আনাস (রা.)-এর যখন দশ বছর বয়স, তখন তার মা উম্মে সুলাইম তাকে নিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে আগমন করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার ছেলে আনাস, আজ থেকে সে আপনার খেদমত করবে। তখন থেকেই আনাস (রা.) নিয়মিত রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমার আম্মাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তিনি আমাকে উত্তমভাবে লালন-পালন করেছেন। ’
যুদ্ধাহতদের সেবা-শুশ্রুষায় উম্মে সুলাইম
আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা.) উম্মে সুলাইম ও কিছু আনসারি নারীকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। যাতে তারা যুদ্ধাহতদের সেবা-শুশ্রুষার পাশাপাশি পানি পান করাতে পারে।
হুনাইনের যুদ্ধে উম্মে সুলাইম খঞ্জর হাতে রণাঙ্গনের দিকে এগিয়ে যান। আবু তালহা (রা.) বলে ওঠেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এই যে উম্মে সুলাইম, তার হাতে খঞ্জর!’ উম্মে সুলাইম বললেন, ‘কোনো মুশরিক আমার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করলে আমি এটা দিয়ে তার নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলব। ’
হাদিস, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থগুলোতে তার বীরত্ব, সাহসিকতা, ধার্মিকতা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তবে তিনি কষ্ট-দুঃখের সময় ধৈর্য্যশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, ইতিহাসের পাতায় তার নজির খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।
তার ধৈর্য্যশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার কথা...
ইমাম বুখারি (রহ.) তার বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ সহিহ বুখারিতে তার এই ঘটনার শিরোনাম করেছেন এভাবে, ‘মুসিবতের সময় যিনি তার দুঃখ-ব্যথা প্রকাশ করেন না। ’ তার সেই ঘটনার বিবরণ এরকম—
আবু তালহার সঙ্গে উম্মে সুলাইমের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের খুব সুন্দর ফুটফুটে একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। তার নাম রাখা হয় উমাইর। তার ছোট একটি পাখিও ছিল, যার সঙ্গে সে খেলা করতো। রাসুল (সা.) মাঝে মাঝে উমাইরের সঙ্গে কৌতুক করতেন। তাকে বলতেন, ‘হে উমাইর! তোমার হয়েছে তোমার বুলবুলির!’
আবু তালহা (রা.) তাকে অত্যধিক ভালবাসতেন। একদিন উমাইর অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবু তালহা (রা.) এ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনকি অস্থির হয়ে পড়লেন। তার অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। এক বিকেলে তিনি ঘর থেকে বের হলেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থতার কারণে তার ছেলের মৃত্যু হয়। এ দিকে উম্মে সুলাইম (রা.) মৃত্যুর পর ছেলেকে গোসল করান। কাফন পরিয়ে তার গায়ে সুগন্ধি মাখেন। কাপড়-চোপড় দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে ঘরের এক কোণে সুন্দরভাবে শুইয়ে রাখেন। এরপর আনাস (রা.)-কে পাঠিয়ে আবু তালহা (রা.)-কে ডেকে পাঠান। তবে তাকে বলে দিলেন, আবু তালহাকে যেন ছেলের মৃত্যুসংবাদ না জানায়।
আবু তালহা (রা.) সেদিন রোজা রেখেছিলেন। উম্মে সুলাইম (রা.) তার জন্য খাবার তৈরি করেন। তিনি ঘরে ফিরেই সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করেন। উম্মে সুলাইম বললেন, সে এখন আগের চেয়ে শান্ত। ক্লান্ত-শ্রান্ত স্বামীকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ তৎক্ষণাৎ জানালেন না। ঘরের লোকদেরও নিষেধ করে রেখেছিলেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেন এ সংবাদ তাকে না জানায়।
আবু তালহা (রা.) তার কথা শুনে ভেবেছিলেন, ছেলে সুস্থ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাই তিনিও নিশ্চিন্ত মনে রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলেন। ভোররাতে গোসলও করলেন।
আবু তালহা (রা.) ঘর থেকে বের হওয়ার আগে উম্মে সুলাইম (রা.) তাকে বললেন, ‘বলুন কেউ যদি কারো কাছে কোনো কিছু আমানত রাখে, অতঃপর তার কাছে তা ফেরত চায়; তবে তার কি অধিকার আছে—তা ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে আটকে রাখার?
আবু তালহা (রা.) বললেন, না তার এ অধিকার নেই। উম্মে সুলাইম (রা.) এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনার পুত্রের ব্যাপারে সবর করুন। আল্লাহ তাআলা তাকে আমাদের কাছে আমানত রেখেছিলেন। এখন তিনি ফিরিয়ে নিয়েছেন।
আবু তালহা (রা.) এতে রাগান্বিত হলেন। রাতের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে স্ত্রীর নামে অভিযোগ করেন। রাসুল (সা.) তাদের ঘটনা শুনে বিমুগ্ধ হয়ে দুআ করলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের এ রাতে বরকত দান করুন। ’ তারপর আল্লাহ তাআলা তাদের আবদুল্লাহ নামে আরেকটি পুত্র সন্তান দান করেন। সেই আবদুল্লাহ ইবনে আবু তালহাকে পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সাত পুত্র দান করেন, যাদের প্রত্যেকেই কোরআনের আলেম হয়েছেন। *(বুখারি, হাদিস: ১৩০১; মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১২০৮; ফাতহুল বারি: ৩/২০১; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/৪৩১-৪৩২)*
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন