ইদানিং রাজধানীতে অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ যা সবারই
ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত জুলাই হতে অক্টোবর এই সময়টি ডেঙ্গুর
মৌসুম হিসাবে গণ্য করা হয়। তাই এসময়টিতে দরকার বাড়তি সচেতনতা। চলুন ডেঙ্গুর
কারণ লক্ষণ ও প্রতিকার সন্মন্ধে বিস্তারিত জেনে নিই।
ডেঙ্গু কিভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু
ভাইরাস বহনকারী এডিস ইজিপ্টাই জাতীয় মশা কামড় দিলে প্রধানত ডেঙ্গুজ্বর হয়ে
থাকে। কোন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত লোককে এ জাতীয় মশায় কামড়ায় এবং
পরবর্তীতে ঐ একই মশা যদি কোন সুস্থ মানুষকে কামড়ায় তাহলে উক্ত সুস্থ
ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে ভোগার সম্ভাবনা অনেক বেশী। সাধারণত জীবাণু বহনকারী
এডিস মশা কোনো মানুষকে কামড়ানোর চার হতে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত
হয়ে থাকে। এভাবে ক্রমাগত মশার মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে রোগটি ছড়াতে থাকে।
কাদের ডেঙ্গু বেশি হয়?
গ্রামে
বসবাসকারী লোকজনের চেয়ে শহরের অভিজাত এলাকায় যেখানে বড় বড় দালান কোঠা
রয়েছে সেখানে এর প্রাদুর্ভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর প্রধান কারণ হলো শরের
দালান কোঠার ছাদে ফুলের টবে কিংবা ড্রেনে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে
যেখানে অনায়াসে এসব মশা দিম পারে এবং বংশ বিস্তার করে থাকে। ডেঙ্গু বড়দের
তুলনায় ছোট শিশুদের বেশী হয়। যাদের আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার
ইতিহাস আছে তাদের পরবর্তী সময়ে রোগটি হলে তাতে রোগীর অবস্থা আরও মারাত্মক
হওয়ার ঝুঁকি থাকে বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সমূহঃ
ডেঙ্গু
জ্বর প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। (১) ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর এবং (২)
হেমোরেজিক ফিভার। দুই ধরনের জ্বরের লক্ষণ ও তীব্রতা আলাদা ধরনের। নিম্নে
প্রকারভেদে রোগটির লক্ষণ ও তীব্রতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরঃ
ক্লাসিক্যাল
ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরে সাধারণত তীব্র জ্বরের সাথে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে।
কোন কোন সময় জ্বরের মাত্রা ১০৫ ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। এই ব্যথা বিশেষ করে
শরীরের বিভিন্ন জোড়ায় জোড়ায় যেমন কোমর, পিঠের অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে
তীব্র হয়ে থাকে। এছাড়া মাথায় ও চোখের পেছনে তিব্র ব্যথা হতে পারে। অনেক সময়
ব্যথার মাত্রা এত তীব্র আকার ধারণ করে যে মনে হয় যেন হাঁড় ভেঙে যাচ্ছে।
এজন্য এই জ্বরকে ‘ব্রেক বোন ফিভার’ও বলা হয়। এছাড়া জ্বরের
চার বা পাঁচদিনের সময় সারা শরীরে লালচে দানা যুক্ত অ্যালার্জি বা ঘামাচির
মতো দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি রোগীর বমি বমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। এতে
রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করতে পারে। এছাড়া রোগীর খাওয়া দাওয়ার রুচি অনেক
কমে যায়। কোনো কোনো রোগীর বেলায় জ্বর দুই বা তিনদিন পর আবার আসে বলে একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ ও বলা হয়।
২। হেমোরেজিক ডেঙ্গু ফিভারঃ
হেমোরেজিক
ডেঙ্গু ফিভার হলে অবস্থাটা আরও জটিল আকার ধারণ করে। এইরুপ জ্বরে শরীরের
বিভিন্ন অংশ থেকে যেমন চামড়ার নিচ, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে, নাক,
মুখ, দাঁতের মাড়ি কিংবা কফের সাথে রক্ত বমি হতে পারে। এছাড়া কালো পায়খানা
সহ পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বের হতে পারে।, মেয়েদের ক্ষেত্রে অসময়ে
ঋতুস্রাব হতে পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ অনেকদিন পর্যন্ত অব্যাহত
থাকতে পারে। এই রোগ হলে অনেকের বুকে পানি, পেটে পানি জমা ইত্যাদি উপসর্গ
দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস হতে পারে।
আবার কিডনি আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউরের মত ঘটনা ঘটতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের
ভয়াভহ একটি রূপ হচ্ছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম যাতে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যেতে
পারে। অন্যান্য জতিলতার মধ্যে নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া,
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, রোগী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে
যাওয়া সহ মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ডাক্তারের কাছে কখন যাওয়া উচিত?
ডেঙ্গু
জ্বর নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তাই বিভিন্ন উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসকের
পরামর্শ নিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা ভালো। যেসব গুরুত্বপূর্ণ
উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত সেগুলো হলো-
- শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হতে থাকলে।
- রক্ত পরীক্ষায় প্লাটিলেটের মাত্রা কম পাওয়া গেলে
- শ্বাস নিতে কষ্ট হলে।
- পেটে পানি এসে ফুলে গেলে।
- প্রস্রাবের মাত্রা কমে গেলে।
- শরীরে জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে।
- দেহে অতিরিক্ত মাত্রায় ক্লান্তিভাব বা দুর্বলতা দেখা দিলে।
- পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হলে কিংবা বমি হলে।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা কিভাবে করবেন?
কেউ
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা না করালেও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে রোগী
সাধারণত ৫-১০ দিনের মধ্যে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে এসময় যাতে ডেঙ্গুজনিত
কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয় এজন্য রোগীকে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে
সেভাবে চলতে হবে। এজন্য ডেঙ্গুর চিকিৎসায় নিম্নলিখিত চিকিৎসা ব্যবস্থা
গ্রহণ করা যায়।
- সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে বিশ্রামে থাকতে হবে।
- ডেঙ্গু হলে প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে।
- রোগী যদি মুখ দিয়ে খেতে না পারে তাহলে তার শিরাপথে স্যালাইন দিতে হবে।
- রোগীর জ্বর বেশী হয়ে গেলে কমানোর জন্য শুধুম প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধই দেওয়া যাবে। তবে কোন প্রকারেই এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথানাশক খাওয়ানো যাবে না। এসব ওষুধ খেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
- এছাড়া জ্বর কমাতে ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছানো যেতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়:
ডেঙ্গু
জ্বরের বাহক যেহেতু মশা তাই এই বাহকের প্রতিরোধের মাধ্যমেই এই রোগের
প্রতিরোধ সম্ভব। এজন্য ডেঙ্গুবাহী মশার বংশবিস্তার রোধের পাশাপাশি মশা যেন
আপনাকে কামড়াতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এডিস মশা যেহেতু অভিজাত
এলাকায়, বড় বড়, সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় বসবাস করে ও সেখানে থাকা স্বচ্ছ
পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে তাই এসব আবাসস্থল নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এ রোগের
বিস্তার রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ। এজন্য নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি নজর দেওয়া
উচিত।
- বাড়ির আশপাশের ঝোঁপঝাড়, জলাশয় কিংবা জঙ্গল থাকলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে হবে।
- এডিস মশা যেহেতু স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে তাই বাসার ফুলদানি, কোন অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, কিংবা পরিত্যক্ত টায়ার থাকলে সেগুলি দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।
- লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ঘরের বাথরুম বা অন্য কোথাও পাঁচদিনের বেশি পানি জমানো অবস্থায় না থাকে যেমন অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ারকন্ডিশনারের নিচের অংশ ইত্যাদি।
- এডিস জাতীয় মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়িয়ে থাকে। এজন্য দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড় ঢেকে রাখতে, প্রয়োজন হলে মসকুইটো রিপেলেন্ট লাগানো যেতে পারে।
- মশার আক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘরের দরজা ও জানালায় মশারীর নেট লাগাতে হবে।
- দিনের বেলায় ঘুমালে অবশ্যই মশারি টাঙ্গিয়ে বা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে।
- বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার সময় হাফ প্যান্ট না পরিয়ে তাদের ফুল প্যান্ট পরিয়ে তারপর স্কুলে পাঠানো উচিত।
- মশা নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সাথে মশার কামড় থেকে বাচতে দিনে কিংবা রাতে মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- সর্বপরি কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে উক্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যেন কোনো মশা তাঁকে কামড়াতে না পারে।
আমাদের
প্রকৃতি থেকে ডেঙ্গু জ্বরের মশা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই মশা
প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশ যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে সবারই খেয়াল
রাখতে হবে। নিয়মিত মশারী ব্যাবহার করা একদম ভোলা যাবেনা। একমাত্র সচেতনতা ও
প্রতিরোধের মাধ্যমেই এই যন্ত্রণাময় রোগের হাত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন