﴿ قُلۡ إِن تُخۡفُواْ مَا فِي صُدُورِكُمۡ أَوۡ تُبۡدُوهُ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ ﴾ [ال عمران: ٢٩]
অর্থাৎ “বল, তোমাদের মনে যা আছে তা যদি তোমরা গোপন রাখ কিংবা প্রকাশ কর, আল্লাহ তা অবগত আছেন।” (সূরা আলে ইমরান ২৯ নং আয়াত)

উমার রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিতঃ
উমার রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, ‘‘যাবতীয় কার্য নিয়ত বা সংকল্পের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষের জন্য তাই প্রাপ্য হবে, যার সে নিয়ত করবে। অতএব যে ব্যক্তির হিজরত (স্বদেশত্যাগ) আল্লাহর (সন্তোষ লাভের) উদ্দেশ্যে ও তাঁর রাসূলের জন্য হবে; তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যেই হবে, তার হিজরত যে সংকল্প নিয়ে করবে তারই জন্য হবে।”[১]
এই হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহ এটিকে ‘এক তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক দ্বীন’ বলে অভিহিত করেছেন।
এটিকে ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর গ্রন্থ সহীহ বুখারীতে সাত জায়গায় বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেক স্থানে এই হাদীসটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল কর্মের বিশুদ্ধতা ও কর্মের প্রতিদান নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত---সে কথা প্রমাণ করা।
[১] সহীহুল বুখারী হাদীস নং ১, ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩, মুসলিম ১৯০৭, তিরমিযী ১৬৪৭, নাসায়ী ৭৫, ৩৪৩৭, ৩৭৯৪, আবূ দাউদ ২২০১, ইবনু মাজাহ ৪২২৭, আহমাদ ১৬৯, ৩০২।





আদম ও হাওয়া (আঃ) -এর তাওবাহ-ইস্তিগফার

শনিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে

আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আ-লামী-ন। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালাম ‘আলা- সায়্যিদিল আম্বিয়াই ওয়াল মুরসালীন। ওয়া ‘আলা আ-লিহি ওয়া আসহা-বিহি আজমাঈন। আম্মা বা‘দ! পৃথিবীর মানুষ ভূল ও অপরাধ করবে এটাই স্বাভাবিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে সর্বোত্তম হলো ভূল ও অপরাধ হয়ে গেলে সাথে সাথে ক্ষমা চাওয়া, ভূল স্বীকার করা।
পৃথিবীর সর্ব প্রথম মানব ও মানবী ‘আদম ও আদম ও হাওয়া (আঃ) দ্বয়ের তাওবাহ-ইস্তিগফার প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী :
﴿قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾
‘তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের রাব্ব! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব। [সূরা আ‘রাফ : ২৩]।

তাফসীর / ব্যাখ্যাঃ

তাফসীর আহসানুল বায়ান :
তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার এ হল সেই বাক্যসমূহ, যা আদম (আঃ) বরকতময় মহান আল্লাহর কাছ থেকে শেখেন। যেমন সূরা বাক্বারার ৩৭ নং আয়াতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। (উক্ত আয়াতের টীকা দ্রঃ) শয়তান আল্লাহর অবাধ্যতা করল এবং তারপর সে কেবল এর উপর অটলই থাকেনি, বরং এটাকে বৈধ ও সাব্যস্ত করার জন্য জ্ঞান ও অনুমানভিত্তিক দলীলসমূহ পেশ করতে লাগল। ফলে সে আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত এবং চিরদিনকার জন্য অভিশপ্ত গণ্য হল। পক্ষান্তরে আদম (আঃ) স্বীয় ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রতি যত্নবান হলেন। ফলে তিনি আল্লাহর রহমত ও তাঁর ক্ষমা লাভের যোগ্য গণ্য হলেন। এইভাবে দু’টি পথের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে গেল। শয়তানের পথের এবং আল্লাহওয়ালাদের পথেরও। পাপ করে অহংকার প্রদর্শন করা, তার উপর অটল থাকা এবং তাকে সঠিক সাব্যস্ত করার জন্য দলীলাদির স্তূপ খাড়া করা ইত্যাদি হল শয়তানী পথ। আর পাপ করার পর অনুতাপে দগ্ধ হয়ে আল্লাহ-সমীপে নত হয়ে যাওয়া এবং তওবা ও ক্ষমা চাওয়ায় সচেষ্ট হওয়া ইত্যাদি হল আল্লাহর বান্দাদের পথ। হে আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। [তাফসীর আহসানুল বায়ান]।
তাফসীর যাকারিয়া :
কাতাদা বলেন, তারা দু’জন নিজেদের লজ্জাস্থান পরস্পর দেখতে পেত না। কিন্তু অপরাধের পর সেটা প্রকাশ হয়ে পড়ল। তখন আদম আলাইহিস সালাম বললেন, হে রব! যদি আমি তাওবা করি এবং ক্ষমা চাই তাহলে কি হবে আমাকে জানান? আল্লাহ বললেন, তাহলে আমি তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। কিন্তু ইবলীস ক্ষমা চাইলো না, বরং সে অবকাশ চাইল। ফলে আল্লাহ প্রত্যেককে তার প্রার্থিত বিষয় দান করলেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

আয়াত সংশ্লিষ্ট কাহিনী:

এ কাহিনীটিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
ক. লজ্জা মানুষের একটি প্রকৃতিগত ও স্বাভাবিক অনুভূতি।
মানুষ নিজের শরীরের বিশেষ স্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে প্রকৃতিগতভাবে যে লজ্জা অনুভব করে সেটি ঐ স্বাভাবিক অনুভূতির প্রাথমিক প্রকাশ। কুরআন আমাদের জানায়, সভ্যতার ক্রমোন্নতির ফলে মানুষের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এ লজ্জার সৃষ্টি হয়নি বা এটি বাইরের থেকে অর্জিত কোন জিনিসও নয়, যেমন শয়তানের কোন কোন সুচতুর শিষ্য ও অনুসারী অনুমান করে থাকে । বরং জন্মের প্রথম দিন থেকেই এ প্রকৃতিগত গুণটি মানুষের মধ্যে রয়েছে।
খ. নগ্নতা, অশ্লিলতা, বেহায়াপনা ও যৌনতার পথে পরিচালিত করা :
মানুষকে তার স্বভাবসূলভ সোজা-সরল পথ থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে শয়তানের প্রথম কৌশলটি ছিল তার এ লজ্জার অনুভূতিতে আঘাত করা, উলংগতার পথ দিয়ে তার জন্যে নির্লজ্জতা ও অশ্লিলতার দরজা খুলে দেয়া এবং যৌন বিষয়ে তাকে খারাপ পথে পরিচালিত করা। অন্য কথায় বলা যায় , প্রতিপেক্ষের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্যে তার যে, দুর্বলতম স্থানটিকে সে বেছে নিয়েছিল সেই ছিল তার জীবনের যৌন বিষয়ক দিক । যে লজ্জাকে মানবীয় প্রকৃতির দুর্গরক্ষক হিসেবে মহান আল্লাহ নিযুক্ত করেছিলেন তারই ওপর এনেছে সে প্রথম আঘাতটি। শয়তান ও তার শিষ্যবর্গের এ কর্মনীতি আজো অপরিবর্তিত রয়েছে। মেয়েদেরকে উলংগ করে প্রকাশ্য বাজারে না দাঁড় করানো পর্যন্ত তাদের প্রগতির কোন কার্যক্রম শুরুই হতে পারে না।
গ. অসৎকাজ করার প্রকাশ্য আহবানকে মানুষ খুব কমই গ্রহণ করে :
অসৎকাজ করার প্রকাশ্য আহবানকে মানুষ খুব কমই গ্রহণ করে, এটিও মানুষের স্বভাবসূলভ প্রবণতা। সাধারণত তাকে নিজের জালে আবব্ধ করার জন্যে তাই প্রত্যেক অসৎকর্মের আহকায়ককে কল্যাণকামীর ছদ্মবেশে আসতে হয়।
ঘ. মানুষের মধ্যে উচ্চতর বিলাশী জীবন লাভের আকাংখা :
মানুষের মধ্যে উচ্চতর বিষয়াবলী যেমন মানবিক পর্যায় থেকে উন্নতি করে উচ্চতর মার্গে পৌছার বা চিরন্তন জীবনলাভের স্বাভাবিক আকাংকা থাকে । আর শয়তান তাকে ধোঁকা দেবার ক্ষেত্রে প্রথম সাফল্য অর্জন করে এ পথেই। সে মানুষের এ আকাংখাটির কাছে আবেদন জানায়। শয়তানের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হচ্ছে , সে মানুষের সামনে তাকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়ার এবং বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নতর অবস্থায় পৌছিয়ে দেবার টোপ ফেলে, তারপর তাকে এমন পথের সন্ধান দেয় , যা তাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
ঙ. মানবীয় সাধারণ ধারণার খন্ডন :
সাধারণভাবে একথাটির প্রচলিত হয়ে গেছে যে, শয়তান প্রথমে হাওয়া (আ.)-কে তার প্রতারণা জালে আবদ্ধ করে, তারপর আদম (আ.)-কে জালে আটকাবার জন্যে তাকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু কুরআন এ ধারণা খণ্ডন করে। কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে, শয়তান তাদের উভয়কেই ধোঁকা দেয় এবং তারা উভয়েই শয়তানের ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটা একটি মামুলী কথা বলে মনে হয়। কিন্তু যারা জানেন, হযরত হওয়া সম্পর্কিত এ সাধারন্যে প্রচলিত বক্তব্যটি সারা দুনিয়ায় নারীর নৈতিক সামাজিক ও আইনগত মর্যাদা হ্রাস করার ক্ষেত্রে কত বড় ভূমিকা পালন করেছে একমাত্র তারাই কুরআনের এ বর্ণনার যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।
চ. নিষিদ্ধবৃক্ষের ফল ও যৌক্তিকতা :
এরূপ ধারণা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই যে, নিষিদ্ধ গাছের এমন কোন বিশেষ গুণ ছিল, যে কারণে তার ফল মুখ দেবার সাথে সাথেই হযরত আদম ও হাওয়ার লজ্জাস্থান অনাবৃত হয়ে গিয়েছিল। আসলে এটি কেবল আল্লাহর নাফরমানিরই ফলশ্রুতি ছিল। আল্লাহ ইতিপূর্বে নিজের ব্যবস্থাপনায় তাদের লজ্জাস্থান আবৃত করেছিলেন। তারা তাঁর নির্দেশ অমান্য করার সাথে সাথেই তিনি তাদের ওপর থেকে নিজের হেফাজত ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে নিয়েছিলেন, তাদের আবরণ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তারা যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করার ব্যবস্থা করুক। এ কাজের দায়িত্ব তাদের নিজেদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর যদি তারা প্রয়োজন মনে না করে অথবা এ জন্যে প্রচেষ্টা না চালায় তাহলে তারা যেভাবেই বিচরণ করুক না কেন, তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না। এভাবে যেন চিরকালের জন্যে এ সত্যটি প্রকাশ করে দেয়া হলো যে, মানুষ আল্লাহর নাফরমানী করলে একদিন না একদিন তার আবরণ উন্মুক্ত হয়ে যাবেই এবং মানুষের প্রতি আল্লাহর সাহায্য -সহযোগিতা ততদিন থাকবে যতদিন সে থাকবে আল্লাহর হুকুমের অনুগত। আনুগত্যের সীমানার বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই সে আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারবে না। বরং তখন তাকে তার নিজের হাতেই সঁপে দেয়া হবে। বিভিন্ন হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবংএ সম্পর্কে তিনি দোয়া করেছেন। ‘‘”হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমতের আশা করি। কাজেই এক মুহুর্তের জন্যেও আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করে দিয়ো না”।
ছ. মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিরোধিতায় শয়তানের অবস্থান :
শয়তান একথা প্রমাণ করতে চাচ্ছিল যে, তার মোকাবিলায় মানুষকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে সে তার যোগ্য নয়। কিন্তু প্রথম মোকাবিলায় সে পরিজিত হলো। সন্দেহ নেই, এ মোকাবিলায় মানুষ তার রবের নির্দেশ মেনে চলার ব্যাপারে পূর্ণ সফলকাম হতে পারেনি এবং তার এ দুর্বলতাটিও প্রকাশ হয়ে পড়লো যে, তার পক্ষে নিজের প্রতিপক্ষের প্রতারণা জালে আবদ্ধ হয়ে তার আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া সম্ভব। কিন্তু এ প্রথম মোকাবিলায় একথাও চূড়ান্ত ভাবে প্রমানিত হয়ে গেছে যে, মানুষ তার নৈতিক মর্যাদার দিক দিয়ে একটি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। প্রথমত শয়তান নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার ছিল। আর মানুষ নিজে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করেনি রবং শ্রেষ্ঠত্ব তাকে দান করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত শয়তান নির্জলা অহংকার ও আত্মাম্ভরিতার ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। অন্যদিকে মানুষ স্বেচ্ছায় ও স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেনি। বরং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে এতে প্রবৃত্ত হয়। অসৎকাজের প্রকাশ্য আহবানে সে সাড়া দেয়নি। বরং অসৎকাজের আহবায়ককে সৎকাজের আহবায়ক সেজে তার সামনে আসতে হয়েছিল। সে নীচের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে নীচের দিকে যায়নি বরং এ পথটি তাকে উপরের দিকে নিয়ে যাবে এ ধোকায় পড়ে সে নীচের দিকে যায়। তৃতীয়ত শয়তানকে সতর্ক করার পর সে নিজের ভুল স্বীকার করে বন্দেগীর দিকে ফিরে আসার পরিবর্তে নাফরমানীর ওপর আরো বেশী অবিচল হয়ে যায়। অন্যদিকে মানুষকে তার ভূলের ব্যাপারে সতর্ক করে দেবার পর সে শয়তানের মত বিদ্রোহ করেনি বরং নিজের ভূল বুঝতে পারার সাথে সাথেই লজ্জিত হয়ে পড়ে। নিজের ত্রুটি স্বীকার করে, বিদ্রোহ থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের রবের রহমতের ছত্রছায়ায় আশ্রয় খুঁজতে থাকে।
জ. মানবপথ ও শয়তানের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন :
এভাবে শয়তানের পথ ও মানুষের উপযোগী পথ দুটি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়।আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর মোকাবিলায় বিদ্রোহের ঝাণ্ডা বুলন্দ করা , সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও সগর্বে নিজের বিদ্রোহাত্মক কর্মপদ্ধতির ওপর অটল হয়ে থাকা এবং যারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে চলে তাদেরকেও বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করে গোনাহ ও নাফরমানীর পথে টেনে আনার চেষ্টা করাই হচ্ছে নির্ভেজাল শয়তানের পথ। বিপরীত পক্ষে মানুষের উপযোগী পথটি হচ্ছেঃ প্রথমত শয়তানের প্ররোচান ও অপহরণ প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হবে। তার এ প্রচেষ্টায় বাধা দিতে হবে। নিজের শত্রুর চাল ও কৌশল বুঝাতে হবে এবং তার হাতে থেকে বাচার জন্যে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে । কিন্তু এরপর যদি কখনো তার পা বন্দেগী ও আনুগত্যের পথ থেকে সরেও যায় তাহলে নিজের ভূল উপলব্ধি করার সাথে সাথেই লজ্জায় অধোবদন হয়ে তাকে নিজের রবের দিকে ফিরে আসতে হবে এবং নিজের অপরাধ ও ভুলের প্রতিকার ও সংশোধন করতে হবে। এ কাহিনী থেকে মহান আল্লাহ এ মৌল শিক্ষাটিই দিতে চান। এখানে মানুষের মনে তিনি একথাগুলো বদ্ধমূল করে দিতে চান যে, তোমরা যে পথে চলছো সেটি শয়তানের পথ। এভাবে আল্লাহর হেদায়াতের পরোয়া না করে জিন ও মানুষের মধ্যকার শয়তানদেরকে নিজেদের বন্ধু ও অভিভাবকে পরিণত করা এবং ক্রমাগত সতর্ক বাণী উচ্চারণ করার পরও তোমাদের এভাবে নিজেদের ভুলের ওপর অবিচল থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মূলত নির্ভেজাল শয়তানী কর্মনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমরা নিজেদের আদি ও চিরন্তন দুশমনের ফাঁদে আটকা পড়ছো। এবং তার কাছে পূর্ণ পরাজয় বরণ করছো। শয়তান যে পরিণতির মুখোমুখি হতে চলেছে, তোমাদের এ বিভ্রান্তির পরিণামও তাই হবে। যদি তোমরা সত্যিই নিজেরা নিজেদের শত্রু না হয়ে গিয়ে থাকো এবং তোমাদের মধ্যে সামান্যতম চেতনাও থেকে থাকে, তাহলে তোমরা নিজেদের ভুল শুধরিয়ে নাও, সতর্ক হয়ে যাও এবং তোমাদের বাপ আদম ও মা হাওয়া পরিশেষে যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তোমরাও সেই একই পথ অবলম্বন করো।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

ক. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু, তার প্রতিশ্র“তি মিথ্যা, সে ধোঁকা দিয়ে মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে চায়, তাই তার সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
খ. শয়তানের চক্রান্তে পড়ে অন্যায় করলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবাহ করা উচিত, এটাই আদম (আঃ)-এর বৈশিষ্ট্য। আর তাওবাহ না করে অপরাধে অটল থাকা শয়তানের কাজ।

উপসংহারঃ

জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদেরকে নবীদের পথ অনুসরণ করতে হবে। অপরাধ, ভুল ও গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে তাওবাহ করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উপরোক্ত বিষয়ের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

লেখক: আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
শিক্ষক, ইনসাইট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উত্তরা, ঢাকা।



ফটো গ্যালারী

1/6
ওহুদ যুদ্ধ - হযরত মহাম্মদ (সা:) এর বিপ্লবী জীবন
2/6
মুসলিম নারীর বিধান
3/6
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা
4 / 6
ইসলামীক জিজ্ঞাসাঃ লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
5/6
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
6/6
উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব

Islam-icon Profile.png