সেই হতবিহ্বল করা দিনের কথা শুনেছ? যেদিন কিছু চেহারা থাকবে ভয়ে অবনত। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত আগুনে। ফুটন্ত পানির কুয়া থেকে পানি পান করতে দেওয়া হবে। বিষাক্ত কাটা ছাড়া আর কোনো খাবার পাবে না। যা কোনো পুষ্টি দেয় না, ক্ষুধাও মেটায় না। —আল-গাশিয়াহ ১-৭
সেই হতবিহ্বল করা দিনের কথা শুনেছ?
আমরা যখন রাতে বিছানায় শুয়ে দেখি সবকিছু ভীষণ দুলতে শুরু করেছে, বুঝতে পারি যে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে। তখন আমরা আতংকে ছোটাছুটি শুরু করে দেই। এক ভূমিকম্পই আমাদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়। কয়েকদিন আতংকে কাটে কখন ভূমিকম্পের বাকিটুকু হবে। সারাদিন মাথায় চিন্তা ঘুরতে থাকে: আরেকবার ভূমিকম্প হলে বাড়ি টিকে থাকবে? সব সম্পত্তি ঠিকমত বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে? ছেলেমেয়েদের কোনো অসুবিধা হবে না তো? ঠিকমত নামাজ পড়া হচ্ছে? আমার কবর কি বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই হয়ে যাবে?

এক মামুলি ভূমিকম্প আমাদের হতবিহবল করে দেয়। সারাদিন মাথায় ভূমিকম্পের চিন্তা ঘুরতে থাকে। ব্যাংক ব্যালেন্সগুলো বার বার দেখে হিসেব করে নেই মোট কত টাকা আছে। জমির দলিলগুলো জায়গা মত আছে কিনা দেখি। গয়নাগুলোকে বের করে দেখি সব ঠিকঠাক আছে কিনা। একটা ভূমিকম্প কয়েকদিনের জন্য হলেও আমাদের চিন্তাভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
আর কিয়ামতের দিন হবে এক কল্পনাতীত ভূমিকম্প। এমন ভূমিকম্প যে পাহাড়গুলো বিস্ফোরিত হয়ে ধুলো হয়ে ভেসে বেড়াবে। আকাশ ফেটে যাবে। সমুদ্রে আগুন ধরে যাবে। পুরো মহাবিশ্বে ধ্বংস শুরু হয়ে যাবে। এমন কল্পনাতীত সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে যাবে। এক তীব্র আতংক এসে ঘিরে ধরবে, “হায়! হায়! আমি তো কিয়ামতের জন্য প্রস্তুত নই! আমার এখন কী হবে!”
এই হচ্ছে গাশিয়াহ الْغَاشِيَةِ যার অর্থ: যা কোনো কিছুকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে, আচ্ছন্ন করে ফেলে, হতবিহ্বল করে ফেলে।[৫][৭][১৬] কিয়ামতকে আল-গাশিয়াহ বলা হয়, কারণ সেটি হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা, যা মানুষের সব চিন্তাভাবনা আচ্ছন্ন করে ফেলবে। মানুষের মাথায় তখন কিয়ামত ছাড়া আর কোনো চিন্তাই থাকবে না। চারিদিকে ঘটে যাওয়া কল্পনাতীত সব ঘটনা দেখে মানুষ হতবিহ্বল হয়ে যাবে। সন্তান, সম্পত্তি, লোভ, কামনা, বাসনা সব ভুলে যাবে।
যেদিন কিছু চেহারা থাকবে ভয়ে অবনত। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত
কিয়ামতের বিচার শেষ হওয়ার পর যখন কেউ বুঝতে পারবে যে, সে আর জান্নাতে যেতে পারবে না, জাহান্নাম হতে যাচ্ছে তার ঠিকানা, তখন থেকেই শুরু হয়ে যাবে তার ভয়ংকর পরিণতি। ভয়ে সে অবনত হয়ে যাবে। দীর্ঘ বিচারের পর সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তার চেহারা দুঃখে, হতাশায় কালো হয়ে যাবে। তার সাথে এখন কী করা হবে—এই উপলব্ধি যখন তাকে ঘিরে ধরবে, তখন তার চেহারায় নেমে আসবে তীব্র দুঃখ, হতাশা, আতংক।
তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত আগুনে। ফুটন্ত পানির কুয়া থেকে পানি পান করতে দেওয়া হবে
জাহান্নামে আগুনের প্রচণ্ড গরমে মানুষ পিপাসায় কাতর হয়ে পানি পান করার জন্য যখন আকুতি করতে থাকবে, তখন তাদেরকে এমন ফুটন্ত পানি পান করতে দেওয়া হবে যে, সেটা পান করে তার মুখ, গলা, নাড়িভুঁড়ি গলে যাবে।
বিষাক্ত কাটা ছাড়া আর কোনো খাবার পাবে না
আয়াতের অর্থ এই নয় যে, জাহান্নামীদের একমাত্র খাবার হবে দরিই ضَرِيعٍ। কারণ দরিই কোনো খাবারই নয়। এটা এক ধরনের কাটা, বিষাক্ত ঝোপ, যা কোনো প্রাণীই খায় না, মানুষ তো দূরের কথা। আরবিতে إِلَّا ব্যবহার করে এধরনের কথা যখন বলা হয়, যেমন, “জুতা ছাড়া আর কোনো খাবার পাবে না” —তখন আসলে বোঝানো হয় যে, ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আর কিছু না পেয়ে এরা জুতা পেয়ে সেটাই খাওয়া শুরু করে দেবে। এরমানে এই নয় যে, জুতা ছাড়া তাদেরকে আর কোনো খাবার দেওয়া হবে না।[৭]
কিছু পণ্ডিত এই আয়াত দেখিয়ে বলে যে, “দেখো! এখানে বলা আছে জাহান্নামীদের খাবার হবে দরিই, অথচ অন্য আয়াতে বলা আছে তাদেরকে যাক্কুম গাছ খেতে দেওয়া হবে, পুঁজ-রক্ত দেওয়া হবে। কুর’আনে দুই জায়গায় দুই কথা বলা আছে। দেখেছো, কুর’আনে ভুল আছে?” —এদের সমস্যা হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি ভাষার প্রচলিত নিয়ম ব্যবহার করে আরবি ভাষার বাক্যর অর্থ বুঝতে যাওয়া।
যা কোনো পুষ্টি দেয় না, ক্ষুধাও মেটায় না
আমরা খাই দুটো উদ্দেশে: ১) ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচা, ২) দেহের পুষ্টি জোগানো। —জাহান্নামে তীব্র ক্ষুধার জ্বালায় পাগল হয়ে মানুষ যা-ওবা খাবে, সেটা খেয়ে তারা কোনো পুষ্টি তো পাবেই না, তাদের ক্ষুধার জ্বালাও কমবে না। সেই খাবারগুলো হয়ে যাবে আরেক ধরনের অত্যাচার — প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট এবং একই সাথে তীব্র মানসিক হতাশা।
জাহান্নামের এই আয়াতগুলো আমাদেরকে দেওয়া হয়নি, যেন আমরা বুঝতে পারি ঠিক কী ধরনের খাবার এবং পানীয় আমাদেরকে দেওয়া হবে, যা নিয়ে আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে পারি। বরং এগুলো দেওয়া হয়েছে যেন আমরা কিছুটা হলেও ধারণা করতে পারি কী ভয়ংকর পর্যায়ের অতিপ্রাকৃত কষ্ট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এই কষ্টগুলোর সাথে যোগ হবে লজ্জা, অপমান, হতাশা, আতংক। মানুষের সহ্যের ক্ষমতার বাইরে তীব্র মানসিক এবং শারীরিক কষ্ট যে আমরা ভোগ করবো, সে সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা দেওয়ার জন্য এই আয়াতগুলো আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।

তবে সেদিন কিছু মানুষের চেহারা হবে খুশীতে উজ্জ্বল। নিজেদের অর্জনে তারা তৃপ্ত। তারা থাকবে আলিশান বাগানে। যেখানে তারা কোনো বাজে কথা শুনবে না। সেখান দিয়ে ঝরনা বয়ে যায়। আছে উঁচু আসন। সামনে সাজানো পানীয় পাত্র। সারি সারি নরম বালিশ। নরম গালিচা বিছানো। — আল-গাশিয়াহ ৮-১৬
তবে সেদিন কিছু মানুষের চেহারা হবে খুশীতে উজ্জ্বল
কঠিন বিচারের পর যে মানুষগুলো পাশ করবে এবং সুসংবাদ পাবে যে, তারা জান্নাত পেতে যাচ্ছে, তাদের মুখ হয়ে যাবে প্রচণ্ড খুশীতে উজ্জ্বল। জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের আনন্দে তাদের সমস্ত দুঃখ, হতাশা, গ্লানি মুহূর্তের মধ্যে উবে যাবে। এক পরম তৃপ্তির অনুভূতি তাদের অন্তরকে শান্ত করে দেবে। প্রশান্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের রবের পক্ষ থেকে দেওয়া পুরস্কার গ্রহণ করতে।
জান্নাতে কেউ বাজে কথা বলে না। দুনিয়াতে থাকতে মানুষ একে অন্যের নামে বদনাম, কুটনামি, খেলা, রাজনীতি, তারকাদের ফালতু খবর নিয়ে দিনরাত মশগুল থাকা, ঝগড়া-বিবাদ, গলাবাজি, অন্যের কাছে নিজেকে বড় বলে জাহির করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা —এই সব করেছে। এগুলো ছিল নিজের এবং অন্যের মানসিক অশান্তির অন্যতম কারণ। জান্নাতে এগুলোর কিছুই থাকবে না। হাজার হোক জান্নাতবাসীরা হচ্ছেন উঁচু স্ট্যান্ডার্ডের মানুষ। তারা দুনিয়াতে থাকতেই দিনরাত অনর্থক কথা, অশান্তির কথা বলে বেড়াতেন না। জান্নাতে তো কখনই বলবেন না। এই একটি জিনিস না থাকার কারণেই জান্নাতবাসীদের শান্তি বহুগুণে বেড়ে যাবে।
এই আয়াত থেকে আমরা একটি উপদেশ পাই। বাজে কথা থেকে দূরে থাকলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। আমরা যদি দুনিয়াতে বাজে কথা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে আমরা দুনিয়াতেই অনেক বেশি মানসিক শান্তিতে থাকবো। নিজেদের মুখকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা যেমন নিজেকে এবং অন্যেকে মানসিক শান্তি দেবো, ঠিক একইভাবে বাজে কথা, অনর্থক কথা বলে বেড়ায় এমন মানুষদের থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে দূরে রেখে নিজেদেরই মানসিক শান্তি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারব।
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, টেলিভিশন এবং সামাজিক গণমাধ্যম (যেমন ফেইসবুক) থেকে মানুষ যখন নিজেকে দূরে রাখতে পারে, তখন তার মানসিক শান্তি বহুগুনে বেড়ে যায়। এর কারণ এগুলো হচ্ছে বাজে কথার অনন্ত উৎস —কুটনামি, গালাগালি, কাঁদা ছোড়াছুড়ি, ফাঁকা গলাবাজি, ভুয়া খবর, প্রতারণা, মিথ্যার বাজার হচ্ছে টিভি এবং ফেইসবুক।
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের এগুলোর প্রতি ঝোঁক থাকে, কারণ এগুলো থেকে তারা একধরনের সাময়িক উত্তেজনা পায়। ঠিক যে ধরনের উত্তেজনা মানুষ অল্প পরিমাণে মাদক নিলে পায়। টিভি এবং ফেইসবুক দুটোই মানুষের মস্তিষ্কে সেই একই কেমিক্যাল ‘ডোপামিন’ নিঃসরণ করে, যা কোকেইন (মাদক) নিলে নিঃসরণ হয়। কিন্তু এই ডোপামিন হচ্ছে আসক্তির অন্যতম কারণ। যার কারণে যখন টিভি এবং ফেইসবুক বন্ধ হয়ে যায়, একধরনের বিষণ্ণতা, ক্লান্তি এসে ভর করে, যা কাটানোর জন্য আবার কখন টিভি এবং ফেইসবুকে যাবে, তার জন্য অস্থিরতা চলে আসে। এভাবে মানুষ এক ধরনের ‘উত্তেজনা-হতাশা-অস্থিরতা-উত্তেজনা’ আসক্তির চক্রে পড়ে যায়।
—এই অসুস্থ চক্র জীবনে অশান্তি নিয়ে আসে। মানুষকে নিরন্তর উত্তেজনার দাস বানিয়ে ফেলে। ঠিক এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে উত্তেজনা আসক্তির ফাঁদে ফেলার বাণিজ্যের উপর দাড়িয়ে আছে টিভি এবং ফেইসবুক। এটাই তাদের ব্যবসা, তাদের আয়ের উৎস।
বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দির অন্যতম সফল মানুষদের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, তারা কেউ নিয়মিত টিভি এবং ফেইসুক করেন না। তাদের এগুলোর ব্যবহার যোগাযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মাত্র ৯% ফেইসবুক ব্যবহারকারী যোগাযোগ করার জন্য ফেইসবুক ব্যবহার করেন। আর বাকি ৯১% ব্যবহারকারী ঘন ঘন উত্তেজনার ডোজ নেওয়ার জন্য নিয়মিত ফেইসুক ব্যবহার করেন। এরা একদিনও ফেইসবুক ভুলে থাকতে পারে না।
বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দির অন্যতম সফল মানুষদের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, তারা কেউ নিয়মিত টিভি এবং ফেইসুক করেন না। তাদের এগুলোর ব্যবহার যোগাযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মাত্র ৯% ফেইসবুক ব্যবহারকারী যোগাযোগ করার জন্য ফেইসবুক ব্যবহার করেন। আর বাকি ৯১% ব্যবহারকারী ঘন ঘন উত্তেজনার ডোজ নেওয়ার জন্য নিয়মিত ফেইসুক ব্যবহার করেন। এরা একদিনও ফেইসবুক ভুলে থাকতে পারে না।
ফেইসবুকের যতই উপকারিতা থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো পুরো একটি প্রজন্মের চিন্তার গভীরতা নষ্ট করে দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা তৈরি করছে এটি। মাত্র কয়েক বছরে এটি কোটি মানুষের মধ্যে নারসিসিজম নামক একটি মানসিক ব্যাধির মহামারী ছড়িয়ে দিয়েছে, যা হচ্ছে অন্যের কাছে নিজেকে সুখী, সফল, গুণবান হিসেবে জাহির করে এক প্রতারণায় ভরা জীবন পার করার অন্ধ মোহ।[৪১২][৪১৩]
– ওমর আল জাবির
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন