LIVE
Loading latest headlines...

সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৯

কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত

সোমবার, ডিসেম্বর ০২, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত
কুরআন শব্দের অর্থ: পাঠ করা, যা পাঠ করা হয়। আর পরিভাষায়-আল্লাহ তা‘আলা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতির হেদায়াত হিসাবে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম আল কুরআন।

আল-কুরআন কি?
এ প্রশ্নের জবাব স্বয়ং কুরআনই দিয়েছে। কুরআনের ভাষায়– إِنَّهُ لَقُرْ‌آنٌ كَرِ‌يمٌ  فِي كِتَابٍ مَّكْنُونٍ
‘নিঃসন্দেহ এটি তো এক সম্মানিত কুরআন,এক সুরক্ষিত গ্রন্থে। [সূরা ওয়াকিয়া : ৭৭-৭৮]
অন্যত্র বলা হয়েছে: وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ  ‘নিশ্চয়ই এটি এক অপরাজেয় কিতাব।’ [সূরা হামীম আস-সাজদা : ৪১]
قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّـهِ نُورٌ‌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক আলোকবর্তিকা এবং এক উন্মুক্ত কিতাব।’ [সূরা মায়িদা : ১৫]
অন্যত্র বলা হয়েছে: تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ‘এগুলো বিজ্ঞানময় কিতাবের আয়াত।’[সূরা লুকমান : ২]

কুরআন শিক্ষা করা সহজ
যদিও এর ভাষা আরবী কিন্তু যারা কুরআন শিখতে চায় তাদের জন্য কুরআনকে আল্লাহ সহজ করে নাযিল করেছেন।
পবিত্র কুরআন শুধু তেলাওয়াত করে খতম করার জন্য অবতীর্ণ হয়নি। বরং আল্লাহ এই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, যেন তা নিয়ে গবেষণা করে বাস্তবে আমল করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
قال سبحانه: كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَ‌كٌ لِّيَدَّبَّرُ‌وا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ‌ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿٢٩﴾
এটি একটি বরকতময় কিতাব,যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে। (সূরা সাদ: ২৯)

এই আয়াত হতে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারলাম:

১। এটি আল্লাহর কিতাব যা তিনি অবতীর্ণ করেছেন।
২। এটি বরকতপূর্ণ কিতাব, আর বরকত তখনই অর্জন হবে যখন তদানুযায়ী আমল করা হবে।
৩। বরকত বলা হয় সেই অতিরিক্ত বস্তুকে যা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু অনুভব করতে পারি।
৪। বরকতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে,“কল্যাণ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি।”কুরআন মজীদকে বরকত সম্পন্ন কিতাব বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটি মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত উপকারী কিতাব। এ কিতাবটি তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বোত্তম বিধান দান করে। এর বিধান মেনে চলায় মানুষের লাভই হয় কেবল, কোনো প্রকার ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

আয়াতের দ্বিতীয় শেষ অংশ: لِّيَدَّبَّرُ‌وا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ‌ أُولُو الْأَلْبَابِ
অর্থাৎ: যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।

কুরআন দুটি উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে
১। চিন্তা ও গবেষণা করা
২। উপদেশ গ্রহণ করা

সম্মানিত হাজেরীন! চিন্তা ও গবেষণার অর্থ হলো:
    আমরা বার বার তেলাওয়াত করবো, যেভাবে বিজ্ঞান শাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র পড়ে থাকি, খবরের কাগজের মত না।
    গবেষণার পূর্বে কিতাবের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে, যে এটি বিজ্ঞানপূর্ণ কিতাব, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে।
    গবেষণা করলে কুরআন নাযিলের মর্ম অনুধাবন হয়।

উপদেশ গ্রহণ করার অর্থ
১।কুরআনে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
২।বিধানাবলীকে জীবন পরিচালনার পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করা।

গবেষণার পূর্বে কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক বোঝা দরকার।এখানে ৪টি বিষয় লক্ষণীয়
  •     কুরআন আমাদেরকে সরাসরি বলছে,
  •     কুরআন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলছে,
  •     কুরআন মীমাংসা করার কথা বলে,
  •     কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বুঝতে হবে।

সরাসরি বলতে বুঝায়
যখনই আমরা কুরআন তেলাওয়াত কিংবা শ্রবণ করি, আমরা বলে থাকি এটি আল্লাহর কিতাব। এর অর্থ হলো, যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সরাসরি সম্বোধন করছেন। যখন আমরা এ কথা বুঝলাম যে, আল্লাহ আমাদেরকেই বলছেন। আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহ দেখছেন, তার বান্দা কুরআন শুনে কি করে? অর্থাৎ কুরআন শোনে আমল করে কি না?

ব্যক্তিগতগত বলতে বুঝায়
আমরা যে আয়াত তেলাওয়াত করি কিংবা শ্রবণ করি, তখন এই অনুভূতি নিয়ে তেলাওয়াত করা বা শোনা দরকার যে, এই আয়াতটি আমার জন্য। এমন না যে, এই আয়াত কাফেরদের জন্য, অমুক আয়াত মুনাফিকদের জন্য, অমুক আয়াত মদীনাবাসীর জন্য, আর অমুক আয়াত মক্কাবাসীর জন্য। বরং এভাবে গবেষণা করতে হবে যে, এই আয়াতে আমার জন্য কি শিক্ষা রয়েছে, আমি এখান থেকে কিভাবে হেদায়াত পেতে পারি।

মীমাংসিত বলতে বুঝায়
প্রতিটি খাদ্যে বা দানায়, খাদকের নাম লেখা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, সবকিছুই ভাগ্যলিপিতে লিখা রয়েছে। তাহলে বলতে পারি, যে প্রতি আয়াতে তেলাওয়াতকারী ও শ্রবণকারীর নাম লিখা রয়েছে।

সম্পর্ক বলতে বুঝায়
কুরআন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যখনই কুরআন পড়া হয় বা শ্রবণ করা হয়, তখনই আমাদেরকে কোন না কোন দিক দির্দেশনা দিয়ে থাকে। কেননা আল্লাহর উপদেশ অনর্থক হতে পারে না। আমাদের চিন্তা ভাবনা করা দরকার যে, হে আল্লাহ আজ আমাকে এই আয়াত কেন শোনালেন?

গবেষণার জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত
১। মনোযোগ
২। বুঝা
৩। চিন্তা-ভাবনা
৪। অনুভূতি-বোধ
 
মনোযোগ: চোখ, কান, শরীর, মন, মগজ সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কুরআন বুঝার জন্য মনোযোগী করতে হবে।
পুরো আয়াত যদিও বুঝে না আসে, তবুও মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে, যতটুকু বুঝে আসে তা আমল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

বুঝা: কুরআন বুঝে না আসলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গীকার করতে হবে, আজ থেকে কুরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।

চিন্তা-ভাবনা: যখনই কোন নিদর্শনের আলোচনা বা ঐতিহাসিক বিষয় আসে, সেখানে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।

অনুভূতি-বোধ: যেখানে পুরস্কারের আলোচনা হয়, সেখানে ভালোভাবে অনুভূতিসহ পড়বে, জান্নাতের আলোচনার স্থানে আগ্রহ বাড়িয়ে দিবে, আর জাহান্নামের আলোচনা আসলে, ভয় অনুভব করবে।

গবেষণা ও উপদেশ গ্রহণের নিয়ম
দোয়া: কুরআনের প্রতিটি আয়াত আমাদের কাছ থেকে কিছু চায়। সেটি পূর্ণ করার জন্য দোয়া দিয়ে আরম্ভ করা উচিৎ। অর্থাৎ প্রতিটি আয়াত আমলের জন্য নাযিল করা হয়েছে, চাই তা অন্তরের আমল হোক বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আমল হোক। সুতরাং প্রতিটি কাজের সূচান দোয়া দিয়ে করতে হবে।

ইহতেসাব:
দোয়ার আলোকে বিগত দিনগুলোর আত্মসমালোচনা করা উচিত। শুধু দোয়া যথেষ্ট না। তাই দোয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টাও করতে হবে। যেমন আপনার ছেলে ১০ শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু পাস করতে পারছে না। এই ক্ষেত্রে ছেলেকে স্কুলে যেতে হবে, নিয়মিত পাঠ করতে হবে, ইত্যাদি।

পরিকল্পনা:
আগামী দিন আপনি কি করবেন সেই বিষয়ে পরিকল্পনা করা দরকার। যদি সফলতার প্লান না করেন, তাহলে ব্যর্থতার প্লান করা হবে। যেমন আপনি খানা খাওয়ার প্লান না করলে, না খেয়ে থাকার প্লান করা হলো।

তাবলীগ: রাসূল (সা.) বলেছেন: بلغوا عني و لو آية একটি আয়াত জানা থাকলে তা পৌঁছে দাও।

গবেষণার উপর কয়েকটি আয়াত

أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا  [محمد:24]
তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?
أَفَلَا يَتَدَبَّرُ‌ونَ الْقُرْ‌آنَ ۚ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ‌ اللهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرً‌ا ﴿٨٢﴾
এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত। (সূরা নিসা:৮২)
أَفَلَمْ يَدَّبَّرُ‌وا الْقَوْلَ أَمْ جَاءَهُم مَّا لَمْ يَأْتِ آبَاءَهُمُ الْأَوَّلِينَ ﴿٦٨﴾
অতএব তারা কি এই কালাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে, যা তাদের পিতৃপুরুষদের কাছে আসেনি? (সূরা মুমিনূন: ৬৮)
وَقَالَ الرَّ‌سُولُ يَا رَ‌بِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَـٰذَا الْقُرْ‌آنَ مَهْجُورً‌ا ﴿٣٠﴾
রসূল বললেনঃ হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায় এই কোরআনকে প্রলাপ সাব্যস্ত করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০)
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَ‌حْمَةً وَبُشْرَ‌ىٰ لِلْمُسْلِمِينَ  – النحل : ﴿٨٩﴾
আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ। (সূরা নাহল: ৮৯)

কুরআন গবেষণার উপর হাদীস

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيْقًا اِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِىْ بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُوْنَهُ بَيْنَهُمْ اِلَا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِيْنَةُ وَغَشِيْيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطَّاَبِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ  (مسلم–ابو داود–ترمذى)
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। আর যখন কোন একদল লোক আল্লাহর ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং তার উপর শিক্ষামূলক আলাপ-আলোচনা করে, তখন তাদের উপর (আল্লাহর পক্ষ থেকে) এক মহাপ্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহর রহমত তাদেরকে আবৃত করে রাখে। আর ফেরেশতাদের মজলিসে তাদের সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেন। আর যার আমল তাকে পিছন দিকে টানবে, বংশ গৌরব তাকে আগে বাড়াতে পারবে না। (অর্থাৎ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্য হল ইলম অনুসারে আমল করা। সুতরাং যে আমল করবে না তার ইলম কিংবা বংশ মর্যাদা তাকে আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে পারবে না।) (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী)

 কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব
১. কুরআন শিক্ষা ফরয :
প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। যে নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবী করবে তাকে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
 ﴿ اقْرَ‌أْ بِاسْمِ رَ‌بِّكَ الَّذِي خَلَقَ ﴾ [العلق: ١] 
অর্থ: ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরা আলাক : ১]।
কুরআন শিক্ষায় কোন প্রকার অবহেলা করা যাবে না। উম্মাতকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, «تَعَلَّمُوا الْقُرْآنَ ، وَاتْلُوهُ»
অর্থ:‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’ [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ:৮৫৭২]।

২. সালাত আদায়ের জন্য কুরআন শিক্ষা:

আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদার বান্দাহদের উপর প্রতিদিন পাচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া সালাত আদায় হয় না। সালাত আদায় করার জন্যও কুরআন শিখতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿ فَاقْرَ‌ءُوا مَا تَيَسَّرَ‌ مِنَ الْقُرْ‌آنِ﴾ [المزمل: ٢٠]
অর্থ: ‘অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়’[সূরা আল-মুযযাম্মিল: ২০]।

এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ».
অর্থ: ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ে না তার সালাতই হয় না’। [সহীহ বুখারী:৭৫৬]

৩. কুরআন প্রচারের জন্য শিক্ষা করা :

কুরআন মাজীদে কুরআন প্রচারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে নির্দেশের আলোকে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম কুরআন প্রচার-প্রসারে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না,সে কীভাবে তা প্রচার করবে? সুতরাং কুরআন প্রচার-প্রসারে ভূমিকা পালন করার জন্য তা শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। কুরআনে বলা হয়েছে, ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغْ مَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ﴾ [المائ‍دة: ٦٧]
অর্থ: হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও [সূরা মায়িদাহ : ৬৭]।

৪. কুরআন শিক্ষা অন্তরের প্রশান্তি :
মানব জীবনে অর্থ বা অন্যান্য কারণে জাগতিক তৃপ্তি আসলেও প্রকৃত তৃপ্তি ও শান্তি কুরআন শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। এজন্য কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ‌ اللَّـهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ‌ اللَّـهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ ﴾ [الرعد: ٢٨] 
 অর্থ:‘যারা ঈমান আনে,বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখ,আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়’ [সূরা আর-রা‘দ:২৮]।

৫. হেদায়াত লাভের জন্য কুরআন শিক্ষা :
কুরআনের মাধ্যমেই হেদায়াতের সন্ধান পাওয়া যাবে। সেজন্য কুরআন থেকে হেদায়াত পাবার জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে । কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ إِنَّ هَـٰذَا الْقُرْ‌آنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ ﴾ [الاسراء: ٩]
অর্থ: ‘নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথ-প্রদর্শন করে,যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক’।[সূরা বনি-ইসরাঈল:০৯]

৬. জান্নাতে যাওয়ার জন্য কুরআন শিক্ষা:
প্রত্যেক মুমিনের সর্বোচ্চ কামনা হলো জান্নাতে যাওয়া। তাই  জান্নাতে যাওয়ার  জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে। হাদিসে এসেছে,
«اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ»
অর্থ: সিয়াম ও কুরআন কিয়ামাতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে আমার রব, আমি দিনের বেলায় তাকে (এ সিয়াম পালনকারীকে) পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব,আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে [মুসনাদ আহমাদ: ৬৬২৬]।

কুরআন শিক্ষা না করার পরিণতি
১. রাসূলের অভিযোগ পেশ :
কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাতের জন্য শাফায়াত চাইবেন। কিন্তু যারা কুরআন শিক্ষা করেনি, কুরআনের যেসব হক রয়েছে তা আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ পেশ করবেন। কুরআনে এসেছে :
﴿ وَقَالَ الرَّ‌سُولُ يَا رَ‌بِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَـٰذَا الْقُرْ‌آنَ مَهْجُورً‌ا﴾ [الفرقان: ٣٠]
অর্থ: ‘আর রাসূল বলবেন,হে আমার রব,নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’ [সূরা আল-ফুরকান-৩০]

ইবন কাসীর বলেন, কুরআন না পড়া, তা অনুসারে আমল না করা, তা থেকে হেদায়াত গ্রহণ না করা, এ সবই কুরআন পরিত্যাগ করার শামিল।

২. কিয়ামতে অন্ধ হয়ে উঠবে :

যে কুরআন শিখা থেকে থেকে বিমুখ হয়ে থাকল, সে কতইনা দুর্ভাগা! আলকুরআনে এসেছে,
﴿ وَمَنْ أَعْرَ‌ضَ عَن ذِكْرِ‌ي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُ‌هُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ ﴿١٢٤﴾ قَالَ رَ‌بِّ لِمَ حَشَرْ‌تَنِي أَعْمَىٰ وَقَدْ كُنتُ بَصِيرً‌ا ﴿١٢٥﴾ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا ۖ وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ ﴾  [طه: ١٢٤،  ١٢٦]  
আর যে আমার যিক্র (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে,  নিশচয় তার জীবন-যাপন হবে  সংকুচিত এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থয় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন ? অথচ আমিতো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্নণ? তিনি বলবেন, অনুরুপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অত:পর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’ [সূরা তাহা-১২৪-১২৬]।

৩.মূক, বধির অবস্থায় ঊঠবে:
সবচেয়ে বড় হেদায়েত আল-কুরআন প্রত্যাখ্যানকারীদের কবর হবে সংকীর্ণ, যার দরুন তাদের দেহের পাঁজরগুলো বাঁকা হয়ে যাবে। অবশেষে কিয়ামতের দিন মূক ও বধির হয়ে উঠবে । আলকুরআনে এসেছে :
وَنَحْشُرُ‌هُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا  مَّأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۖ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرً‌ا [الاسراء:
আমি কিয়ামতের দিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়, অন্ধ অবস্থায়, মূক অবস্থায়, বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। যখন জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন তাদের জন্য অগ্নি আরও বাড়িয়ে দেব। [সূরা বনি-ঈসরাইল:৯৭]

৪. গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত :
কুরআন শিক্ষা না করা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শামিল। কুরআনে এসেছে,
أُولَـٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ۚ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ ﴾ [الاعراف: ﴿١٧٩]
অর্থ: ‘এরা চতুস্পদ জন্তুর ন্যায় বরং এরা তাদের চেয়েও আরো অধম ও নিকৃষ্ট এরাই হলো গাফেল’ [সূরা আরাফ-১৭৯] ।

৫. কুরআন বিপক্ষের দলীল হিসাবে আসবে :
কুরআন শিক্ষা থেকে বিরত থাকার কারণে কুরআন তার বিপক্ষের দলিল হিসাবে উপস্থিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : «وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ»
অর্থ: কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষের দলীল।   [সহীহ মুসলিম: ৩২৮ ]

৬. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে :
জাহান্নামের মত ভয়াবহ কঠিন জায়গা আর নেই। কুরআন শিক্ষা না করার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الْقُرْآنُ شَافِعٌ مُشَفَّعٌ وَمَا حِلٌ مُصَدَّقٌ، مَنْ جَعَلَهُ إِمَامَهُ قَادَهُ إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَنْ جَعَلَهُ خَلْفَ ظَهْرِهِ سَاقَهُ إِلَى النَّارِ
 কুরআন সুপারিশকারী এবং তাঁর সুপারিশ গ্রহণযোগ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনকে সামনে রেখে তাঁর অনুসরণ করবে, কুরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি একে নিজ পশ্চাতে রেখে দিবে, কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে [সহীহ ইবনে হিববান : ১২৪]।

৭. আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে:

কুরআন শিক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন না করলে এ বিষয়ে আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿ وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ‌ لَّكَ وَلِقَوْمِكَ ۖ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ ﴾ [الزخرف: ٤٤]
অর্থ: নিশ্চয় এ কুরআন তোমার জন্য এবং তোমার কওমের জন্য উপদেশ। আর অচিরেই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে। [সূরা যুখরুফ : ৪৪]

কুরআন শিক্ষায় করণীয়

১. ভাল শিক্ষকের কাছে পড়া:
যিনি সহীহভাবে কুরআন পড়তে পারেন তার নিকটই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে যে শিক্ষকের কুরআন শিক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণ আছে তার কাছে পড়লে আরো ভাল হয়।

২. নিয়মিত পড়া :

সহীহভাবে কুরআন শিক্ষার জন্য নিয়মিত সময় দেয়া দরকার। যদিও কম সময় হয়। প্রতিদিন শেখার মধ্যে থাকলে সহীহভাবে কুরআন শিক্ষা সহজ হবে এবং যা শেখা হবে তা আয়ত্ত্বে থাকবে।

৩. মশক করা :

কোন যোগ্য শিক্ষকের কাছে মশক করলে পড়ার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। মশক হলো- শিক্ষক পড়বে তারপর সেভাবে ছাত্রও পড়বে। এ ছাড়া বিভিন্ন সিডির মাধ্যমেও মশক করা যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী মুহাম্মাদ সিদ্দিক মানশাওয়াভীর কুরআন প্রশিক্ষণ সিডির সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

৪. পরিবার পরিজন ও সন্তানদের শিক্ষা দেয়া:
প্রত্যেক মুসলিমকে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। কুরআনে এসেছে,
﴿ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارً‌ا ﴾ [التحريم: ٦]
অর্থ:‘হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’ [সূরা তাহরীম-৬]।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
«عَلَيْكُم بِالْقُرْآنِ ، فَتَعَلَّمُوْهُ وَعَلِّمُوْهُ أَبْنَائَكُمْ ، فَإِنَّكُمْ عَنْهٌ تُسْأَلُوْنَ ، وَبِهِ تُجْزَوْنَ»
অর্থর্: কুরআনের বিষয়ে তোমাদের উপর অবশ্য পালনীয় এই যে, কুরআন শিক্ষা করা এবং তোমাদের সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দেয়া। কেননা এ বিষয়ে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তার প্রতিদানও দেয়া হবে। [শরহে সহীহ বুখারী, ইবন বাত্তাল : ৪৬]

৫. ফযীলাতপূর্ণ সূরাগুলো বেশী বেশী তেলাওয়াত করা :
ফযীলতপূর্ণ সূরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ فِى لَيْلَةٍ ثُلُثَ الْقُرْآنِ. قَالُوا  :وَكَيْفَ يَقْرَأُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ قَالَ : (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) يَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ.»
‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? তারা বললেন, কুরআনের এক তৃতীয়াংশ কিভাবে পড়া পড়বে তিনি বললেন, (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য’ [সহীহ বুখারী: ৫০১৫] ।

অতএব যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফযীলত ও বেশি নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে এবং যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি পড়া দরকার তার মধ্যে রয়েছে, শুক্রবার ফজর নামাজে সূরা আলিফ-লাম-সিজদাহ পড়া, ঘুমানোর আগে সূরা মুলক এবং ফরয নামাজের পর সূরা নাস, সূরা ফালাক ও আয়াতুল কুরসী পড়া।  আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে কুরআন শিক্ষার তাওফীক দিন। আমীন।



যিনা বা ব্যভিচারের সম্পর্কে ইসলামে নিষেধাজ্ঞা

সোমবার, ডিসেম্বর ০২, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে
যিনা বা ব্যভিচারের নিষেধাজ্ঞা
যিনা বা ব্যভিচার বলতে বুঝায় ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক বিবাহ বন্ধন ছাড়া অবৈধ পন্থায় যৌন তৃপ্তি লাভ করাকে। ইসলামী শরীয়াতে অবৈধ পন্থায় যৌন সম্ভোগ সম্পূর্ণ হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

যিনার বিধান: ইসলামের মূল লক্ষ্যসমুহের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হল, মানুষের ইজ্জত-আবরু ও বংশের হেফাজত করা। যিনার মাধ্যমে ইসলামের এ মহান উদ্দেশ্য বিঘ্নিত হয় বিধায় ইসলামে এটি হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং যে সব মানবিক অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে এটি তন্মধ্যে গুরুতর ও অন্যতম। ব্যভিচার একটি মহাপাপ যা অনেকগুলো অপরাধের নায়ক। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন: “তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটি অশ্লীল কাজ ও অসৎ পন্থা।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩২)
তিনি অন্য স্থানে বলেন: “কোন রকম অশ্লীলতার কাছেও যেও না তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।” (সূরা আল-আনয়াম: ১৫১) অশ্লীল কাজসমূহের মধ্যে যিনা বা ব্যভিচার সর্বাধিক অশ্লীল কাজ। ইসলাম পর্দার বিধান পালন, দৃষ্টি অবনতকরণ ও পরনারীর সাথে নির্জনে অবস্থান নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ব্যভিচারের পথ ও মাধ্যম রুদ্ধ করে দিয়েছে।
 
যিনার কুফল: যিনা বা ব্যভিচারের কারণে মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বিভিন্ন ধরণের কুফল বয়ে আনে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল:
(১) যিনাকারী বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ কথা অনস্বীকার্য যে, যিনা-ব্যভিচারের মাধ্যমে প্রাণঘাতি বিভিন্ন যৌন রোগ সৃষ্টি হয় যার মধ্যে মরণঘাতি এইডস্ (এইচ, আই, ভি), সিফিলিস, গণোরিয়া, মেহ-প্রমেহ, ক্ষয়রোগ ইত্যাদি প্রধান।
(২) ব্যভিচারের কারণে যৌন সম্ভোগের বৈধ পথ রূদ্ধ হয়ে যায়; এর মাধ্যমে বিবাহ, পরিবার, সন্তানসন্তুতির প্রতি মানুষের অবজ্ঞা সৃষ্টি হয়। ফলত: আবহমান কাল ধরে চলে আসা পরিবার প্রথা ধ্বংস হতে বাধ্য হয়।
(৩) যিনা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যকার বিভেদ উঠায়ে দেয়, এ দুই শ্রেণীর মধ্যে মূল পার্থক্য হল- চতুষ্পদ জন্তুর যৌনসঙ্গমের কোন নির্দিষ্ট পরিসর নেই, কিন্তু মানুষের জন্য এ পরিসর সীমিত। তাই মানুষ যখন যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন এ পরিসরের দেয়াল টপকে মানুষ চতুষ্পদ জন্তুতে পরিণত হয়। এ শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টান্ত দিয়ে আল্লাহ বলেন: “তারা খায় ও আনন্দ উপভোগ করে যেমন আনন্দ উপভোগ করে চতুষ্পদ জানোয়ার।” (সূরা : মুহাম্মাদ: ১২)
(৪) যিনাকারীর লজ্জা থাকে না। যৌন পিপাসা মিটানোর নেশায় সে সাধারণ মানবিক লজ্জা-শরম হারিয়ে ফেলে। বৈধ-অবৈধের মধ্যে কোন পার্থক্য তার কাছে আর থাকে না।
(৫) মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যিনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

যিনাকারীর পার্থিব শাস্তি: যিনাকারীর ধরণ ও শ্রেণীভেদে ইসলামী শরীয়াত বিভিন্ন শাস্তি নির্ধারণ করে। যেমন:
(১) যিনাকারী যদি অবিবাহিত হয় এবং বিবাহ না করে অবৈধ সংগমে রত হয় তবে তাকে একশত বেত্রাঘাত করতে হবে। একদল মুমিন তাদের এ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে বিধায় তারা মানব সমাজে চরম অপমানিত হবে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন: “ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ উভয়কে তোমরা একশত বেত্রাঘাত করবে; আর আল্লাহর বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে তোমাদের অন্তরে যেন তাদের প্রতি দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর মুমিনদের একটি দল অবশ্যই তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।” (সূরা আন্ নূর: ২)
(২) যিনাকারী যদি বিবাহিত হয় তবে তাকে জঘণ্য ও কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। তাকে প্রস্তারাঘাতে (রজম করে) হত্যা করা হবে। যাতে সে নিজ কৃতকর্মের প্রতিফল ভোগ করে এবং তার শরীরের প্রতিটি অংগ ঐরূপ কষ্ট অনুভব করে যেরূপ হারাম কাজে সে আনন্দ অনুভব করেছিল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী রয়েছে; তিনি বলেন: “যদি বয়স্ক নারী ও পুরুষ যিনা করে তবে তাদের উভয়কে প্রস্তরাঘাতে হত্যা কর। তারা যে অর্জন করেছে তার প্রতিফল স্বরূপ।” বিভিন্ন সহিহ হাদীসের মাধ্যমে এ শাস্তি স্বীকৃত। মুসলিম শরীফে মায়াজ বিন মালিকের রজম সংক্রান্ত বোরাইদা (রা) এর হাদীস থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

যিনাকারীর পরকালীন শাস্তি: যিনাকারীর পরকালীন শাস্তি বর্ণনায় হাদীস শরীফে এসেছে; “যিনারাকীরা উলংগ অবস্থায় এমন এক চুলার মধ্যে থাকবে যার অগ্রভাগ হবে অত্যন্ত সংকীর্ণ আর নিম্নভাগ হবে প্রশস্ত উহার তলদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে তাদেরকে তাতে দগ্ধ করা হবে। তারা মাঝে মধ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌছে যাবে; অত:পর আগুন যখন স্তমিত হয়ে যাবে তখন তাতে তারা আবার ফিরে যাবে। আর তাদের সাথে এই আচারণ কেয়ামত পর্যন্ত করা হবে।” (বুখারী)

বৃদ্ধ যিনাকারীর শাস্তি : বাধ্যর্কে উপনীত কোন ব্যক্তি যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তবে তার শাস্তি আরো কঠোর ও নির্মম হবে। আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ তিন ধরণের মানুষের সাথে কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের প্রতি তাকাবেনও না। আর তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি; তারা হল, বৃদ্ধ যিনাকারী, মিথ্যাবাদী বাদশাহ ও অহংকারী ফকীর।”
 
ব্যভিচারিণীর উপার্জন : সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপার্জন হল- ব্যভিচারিণীর ঐ উপার্জন যা সে ব্যভিচারের মাধ্যমে অর্থাৎ দেহ ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করেছে। এ সম্পর্কে রাফে বিন খাদিজ (রা) হাদীস বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “কুকুর বিক্রিত পয়সা নিকৃষ্ট এবং যিনাকারিণীর উপার্জনও নিকৃষ্ট।” (মুসলিম) অতএব যারা দেহ ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করে তাদের এ নিকৃষ্ট উপার্জন সম্পূর্ণভাবে হারাম, এ উপার্জন তাদের কোন উপকারে আসে না; এ অর্থ দিয়ে কোন কিছু করা হলে তা নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যায়।

সমলিঙ্গ ব্যভিচার বা সমকামিতা : যৌন সম্ভোগের এ নিকৃষ্ট পন্থা আল্লাহর নবী লুত আলাইহিস্ সালামের কওম উদ্ভাবন করেন। আল্লাহ বলেন: “লুত তার সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা এমন অশ্লীল কাজকরছ যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ করিনি, তোমরা নারীদের পরিবর্তে পুরুষদের কাছে যেয়ে যৌন বাসনা পুরণ কর; তোমরা রাহাজানী কর এবং নিজেদের মজলিসে গর্হিত কর্ম কর? জওয়াবে তার সম্প্রদায় কেবল এ কথাই বলল, তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে আল্লাহর আযাব আন।” (সূরা আল-আনকাবুত: ২৯) তাদের এ নিকৃষ্ট ও জঘণ্য কাজের কারণে মহান আল্লাহ তাদেরকে চার প্রকার আযাব অবতীর্ণের মাধ্যমে ধ্বংস করেদেন; সে চার প্রকার আযাব ছিল- তাদের দৃষ্টি শক্তি বিলুপ্ত করে দেন, তাদের জনপদ উচু-নিচু করেদেন, তাদের উপর স্তরে স্তরে পাথর নিক্ষেপ করেন এবং তাদের উপর বিকট শব্দ প্রেরণ করেন। ইসলামী শরীয়াতে এ গর্হিত কাজ সম্পূর্ণ হারাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এ অপকর্মে অভ্যস্ত ব্যক্তি যকৃতের প্রদাহে (ঐবঢ়ধঃরঃরং) আক্রান্ত হয়। এ ধরণের অপকর্মের শাস্তি কোন কোন ইমামের মতে যিনার শাস্তির অনুরূপ, আবার কারো কারো মতে উক্ত দু ব্যক্তির চোখ শীশা গালিয়ে অন্ধ করে দিতে হবে।

হস্তমৈথুন বা স্বমেহন: কোন প্রকার যৌন সঙ্গী ছাড়া নিজে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বীর্যস্খলন করাকে স্বমেহন বা হস্তমৈথুন বলা হয়। বর্তমান বিশ্বে স্বমেহনের জন্য বিভিন্ন উপকরণও পাওয়া যায়; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেক্স পুতুল (ঝবী উড়ষষ), ইলেক্ট্রিক লিঙ্গ (ঊষবপঃৎরপ চবহরং) ইত্যাদি। এ সব পদ্ধতিতে যৌন তৃপ্তি লাভ করা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ শ্রেণীর মানুষদেরকে লা’নত দিয়েছেন।

চতুষ্পদ প্রাণীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম : চতুষ্পদ জন্তুর সাথে যৌন সঙ্গম বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত এক বেহায়াপনা। তথাকথিত সভ্যতার নামধারীরা এ বিকৃত রুচির কর্মে রত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ শ্রেণীর মানুষের উপর আল্লাহ ও তার রাসূলের অভিশাপ দিয়েছেন। হাদীসের দাবী অনুযায়ী কোন কুকুর যদি কোন পাত্রে মুখ দেয় তবে ঐ পাত্রটি সাতবার ধুতে হবে এবং কমপক্ষে একবার মাটি দিয়ে ধুতে হবে। অথচ কত নিকৃষ্ট ও বিকৃত রুচির অধিকারী হলে মানুষ সেই কুকুরের সাথে দিনযাপন করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা যায়, চতুষ্পদ জন্তুর সাথে সহবাস মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাইরাসের আমদানী করে যা প্রাণঘাতি রোগের সৃষ্টি করে।

যিনার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী বিষয়সমূহের হুকুম: চলমান বিশ্বে ব্যভিচার ও অশ্লীলতার সমস্ত পথ উন্মুক্ত হয়ে আছে। বস্তুবাদী মানুষ যারা মনে করে এই দুনিয়াই শেষ, যতটুকু পার এখানেই আনন্দ উপভোগ করে যাও তারা মানুষকে বিপদগামী করার জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন, নারী স্বাধীনতার নামে বেহায়াপনার প্রচলনের মাধ্যমে মানব সমাজকে বিশেষত: যুবক শ্রেণীকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা নিত্যনতুন পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করছে। অশ্লীল সিনেমা, নোংরা পত্র-পত্রিকা, পর্ণ সিডি-ভিসিডি, টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইড এসবের কারণে মানুষ যিনার প্রতি বেশী ঝুকে পড়ছে। ইসলাম কোন বিষয় হারাম করলে উক্ত হারাম বিষয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী আনুষঙ্গিক বিষয়ও হারাম করে। অতএব আল্লাহর হারামকৃত যিনার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী সব কিছুই হারাম। যদি কেউ যিনা ও উচ্ছৃঙ্খল যৌন আচরণে উদ্বুদ্ধকারী বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হয় তবে ইসলামী বিধান মতে সে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধী বিবেচিত হবে।

লজ্জাস্থানের হেফাজত জান্নাতের গ্যারান্টি : যারা অবৈধ যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থেকে নিজেদের লজ্জাস্থানকে অবৈধ ব্যবহার থেকে হেফাজত করে তাদের জন্য পরকালে জান্নাতের গ্যারান্টি রয়েছে। মহান আল্লাহ সফলকাম মুমিনদের পরিচয় প্রদান করতে যেয়ে বলেন: “আর তারা নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহকে সংযত রাখে, তাদের স্ত্রী ও তারা যাদের মালিক হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ছাড়া এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। সুতরাং কেউ এ ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমা লংঘণকারী। এবং যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী; আর যারা নিজেদের নামাযে যত্নবান থাকে। তারাই হবে উত্তরাধিকারী; উত্তরাধিকারী হবে ফেরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ী হবে।” (সূরা আল-মুমিন: ৫-১১) সাহাল বিন সায়াদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিস (জিহবার) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিস (যৌনাঙ্গের) নিশ্চয়তা (সঠিক ব্যবহারের) দেবে আমি তার বেহেশতের নিশ্চায়তা দিব।” (বুখারী ও মুসলিম)



ঈমান ধংসের ১০টি কারণ আলোচনা

সোমবার, ডিসেম্বর ০২, ২০১৯ 0
বার দেখা হয়েছে

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার এবং একে আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে কেউ এমন কাজ না করে, যা তাকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। এ ব্যাপারে দাওয়াত দেওয়ার জন্যই আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوْا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ فَمِنْهُمْ مَنْ هَدَى اللهُ وَمِنْهُمْ مَنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلاَلَةُ
-‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত [ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘ত্বাগূত অর্থ হল শয়তান’। ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ)-এর মতে, ইবাদত, অনুসরণ ও আনুগত্যের দিক দিয়ে মা‘বূদ (আল্লাহ)-কে ত্যাগ করে অন্যের ইবাদত করা। ঐ জাতিকেও ত্বাগূত বলা হয়, যারা আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর বিধান ব্যতীত অন্যের তৈরী বিধান দ্বারা ফায়ছালা করে’। দ্রঃ ফাতহুল মাজীদ ১৯ পৃঃ।] কে পরিহার কর। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যককে আল্লাহ হেদায়াত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্য বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল’ (সূরা নাহল: ৩৬)।
 
সুতরাং যারা নবীদের অনুসরণ করবে তারা সৎপথ পাবে। আর যারা তাঁদের অনুসরণ করবে না কিংবা অবাধ্যতা বা বিরোধিতা করবে তারা পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হবে। এছাড়াও এমন কিছু কাজ-কর্ম রয়েছে, যা মুসলমানের ঈমান ধ্বংস করে দেয়, তাকে ‘মুরতাদে’ পরিণত করে তথা ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। মুরতাদ হওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ও ছহীহ হাদীছসমূহে অসংখ্য সাবধান বাণী পরিলক্ষিত হয়। মুরতাদ তথা ধর্মত্যাগীদের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম একমত যে, এটা হত্যাযোগ্য অপরাধ এবং তার মাল-সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকের জন্য বৈধ।
ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার বা ঈমান বিনষ্ট হওয়ার কারণ অনেক। তন্মধ্যে দশটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১. আল্লাহর ইবাদতে শরীক বা অংশীদার স্থাপন করা: আল্লাহর সাথে শিরক বিভিন্নভাবে হতে পারে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল।-

(ক) ইবাদত পাওয়ার একমাত্র উপযুক্ত সত্তা আল্লাহ তা‘আলাকে না মেনে তাঁর সাথে আরো কাউকে যোগ্য বলে মনে করা। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلاَ تَجْعَلْ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ فَتُلْقَى فِيْ جَهَنَّمَ مَلُوْمًا مَدْحُوْرًا
‘আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির কর না। তাহ’লে নিন্দিত ও (আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (সূরা বানী ইসরাঈল:৩৯)
 
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
لاَ تَجْعَلْ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُوْمًا مَخْذُوْلاً
‘আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করো না। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ২২)।
 তিনি আরো বলেন,
وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ لاَ بُرْهَانَ لَهُ بِهِ فَإِنَّمَا حِسَابُهُ عِنْدَ رَبِّهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الْكَافِرُوْنَ

‘যে কেউ আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, যার কোন সনদ তার কাছে নেই, তার হিসাব তার পালনকর্তার নিকটে রয়েছে। নিশ্চয়ই কাফিররা সফলকাম হবে না।’ (সূরা মুমিনূন: ১১৭)

নবীদেরকেও এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করে দিয়ে বলেন,
فَلاَ تَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَكُوْنَ مِنَ الْمُعَذَّبِيْنَ
‘(হে নবী!) আপনি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকবেন না। তাহলে আপনি শাস্তিতে নিপতিত হবেন।’ (সূরা শু‘আরা: ২১৩) উল্লেখিত আয়াতে নবী করীম (সা.)-কে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে। অথচ নবীদের জাহান্নামী হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সুতরাং এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা পীর, অলী-আওলিয়া বা কোন কবরবাসীকে ডাকে, তাদের ইবাদত করে, তারা ঈমান হারাবে এবং জাহান্নামী হবে। কারণ উক্ত কাজ স্পষ্ট শিরক। আর এ ধরনের শিরক মুমিনকে ঈমানহীন করে দেয়।

(খ) মৃতব্যক্তির নিকট কিছু চাওয়া বা অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য দো‘আ করা শিরকে আকবার তথা বড় শিরক। কোন মুমিন যদি এ কাজ করে তবে তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে। কারণ ভাল-মন্দ দেওয়া, না দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
তিনি বলেন,
قُلْ أَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلاَ نَفْعًا وَاللهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ
‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুর ইবাদত কর, যে তোমাদের অপকার ও উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। অথচ আল্লাহ সব শুনেন ও জানেন।’ (সূরা মায়েদাহ ৭৬) আল্লাহর নবী (সা.) নিজেই নিজের উপকার-অপকার করতে পারতেন না বলে কুরআনে প্রমাণ মিলে। সেখানে অন্যদের মাধ্যমে কি করে উপকার আশা করা যায়? 

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ لاَ أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَاءَ اللهُ
‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই কিন্তু আল্লাহ যা চান।’ (আ‘রাফ ১৮৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ لاَ يَمْلِكُوْنَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا
‘(হে নবী!) বলুন, তবে কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন অভিভাবক স্থির করেছ, যারা ভাল ও মন্দের মালিকও নয়’ (সূরা রা‘দ ১৬)।
অন্যত্র তিনি বলেন,

وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ
‘আল্লাহ যদি তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তিনি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনিই তার বান্দার উপর পরাক্রান্ত।’ (সূরা আন‘আম ১৭-১৮)
মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِيْ بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُوْنَ
‘বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি যদি আল্লাহ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাক, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে? বলুন, আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। (প্রকৃত পক্ষে) নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে।’ (সূরা যুমার ৩৮)
অন্যত্র তিনি বলেন,

وَاتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِهِ آلِهَةً لاَ يَخْلُقُوْنَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُوْنَ وَلاَ يَمْلِكُوْنَ لِأَنْفُسِهِمْ ضَرًّا وَلاَ نَفْعًا وَلاَ يَمْلِكُوْنَ مَوْتًا وَلاَ حَيَاةً وَلاَ نُشُوْرًا
‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে কত উপাস্য গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট। তারা নিজেদের ভালও করতে পারে না মন্দও করতে পারে না। আর জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনের মালিকও তারা নয়।’ (সূরা ফুরক্বান: ৩)
 
তিনি আরো বলেন,
إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلاَ تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِيْنَ
‘আপনি মৃতদেরকে ডাক শুনাতে পারবেন না এবং বধিরকেও নয়, যখন তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায়।’ (সূরা নামল ২৭)
 
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَالَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ مَا يَمْلِكُوْنَ مِنْ قِطْمِيْرٍ، إِنْ تَدْعُوْهُمْ لاَ يَسْمَعُوْا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوْا مَا اسْتَجَابُوْا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُوْنَ بِشِرْكِكُمْ وَلاَ يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيْرٍ
-‘তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তুচ্ছ খেজুর আটিরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের সে ডাক শুনে না। শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেয় না। ক্বিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে। বস্তুতঃ আল্লাহর ন্যায় তোমাকে কেউ অবহিত করতে পারবে না।’ (সূরা ফাতির ১৩-১৪)
 
(গ) মৃতব্যক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া বা কাউকে বান্দা নেওয়াজ, গরীবে নেওয়াজ, গাওছুল আযম (সর্বোচ্চ সহযোগিতাকারী) মনে করাও বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَوْثَاناً وَتَخْلُقُوْنَ إِفْكاً إِنَّ الَّذِيْنَ تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ لاَ يَمْلِكُوْنَ لَكُمْ رِزْقاً فَابْتَغُوْا عِنْدَ اللهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوْهُ وَاشْكُرُوْا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ
‘তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে কেবল প্রতিমারই পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহর কাছে রিযিক তালাশ কর, তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা আনকাবূত: ১৭)
আল্লাহ পাক আরো বলেন,

وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُوْ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَنْ لاَّ يَسْتَجِيْبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُوْنَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্তুর পূঁজা করে, যে ক্বিয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারাতো তাদের পূঁজা সম্পর্কেও বেখবর।’ (সূরা আহকাফ: ৫)।
 
কোন কিছু চাইতে হলে কেবল আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ
‘যখন তুমি কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই করবে’। (তিরমিযী হা/২৫১৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৯৫৭)
 
সাহায্য চাওয়ার দু’টি অবস্থা হতে পারে। একটি ‘দো‘আ’ অপরটি ‘ইস্তিগাছা’। সাধারণভাবে সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার নাম হচ্ছে ‘দো‘আ’। আর দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আল্লাহর কাছে দো‘আ করার নাম হচ্ছে ‘ইস্তিগাছা’। সুতরাং ইস্তিগাছা শব্দ সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা এবং তাদের নামের সাথে ‘গাওছুল আযম’ ব্যবহার করা জায়েয নয়। এসব কেবল আল্লাহর জন্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তিনিই দো‘আকারীর ডাকে সাড়া দেন। তিনিই বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। (তাওহীদের মর্মকথা পৃঃ ৭৩ -টীকা) (চলবে..)

(ঘ) আল্লাহ ব্যতীত মৃত বা জীবিত কারো নামে মানত করা শিরক। গায়রুল্লাহ নামে মানত করলে ঐ মানত পূর্ণ করা যাবে না।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন,
مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيْعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِىَ اللهَ فَلاَ يَعْصِهِ
‘ যে ব্যক্তি আল্লাহ আনুগত্যের কাজে মানত করে, সে যেন তা পূরা করার মাধ্যমে তার আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মানত করে, সে যেন তার নাফরমানী না করে। (অর্থাৎ মানত পূরা না করে)। (বুখারী হা/৬৬৯৬) নযর বা মানত করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হবে, যদি তা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়। আর আল্লাহর নামে মানত করলে তা আদায় করা ওয়াজিব। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মানত করলে তা শিরক হবে। বিধায় তা পূর্ণ করা হারাম। এরূপ মানতের নিয়ত করে থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে এবং তওবা করতে হবে। (ফাতহুল মাজীদ ১৩৬ পৃঃ)
অনেকে কবরে মোমবাতি, তেল, আগরবাতি, টাকা-পয়সা, গরু-খাসি, মোরগ-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি মানত করে। তারা মনে করে এর মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য হাছিল হবে, রোগমুক্তি হবে, হারানো ব্যক্তিকে ফিরে পাবে, মালের নিরাপত্তা লাভ হবে, নিঃসন্তানের সন্তান হবে ইত্যাদি। এসবই শিরক-এর অন্তর্ভুক্ত। নবীগণ সবচেয়ে সম্মানী ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কবরসমূহে কোন নযরানা, মানত দেওয়া হয় না। এ ধরনের মানত, নযরানা তারা কবরবাসীর সম্মান ও বরকতের জন্যই করে থাকে এবং তাদের ধারণা এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হবে।

যেমন মক্কার মুশরিকদের ধারণা ছিল। তারা বলত,
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللهِ زُلْفَى
‘তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দিবে বলেই আমরা তাদের ইবাদত করি।’ (সূরা যুমার: ৩) এমনকি যেখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে পূজা করা হত সেখানেও আল্লাহর নামে মানত করা হারাম। বর্তমানে সেখানে পূজা চলুক বা না চলুক। ছাবিত বিন আয-যাহহাক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসূলের যুগে ‘বুয়ানা’ নামক স্থানে একটি উট কুরবানী করার মানত করল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে স্থানে এমন কোন মূর্তি ছিল কি, জাহেলী যুগে যার পূজা করা হত’? ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, না। তিনি বললেন ‘সে স্থানে কি তাদের কোন উৎসব বা মেলা অনুষ্ঠিত হত’? তাঁরা বললেন, না। তখন রাসূল (সা.) বললেন, ‘তুমি তোমার মানত পূর্ণ কর। কেননা আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে মানত পূর্ণ করা যাবে না। আদম সন্তান যা করতে সক্ষম নয়, এমন মানতও পুরা করা যাবে না’। (আবূদাঊদ হা/৩৩১৫; ইবনু মাজাহ হা/২১৩০, সনদ ছহীহ)

(ঙ) যে স্থানে মুশরিকরা তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করে সে স্থানটি শিরকের নিদর্শনে পরিণত হয়। কারণ এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেব-দেবীর নৈকট্য লাভ করা এবং আল্লাহর সাথে শরীক করা। একারণেই যদি কোন মুসলমান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তেও উক্ত স্থানে পশু যবেহ করে, তবুও তা হবে মুশরিকদের অনুরূপ কাজ। মুশরিকদের দৃষ্টিতে তাদের পুণ্যময় স্থানের অংশীদার। মুশরিকদের কোন কাজের সাথে বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ মিল তাদের প্রতি আসক্তিরই নামান্তর। (তাওহীদের মর্মকথা, ৬৬ পৃঃ টীকা দ্রঃ) মৃতব্যক্তির নামে কোন কিছু যবেহ করাও হারাম। মহান আল্লাহ বলেন,
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيْرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ
‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃতপ্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত, যেসব জন্তু আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়’। একটু পরেই বলেন,
وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوْا بِالْأَزْلَامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ
‘যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে যবেহ করা হয় এবং যা ভাগ্য নির্ধারক শর দ্বারা বণ্টন করা হয় (তাও হারাম)। এসব পাপ কাজ’ (সূরা মায়েদাহ: ৩)
এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেন,
لَعَنَ اللهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَهُ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ آوَى مُحْدِثًا وَلَعَنَ اللهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الأَرْضِ
(১) যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লা‘নত
(২) যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু-প্রাণী যবেহ করে তার উপর আল্লাহর লা‘নত
(৩) যে ব্যক্তি কোন বিদ‘আতীকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লা‘নত
(৪) যে ব্যক্তি জমির সীমানা পরিবর্তন করে, তার উপর আল্লাহর লা’নত’। (মুসলিম হা/১৯৭৮; মিশকাত হা/৪০৭০)


উল্লিখিত বিষয়সমূহ সুস্পষ্ট রূপে শিরকে আকবর, যা থেকে বিরত থাকা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তা‘আলা শিরকের ব্যাপারে বলেন,
إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً بَعِيْدًا
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা শিরকের গুনাহ ক্ষমা করবেন না। তবে অন্যান্য গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।’ (সূরা নিসা: ১১৬) অন্যত্র তিনি বলেন,
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ
‘নিশ্চয়ই যে আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার আবাসস্থল হয় জাহান্নাম। আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা মায়েদাহ: ৭২)

ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
مَنْ مَاتَ وَهْوَ يَدْعُو مِنْ دُوْنِ اللهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’। (বুখারী হা/৪৪৯৭)

আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ، وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلاَتِ-
‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাক। ছাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি? তিনি জবাবে বললেন,
(১) ‘আল্লাহ সাথে শিরক করা,
(২) যাদু করা,
(৩) অন্যায়ভাবে এমন কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন,
(৪) সূদ খাওয়া,
(৫) ইয়াতীমের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করা,
(৬) ধর্মযুদ্ধ কালীন সময়ে (রণক্ষেত্র) থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করা,
(৭) সতী-সাধ্বী উদাসীনা মুমিন নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা।’ (বুখারী হা/৬৮৫৭; মুসলিম হা/৮৯)

আবু বকর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ قُلْنَا بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ. قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللهِ وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ
‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহসমূহের কথা বলব না? ছাহাবীগণ বললেন, নিশ্চয়ই বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া…’। (বুখারী হা/৬৯৭৬; মুসলিম হা/৮৭)
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
مَنْ لَقِىَ اللهَ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارِ
‘যে ব্যক্তি কোন শিরক করা ব্যতীত আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে (মৃত্যুবরণ করবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি শিরক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’। (মুসলিম হা/৯৩)

আল্লাহ তা‘আলা নবী করীম (সা.)-কেও শিরক থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বললেন এভাবে,
لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ
‘যদি তুমি শিরক কর, তবে তোমার সমস্ত আমল অবশ্যই বাতিল হয়ে যাবে এবং নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সূরা যুমার: ৬৫)
আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِىْ غَيْرِىْ تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ

১. ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করে যে আমলে আমার সাথে অন্যকে শরীক করেছে, এমন আমল ও যাকে সে শরীক স্থাপন করেছে, আমি উভয়ই প্রত্যাখ্যান করি। (মুসলিম হা/৭৬৬৬; মিশকাত হা/৫৩১৫)

২. যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং বান্দার মাঝে কাউকে মাধ্যম তৈরী করে তাদেরকে ডাকে এবং তাদের নিকট শাফা‘আত কামনা করে, সে মুরতাদ হয়ে যাবে। কারণ শাফা‘আতের একমাত্র মালিক আল্লাহ। তিনি বলেন,
قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيْعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
‘বলুন, সমস্ত সুফারিশ আল্লাহরই আয়াত্ত্বাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য।’ (সূরা যুমার: ৪৪)
এক শ্রেণীর লোক আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের ইবাদত করে এবং তাদেরকে সুফারিশকারী হিসাবে গ্রহণ করে। অথচ তাদের সুফারিশ করার কোন ক্ষমতা নেই। আল্লাহ বলেন,
وَيَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُوْلُوْنَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللهِ قُلْ أَتُنَبِّئُوْنَ اللهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الْأَرْضِ
‘তারা উপাসনা করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর, যা না তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে, না পারে উপকার করতে এবং তারা বলে, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুফারিশকারী। তুমি বল, তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যে বিষয়ে তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনের মাঝে।’ (সূরা ইউনুস: ১৮)
আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করা কুফরী। যেমন কোন পীর, অলী-আউলিয়া, জীবিত বা মৃত কোন বুযুর্গ বা বিশেষ কোন ব্যক্তির উপর ভরসা করে কোন কাজ শুরু করা। কেউ যদি গুরু সহায়, খাজা ভরসা, ফাতেমা সহায়, রাসূল ভরসা ইত্যাদি বলে তাহলে শিরক হবে। একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা রাখতে হবে, অন্যথা ঈমান বিনষ্ট হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে ঈমানদারদের বিশেষ গুণ হিসাবে তাঁর উপর ভরসা রাখার কথা বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ ‘যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তবে আল্লাহর উপর ভরসা কর’ (মায়েদাহ ২৩)। তিনি আরও বলেন, إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُسْلِمِيْنَ ‘যদি তোমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেই থাক এবং যদি মুসলিম হয়ে থাক, তবে আল্লাহর উপর ভরসা কর’ (ইউনুস ৮৪)। মহান আল্লাহ নবী করীম (সা.)-কে শিখিয়ে দিয়েছেন, قُلْ حَسْبِيَ اللهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُوْنَ ‘বলুন, (হে নবী!) আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে’ (যুমার ৩৮)।

৩. যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি মুশরিকদেরকে কাফির মনে না করে
অথবা তাদের কুফরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে অথবা তাদের মতবাদসমূহ সঠিক মনে করে। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُشْرِكُوْنَ نَجَسٌ ‘নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র’ (তওবা ২৮)। মুশরিক সম্প্রদায় অপবিত্র হওয়ার পর কি করে তাদের মতবাদ গ্রহণীয় হতে পারে? তিনি আরও বলেন, أَنَّ اللهَ بَرِيْءٌ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ وَرَسُوْلُهُ ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) মুশরিকদের থেকে মুক্ত’ (তওবা ৩)। অর্থাৎ মুশরিকদের ব্যাপারে আল্লাহর কোন দায়দায়িত্ব নেই। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أُوْلَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ ‘নিশ্চয়ই আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে এবং শিরক করে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং এরাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট সৃষ্টি’ (বায়্যিনাহ ৬)। যার কারণেই আল্লাহ এদের সাথে বিবাহ পর্যন্ত হারাম ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلاَ تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِيْنَ حَتَّى يُؤْمِنُوْا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُوْلَئِكَ يَدْعُوْنَ إِلَى النَّارِ-
‘ তোমরা মুশরিক নারীদেরকে বিবাহ কর না, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করে। অবশ্য মুসলিম ক্রীতদাসী মুশরিক নারী অপেক্ষা উত্তম, যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভাল লাগে। তোমরা কোন মুশরিক পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যে পর্যন্ত না সে ঈমান আনে। একজন মুসলমান ক্রীতদাসও একজন মুশরিকের তুলনায় অনেক ভাল, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও। তারা জাহান্নামের দিকে আহবান করে’ (বাক্বারাহ ২২১)।

৪. যদি কোন মুসলিম নবী করীম (সা.)-এর দেখানো পথ ব্যতীত অন্য কোন পথ পরিপূর্ণ অথবা ইসলামী হুকুমাত বা বিধান ব্যতীত অন্য কারো তৈরী হুকুমাত উত্তম মনে করে, তবে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস করে যে, মানুষের তৈরী আইন ও বিধান ইসলামী শরী‘আত থেকে উত্তম বা ইসলামের সমান, মানব সৃষ্ট বিধান দিয়ে বিচার-ফায়ছালা জায়েয, ইসলামী হুকুমাত বিংশ শতাব্দীর জন্য প্রযোজ্য নয়, ইসলামই মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ, ইসলামের সাথে পরকালীন সম্পর্ক, দুনিয়াবী কোন সম্পর্ক নেই- ওলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে উক্ত বিষয়গুলো কুফরীর শামিল। কারণ এটা হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করার হীন প্রচেষ্টা মাত্র। [ফাতাওয়া আল-মারআতুল মুসলিমা ১/১৩৭ পৃঃ] আল্লাহ বলেন, اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘তারা (ইহুদী-খ্রিষ্টানরা) তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে আল্লাহ ব্যতিরেকে’ (তওবা ৩১)।
ইহুদী-খ্রিষ্টান পন্ডিত ও ধর্ম জাযকদের মা‘বূদ (প্রভু) সাব্যস্ত করা অর্থ তাদেরকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করা নয়, বরং তারা সর্বাবস্থায় যাজক শ্রেণীর আনুগত্য করে থাকে। যদিও তারা আল্লাহ প্রদত্ত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে দেয়। এধরনের আনুগত্য তাদেরকে প্রভু সাব্যস্ত করারই নামান্তর। আর এটা হল প্রকাশ্য কুফরী। [তাফসীরে মা‘রেফুল কোরআন ৫৬৭ পৃঃ]
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়ছালা পরিত্যাগ করা কোন মুমিনের জন্য জায়েয হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُبِيْنًا-
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার নারী-পুরুষের সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার নেই। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে’ (আহযাব ৩৬)। সুতরাং আল্লাহ কর্তৃক কোন বিষয় নির্ধারিত হলে তা পরিবর্তন করার এখতিয়ার কারও নেই।

৫. যদি কোন মুসলমান আল্লাহর নবী (সা.)-এর আনিত বিধানের কোন অংশকে অপসন্দ করে তবে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে, যদিও সে ঐ বিষয়ে আমল করে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ، ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوْا مَا أَنْزَلَ اللهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ
‘আর যারা কাফির তাদের জন্য রয়েছে দুর্গতি এবং তিনি তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দিবেন। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তা পসন্দ করে না। অতএব তাদের কর্মসমূহ আল্লাহ ব্যর্থ করে দিবেন’। (মুহাম্মাদ ৮-৯)
এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, আমলসমূহ বাতিল হওয়ার অন্যতম কারণ আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় অপসন্দ করা। উক্ত বিষয় আমল করলেও অপসন্দ করার কারণে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।

মহান আল্লাহ বলেন,
لَقَدِ ابْتَغَوُا الْفِتْنَةَ مِنْ قَبْلُ وَقَلَّبُوْا لَكَ الْأُمُوْرَ حَتَّى جَاءَ الْحَقُّ وَظَهَرَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَارِهُوْنَ
তারা পূর্ব থেকেই বিভেদ সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানে ছিল এবং আপনার কার্যসমূহ উলট-পালট করে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সত্য প্রতিশ্রুতি এসে গেল এবং জয়ী হল আল্লাহর হুকুম, যে অবস্থায় তারা অপসন্দ করল’। (সূরা তওবা: ৪৮)

৬. যদি কোন মুসলিম মুহাম্মাদ (সা.) আনিত ধর্মের কোন বিষয়ে অথবা ধর্মীয় ছওয়াব বা শাস্তির ব্যাপারে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে তবে সেও কাফির হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ أَبِاللهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُوْلِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُوْنَ، لاَ تَعْتَذِرُوْا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيْمَانِكُمْ
‘আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে তাঁর হুকুম-আহকামের সাথে এবং তাঁর রাসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? ছলনা কর না, ঈমান আনার পর তোমরা যে কাফির হয়ে গেছ’ (সূরা তওবা ৬৫-৬৬)।
যারা ইসলাম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে তাদের আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের কোন আশা নেই। আল্লাহ বলেন, فَنَذَرُ الَّذِيْنَ لاَ يَرْجُوْنَ لِقَاءَنَا فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ ‘সুতরাং যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে না, আমি তাদেরকে তাদের দুষ্টামীতে ব্যতিব্যস্ত করে রাখি’। (সূরা ইউনুস: ১১)

এ ধরনের লোকদের সাথে উঠাবসা, চলাফেরা ত্যাগ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা উক্ত আচরণ পরিত্যাগ না করে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلاَ تَقْعُدُوْا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوْضُوْا فِيْ حَدِيْثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ إِنَّ اللهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِيْنَ وَالْكَافِرِيْنَ فِيْ جَهَنَّمَ جَمِيْعًا-
‘আর কুরআনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি এই হুকুম জারী করে দিয়েছেন যে, যখন আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও বিদ্রূপ করতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। অন্যথা তোমরাও তাদেরই মত হয়ে যাবে। আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদেরকে জাহান্নামে একই জায়গায় সমবেত করবেন।’ (সূরা নিসা ১৪০)

এরূপ ব্যক্তিদের আল্লাহ নির্বোধ বলে ঘোষণা করেন এবং তাদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করতেও নিষেধ করেন। তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا لاَ تَتَّخِذُوا الَّذِيْنَ اتَّخَذُوْا دِيْنَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِيْنَ أُوتُوْا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ وَاتَّقُوْا اللهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ، وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى الصَّلاَةِ اتَّخَذُوْهَا هُزُوًا وَلَعِبًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لاَ يَعْقِلُوْنَ-
‘হে মুমিনগণ! আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও। আর যখন তোমরা ছালাতের জন্য আহ্বান কর, তখন তারা একে উপহাস ও খেলা মনে করে। কারণ তারা নির্বোধ’। (সূরা মায়েদাহ ৫৭-৫৮)

উপহাস করা মুনাফিকদের আলামত হিসাবে আল্লাহ রাববুল আলামীন উল্লেখ করেন,
وَإِذَا لَقُوا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قَالُوْا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِيْنِهِمْ قَالُوْا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ
‘আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি, আমরাতো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র’। (সূরা বাক্বারাহ ১৪) উল্লিখিত আয়াতসমূহে ধর্মে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও উপহাসকারীকে জাহান্নামী, নির্বোধ ও মুনাফিকদের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং এদের সাথে চলাফেরা, উঠাবসাও সম্পূণরূপে নিষেধ করা হয়েছে।
 
৭. যদি কেউ যাদুর মাধ্যমে ভাল কিছু অর্জন বা মন্দ কিছু বর্জন করতে চায় অথবা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক স্থাপন বা ভাঙ্গন ধরাতে গোপন, প্রকাশ্য, মন্ত্র-তন্ত্র করতে চায় অথবা কারো সাথে (ছেলে-মেয়ে) সম্পর্ক স্থাপন বা বন্ধুত্বে ফাঁটল ধরাতে চায় তবে তা সম্পূণরূপে কুফরী। যে ব্যক্তি এমন কাজ করবে এবং যে ব্যক্তি এর প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে উভয়ই কুফরী করল।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوْا يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيْمِ، وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلاَتِ
‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাক। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি? তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সাথে শিরক করা (২) যাদু করা (৩) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, যা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন (৪) সূদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা (৬) যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা (৭) সতী-সাধ্বী মুমিন মহিলাকে অপবাদ দেয়া’। [বুখারী হা/২৭৬৬; মুসলিম হা/২৭২; মিশকাত হা/৫২]
আল্লাহ রাববুল আলামীন যাদুকে কুফরী ও শয়তানী শিক্ষা হিসাবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, وَلَكِنَّ الشَّيَاطِيْنَ كَفَرُوْا يُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ السِّحْرَ ‘কিন্তু শয়তানরাই কুফরী করেছিল তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত’ (সূরা বাক্বারাহ ১০২)।
অত্র আয়াতের শেষের দিকে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ عَلِمُوْا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلاَقٍ ‘তারা ভালরূপেই জানে যে, যে কেউ যাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই।’ (বাক্বারাহ ১০২) [চলবে..]



ফটো গ্যালারী

1/6
ওহুদ যুদ্ধ - হযরত মহাম্মদ (সা:) এর বিপ্লবী জীবন
2/6
মুসলিম নারীর বিধান
3/6
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা
4 / 6
ইসলামীক জিজ্ঞাসাঃ লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
5/6
মসজিদে নববী যিয়ারতের কিছু আদব-কায়দা
6/6
উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব

Islam-icon Profile.png