মসজিদে যাওয়া সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহ এবং তার ব্যাখ্যা
—————————————————————————
মহিলাদের মসজিদে কিংবাঈদগাহে যাওয়া সম্পর্কে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সার কথা তিনটি হাদীসের মধ্যে এসে যায়। এজন্য আমরা পৃথক পৃথকভাবে সব হদীসগুলি উল্লেখ না করে সেই তিনটি হাদীস উল্লেখ করব এবং সাহাবায়ে কেরামসহ পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসীন এবং হাদীস ব্যাখ্যাকারীগণ তার কি অর্থ বুঝেছেন সেটা আলোচনা করব।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, হাদীসের শব্দ বা তরজমা দেখে হাদীসের মতলব বুঝতে যাওয়া বা সেই অনুযায়ী ব্যাখ্যা দেয়া কিন্তু গোমরাহীর আলামত। একা একা পড়ে বা বাংলা অর্থ দেখে হাদীস বুঝতে গেলে পরস্খলনের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু সম্ভাবনায় নয় বরং বাস্তব ঘটনাও ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। তাই কোন হাদীস সামনে এলে সাহাবায়ে কেরাম তার কি অর্থ বুঝেছেন, কিভাবে তার উপর আমল করেছেন এবং তৎপরবর্তী তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনগণ তার কি ব্যাখ্যা করেছেন সেটাও জানতে হবে। কেননা হাদীসের সর্বপ্রথম মুখাতাব বা লক্ষ্যবস্তু হলেন সাহাবায়ে কেরাম। তারা সরাসরি হুযুর (সাঃ)- এর যবান থেকে হাদীস শুনেছেন এবং তার মতলব বুঝে তার উপর আমল করেছেন। তার সাহাবাদের আমলকেও হাদীসের সাথে মেলাতে হবে হাদীসের সহীহ ব্যাখ্যা বুঝার জন্য।
সাহাবায়ে কেরাম রাসূলে কারীম (সাঃ)–এর জন্য উৎসর্গকৃত প্রাণ ছিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর একটা ইশারায় তারা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তেঅ তারা প্রস্তুত ছিলেন। তারাই ছিলেন সত্যিকারের আশেকে রাসূল। তারাই ছিলেন রাসূলের আদর্শের প্রকৃত পতাকাবাহী। তাদের থেকে সুন্নাত বিরোধী, রাসূলের আদর্শ বিরোধী কোন কাজ প্রকাশ পাবে সেটা কল্পনাও করা যায় না। তাই হাদীসের পাশাপাশি তাদের আমলও দলীল রূপে গণ্য হবে, যেহেতু তারা ছিলেন মি’আরে হক বা সত্যের মাপকাঠি। হাদীস তিনটি হলো-
(১) উম্মেআতিয়া (রাযিঃ) বলেন, আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে আমারা যেন ঋতুবতি পর্দানশীন মহিলাদেরকেও ঈদের ময়দানে নিয়ে যাই। যাতে করে তারা মুসলামানদের জামাআত এবং দুআর মধ্যে শরীক থাকতে পারে। তবে ঋতুবতি মহিলারা নামাযের জায়গা থেকে আলাদা থাকবে। জনৈকা সাহাবিয়া বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অনেকের তো চাদরও নেই। হুযুর (সাঃ) বললেন, তাকে যেন তার বান্ধবী স্বীয় চাদর দিয়ে সাহায্য করে।
(২) মহিলারা যদি মসজিদে যেতে চায় তাহলে তাদেরকে বাধা দিও না।
(৩) তোমাদের কারো স্ত্রী যদি মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চায় তাহলে সে যেন বাধা না দেয়। তবে তাদের জন্য ঘরই শ্রেষ্ঠ।
এই বিষয়বস্তুর আরো কিছুই হাদীস সিহাহ সিত্তাহসহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। এসব হাদীস দ্বারা বাহ্যিকভাবে বুঝে আসে যে, মহিলাদের মসজিদে এবং ঈদগাহে যাওয়া অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও তারা যদি স্বামীর নিকট অনুমতি চায় তাহলে স্বামীর বাধা প্রদান না করা উচিত। কিন্তু আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, হাদীসে প্রকৃত ব্যাখ্যা বুঝতে হলে আমাদেরকে সাহাবায়ে কিরাম এবং মুহাদ্দিসীনদের ব্যাখ্যার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তাই আসুন ব্যাখ্যার আলোকে আমরা এসব হাদীসের মর্ম উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি।
প্রথম হাদীসে মহিলাদেরকে ঈদগাহে হাজির হওয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে। এই আদেশটা কোন ধরণের সেটা আমাদেরকে দেখতে হবে। আরবী ভাষায় আমর অর্থাৎ অনুমতিসূচক শব্দ সাধারণতঃ তিন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। ওয়াজিব, মুস্তাহাব এবং মুবাহ। আলোচ্য হাদীসে আমর তথা আদেশটা যে ওয়াজিব হিসেবে ব্যবহার হয় নাই সেটা একেবারে স্পষ্ট। কেননা মহিলাদের উপর ঈদের নামায ওয়াজিব না। এবং হাদীসের এই স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সেই যুগের যে সকল মহিলা সাহাবী ঈদের মাঠে আজীবন শরীক হয়েছে এমন কোন প্রমাণও পাওয়া যায় না। তাছাড়া আলোচ্য হাদীসে তো হায়েজা মহিলাদের কথা বলা হয়েছে যাদের জন্য নামাযই নেই।
এমনকি এই আদেশটা মুস্তাহাব পর্যায়েরও না। কেননা হুযুর (সাঃ) মহিলাদের জন্য নির্জন প্রকোষ্ঠের নামায মসজিদে নববীর নামাযের চেয়ে উত্তম বলে বর্ণনা করেছেন এবং সেই হাদীসে ঈদের নামাযের জন্য আলাদা কোন হুকুম নেই যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায তো ঘরে পড়া ভাল। তবে ঈদের নামায ঈদগাহে যেয়ে পড়তে হবে বা পড়বে। কেননা মসজিদ তো সাধারণতঃ বাড়ীর কাছেই হয়ে থাকে আর ঈদগাহ শহরের বাইরে হয়ে থাকে। তাহলে বাড়ীর কাছে মসজিদে যেয়ে যেখানে নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে; সেখানে শহরের বাইরে ঈদগাহে যেয়ে ঈদের জামাআতে শরীক হওয়ার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে?
দ্বিতীয় কথা হলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আর জুমুআর নামায ফরজ আর ঈদের নামায ওয়াজিব। ফরজ নামাযের জন্য যেখানে ঘর থেকে বের হয়া আশা অনুত্তম সেখানে ওয়াজিব আদায়ের জন্য ঈদগাহে যাওয়া কি করে উত্তম হতে পারে? সুতরাং বুঝা গেল যে, আলোচ্য হাদীসে আমর তথা অনুমতিসূচক শব্দ ওয়াজিব বা মুস্তাহাব নয় বরং মুবাহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সাময়িক উপকারের জন্য রাসূলে আকরাম (সাঃ) মহিলাদেরকে ঈদগাহে যেতে বলেছিলেন। এর দ্বারা ওয়াজিব হওয়া বুঝে আসে না। (ফাতাওয়া রহীমিয়াঃ ৫/৩১)
বিশিষ্ট ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম তাহাবী (রহঃ) এই হাদীসের ব্যাখ্যা করতে যেয়ে বলেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহিলাদের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার অনুমতি ছিল যাতে করে মুসলমানদের সংখ্যা বেশী দেখা যায় এবং দুশমনরা এতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়। কিন্তু আজ যেহেতু সেই পরিস্থিতি আর নেই তাই ঐ হুকুম ও মানসূখ (রহিত) হয়ে গেছে।
ফতোয়ার আলোকে মহিলাদের মসজিদে গমন
—————————————————————
বুখারী শরীফের বিখ্যাতব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহঃ) বলেন, বর্তমানে ফতওয়া এই কথার উপরে যে, মহিলাদের জন্য যে কোন নামাযে যাওয়া নিষেধ। চাই তা দিনে হোক আর রাতে হোক। উক্ত মহিলা চাই যুবতী হোক আর বৃদ্ধা হোক। এমনকি তাদের জন্য ওয়াজ মাহফিলে যাওয়াও নিষেধ। বিশেষ করে ঐ সকল জাহেলদের ও্যাজ্ব যারা দেখতে উলামার মত কিন্তু উদ্দেশ্য তাদের দুনিয়া কামানো আর প্রবৃত্তির পুজা করা।
ফতোয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে,মহিলাদের জন্য জামাআতে হাজির হওয়া নিষেধ। চাই তা জুমা হোক বা ঈদ হোক। এমনকি ওয়াজের মাহফিলে পর্যন্ত। দিনে হোক বা রাতে হোক, বৃদ্ধা হোক বা যুবতী হোক সকলের জন্য এই হুকুম প্রজোয্য। ফেৎনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে বর্তমানে এটাই ফতোয়া। (১-৫৬৬)
ফতোয়ায়ে আলমগিরীতে বলা হয়েছে- ফেৎনা ফাসাদ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করার কারণে মহিলাদের যে কোন নামাযে অংশগ্রহণ করা মাকরুহ। (১/৮৫)
শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ) বলেন, এই যুগে মহিলাদের জন্য মসজিদে জামাআতে হাজির হওয়া মাকরুহ। কেননা ফেৎনারআশংকা রয়েছে। হুযুরে পাক (সাঃ) এর যুগে দ্বীনী হুকুম আহকাম শেখার জন্য তাদের মসজিদে যাওয়ার অনুমতি ছিল। কিন্তু এখন আর সেই প্রয়োজন বাকি নেই। দ্বীনের হুকুম আহকাম সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। পর্দার মধ্যে থেকেও মহিলারা তা জানতে পারে। সুতরাং তাদের জন্য বাড়ীতে পর্দার মধ্যে থাকাই শ্রেয়।
উল্লেখ্য যে, মসজিদে না যাওয়ার এই হুকুম হারাম শরীফ, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসাসহ সকল মসজিদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রজোয্য। সর্বত্রই মহিলারা স্বীয় ঘরে নামায পড়বে। এমনকি যেসব মহিলারা হজ্ব বা উমরা করতে যান তারাও সেখানে বাইতুল্লাহ শরীফ বা মসজিদে নববীতে নামায না পড়ে স্বীয় রুমে নামায পড়বেন। (আহসানুল ফাতাওয়া)
কেননা রাসূলে কারীম (সাঃ) মসজিদে নববীর তুলনায় নির্জন প্রকোষ্ঠে নামায পড়াকে মহিলাদের জন্য উত্তম বলেছেন। এই হাদীস যেহেতু মদীনায় থাকাকালীন সময়ে ইরশাদ করেছিলেন তাই এতে মসজিদে নববী কথা উল্লেখ রয়েছে। মক্কা শরীফে অবস্থান করার সময় যদি বলতেন তাহলে সেখানে অবশ্যই বলতেন যে, মসজিদে হারামে নামায পড়ার চেয়ে স্বীয় বাড়ীতে পড়া মহিলাদের জন্য উত্তম। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, মসজিদে হারামে এক রাকাআতে এক লাখের সাওয়াব এবং মসজিদে নববীতে এক রাকাআতে এক হাজার রাকাআতের সাওয়াব শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য।
মহিলারা স্বীয় ঘরে নামায পড়লে ঐ সাওয়াব পেয়ে যাবেন। সুতরাং মা-বোনেরা সাবধান। অতিরিক্ত সাওয়াবের আশায় কুরআন হাদীসের বিরোধিতা করে ধ্বংস ডেকে আনবেন না।
আজঅধিকাংশ মহিলারাই বেপর্দা চলেছে। বাড়ীতে গায়েরে মাহরাম এবং দেওর-ভাসুরের সাথে পর্দা করছে না, যা কিনা ফরজ। অথচ তারাই আবার অধিক সাওয়াবের আশায় সোৎসাহে মসজিদে, ঈদগাহে উপস্থিত হচ্ছে। যা কিনা মুস্তাহাবও নয়। তাহলে এটা গোড়া কেটে আগায় পানি দেয়ার মত নয় কি? এই স্ববিরোধিতার কী অর্থ? ফরজ জিনিস বাদ দিয়ে মুবাহ জিনিসের প্রতি এত আগ্রহ কেন? সাহাবায়ে কেরাম যারা বেশী থেকে বেশী সাওয়াব অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা করতেন তারাও হুযুর (সাঃ) এর কথা মেনে নিয়ে মসজিদে নববীতে তার পিছনে নামায পড়া বাদ দিয়ে নিজেদের বাড়ীতে নামায পড়েছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের মা-বোনদের তাদেরকে টেক্কা দিয়ে মসজিদে আর ঈদগাহে যাওয়ার প্রবণতাটা সত্যিই দুঃখজনক।
ফতোয়ারবিখ্যাত কিতাব বাদায়িউস সানায়িতে মহিলাদের জুমুআ এবং ঈদের জামাআতে শরীক হওয়া সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা প্রণিধান যোগ্য। জুমুআর জামাআতে শরীক হওয়া সম্বন্ধে বলা হচ্ছেঃ আর মহিলারা জুমুআয় শরীক হবে না। কেননা তারা পারিবারিক কাজে মশগুল থাকে, তাছাড়া পুরুষদের সমাবেশে মহিলাদের বের হওয়াও নিষেধ। তাদের এই বের হওয়াটা ফেৎনার কারণ হয় তাই এই হুকুম। একারণেরই তাদের জুমুআআর পাঁচ ওয়াক্তের জামাআতে হাজির হওয়া মাফ। হযরত জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার উপর এবং কিয়ামতের দিনের উপর ঈমান রাখে তার জন্য জুমুআ ওয়াজিব কিন্তু মুসাফির,গোলাম,বাচ্চা এবং মহিলা ও অসুস্থ ব্যক্তি ব্যতীত। (১/২৫৮)।
এই হাদীসে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে যে, মহিলাদের জন্য জুমুআর নামায নেই।
ঈদের জামাআতে শরীক হওয়া সম্বন্ধে বলা হয়েছেঃএ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, যুবতী মহিলাদের জুমুআর নামাযে, ঈদের নামাযে এবং অন্য যে কোন নামাযের জামাআতে হাজির হওয়ার অনুমতি নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ
তোমরা স্বীয় ঘরে অবস্থান কর।
এখানে অবস্থান করার হুকুম দিয়ে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া তাদের বাইরে বের হওয়াটা নিঃসন্দেহে ফেৎনার কারণ। আর ফেৎনা হলো হারাম, যে জিনিস হারাম পর্যন্ত টেনে যায় সেটাও হারাম। তবে অতি বৃদ্ধা মহিলারা ফজর, মাগরিব আর ঈশার জামাআতে হাজির হতে পারে। যোহর, আসরে নয়। কেননা এই দুই সময় হচ্ছে শয়তান-বদমায়েশদের বাইরে ঘোরাঘুরি করার সময়। এতদসত্ত্বেও এতে কারো দ্বিমত নেই যে, তবুও নামাযের জন্য বের না হওয়াটাই উত্তম।কেননা নবীয়ে কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, মহিলাদের নামায স্বীয় বাড়ীতে তাদের মসজিদে পড়ার চেয়ে উত্তম। আর ঘরের নামায বাড়ীর নামাযের চেয়ে উত্তম। আর তাদের গোপনে নামায সাধারণ ঘরে নামাযের চাইতে উত্তম। (১/২৭৫)
উল্লেখ্য যে, আলোচ্য কিতাবের লেখক আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী (রহঃ) আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। ৫৮৭ হিজরীতে তার ওফাত হয়। তিনি ছিলেন সে যুগের বিরাট বড় আলেম। তার ইলমের এতোই সুখ্যাতি ছিল যে, তিনি মালিকুল উলামা অর্থাৎ উলামায়ে কেরামের বাদশাহ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এতক্ষণ যাবৎ হাদীসের আলোকে তার ফতোয়া আপনারা শুনলেন। তারা আমাদের চাইতে হাদীস-কুরআন অনেক বেশী বুঝতেন। তাদের তাকওয়া পরহেযগারীও ধারণার অতীত। কাজেই হাদীস-কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে।
সমালোচনার জবাবঃ
—————————
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর যুগে মহিলারা সীমিত সংখ্যায় যাও বা মসজিদে যেতেন সাহাবাদের যুগে তাও বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে হযরত উমর ফারুক (রাযিঃ)-এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করেন এবং উপস্থিত সকল সাহাবায়ে কেরাম তা নির্দিতায় মেনে নেন। কেউ কেউ এ ব্যাপারে হযরত আয়েশা (রাযিঃ)-এর কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে তিনি হযরত উমর ফারুক (রাযিঃ) এর সমর্থন করে বলেন,
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যদি বর্তমানের মহিলাদের অবস্থা দেখতেন তাহলে তাদেরকে অবশ্যই মসজিদে যেতে নিষেধ করে দিতেন।
— আবু দাউদ শরীফঃ১/৮৪
বর্তমানে আমাদের সমাজের কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি যারা মহিলাদেরকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই উৎসাহী। যেসব মহিলা পর্দা করেনা তাদেরকে তারা পর্দার জন্য বলেন না। কিন্তু যারা পর্দা করে তাদেরকে পর্দা থেকে বের করে পুরুষদের মাহফিলে নিয়ে যেতে যার পর নাই তৎপর। তারা এসব মহান সাহাবীদের সমালোচনা করে বলে থাকেন যে, রাসূলে আকরাম (সাঃ) যখন মহিলাদের মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করতে নিষেধ করেছেন এবং কারো কাছে অনুমতি চাইলে তাকে অনিমতি দিতে বলেছেন। এখন সাহাবাদের এই ভিন্ন মত পোষণ করা গ্রহণীয় নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগে যে সুন্নাতটি চালু ছিল তার বিপরীতে কোন আলেম-উলামার কথা, কোন ফিকাহ বা ফতোয়ার কিতাবের ফতোয়া গ্রহণ করার অর্থ হবে রাসূলের আদর্শকে বাদ দিয়ে তাদেরকে বড় মনে করা। তাই আমরা এসব ফতোয়া মানি না।
আসুন এবার আমরা বিরুদ্ধবাদীদের এসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এসব ভাইয়েরা সুন্নাতকে মহব্বত করেন বলেই এই অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তারা চান না যে রাসূলের সরাসরি হাদীস বা সুন্নাত বাদ দিয়ে অন্য কারো কথা মানা হোক। আর এটা কোন মুমিন মুসলিম চাইতেও পারে না।
কিন্তু কথা হলো এই প্রশ্ন উত্থাপন করার আগে আমাদেরকে সুন্নাতের সংজ্ঞা এবং সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা সম্পর্কে জানতে হবে।
স্মরণ রাখা দরকার যে, রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কওল ফেয়েল ও তাকবীর দ্বারা প্রমাণিত বিষয়সমূহ যেমনভাবে সুন্নত এবং অনুসরণযোগ্য তেমনিভাবে রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর পরে খুলাফায়ে রাশেদীনের আমল দ্বারা যেটা প্রমাণিত সেটাও সুন্নাত বলে গণ্য এবং তার অনুসরণ করা ওয়াজিব। কেননা রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর একটা সহীহ হাদীস বা আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মুস্নাদে আহমদ ইত্যাদি হাদীসের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে,
আমার পর যারা জীবিত থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে এমতাবস্থায় তোমাদের জন্য জরুরী হলো তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং আমার পর খুলাফায়ে রাশেদীন যেসব সুন্নাত জারী করবে সেগুলিকে দৃঢভাবে আঁকড়ে ধরবে যেমন নাকি দাঁত দ্বারা কোন জিনিস মজবুতভাবে ধরা হয়।
— আবু দাউদ শরীফঃ২/৬৩৫
তিরমিযী শরীফে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হযরত হুযাইফা (রাযিঃ) বলেন, রাসূলে আকরাম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, জানিনা আমি কতদিন তোমাদের মধ্যে থাকব। আমার পরে তোমরা আবু বকর এবং উমরের তরীকা অনুসরণ করবে।
— তিরমিযী ২/৩৬২
এখানে খুব ভাল্ভাবে লক্ষ্য করুন। প্রথম হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুলাফায়ে রাশেদীনের অনুসরণ করাকে নিজেরকরা বলে ঘোষণা করেছেন। আর দ্বিতীয় হাদীসে বিশেশভাবে হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রাযিঃ) এবং হযরত উমর ফারুক (রাযিঃ)-এর অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন।
অনুরূপভাবে শীর্ষ স্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম, ফুকাহা এবং তাবেঈনরাও যদি কোন বিষয়ের উপর ইজমা করেন তাহলে সেটাও সুন্নাত বলে বিবেচিত হবে। নাজাতের জন্য সেটার উপর আমল করাও জরুরী। হাদীস শরীফে মুক্তি প্রাপ্ত জামাআতের পরিচয় দিতে যেয়ে বলা হয়েছে, আমি এবং আমার সাহাবারা যে তরীকার উপর আছি সেটার অনুসরণ করলেই মুক্তি পাওয়া যাবে। [4]
তাছাড়া সাহাবা এবং তাবেঈন্দের যুগকে খাইরুল কুরুন তথা শ্রেষ্ঠ যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এসব হাদীস দ্বারা বুঝে আসে যে, হুযুর (সাঃ)-এর তালীম হোক বা খুলাফায়ে রাশেদীনের জারীকৃত বিধান হোক কিংবা শীর্ষ স্থানীয় সাহাবা তাবেঈনদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হোক সবগুলির উপর আমল করাই সুন্নাত। এখন আপনিই দেখুন সাহাবায়ে কেরামের যুগে মহিলাদের মসজিদে যাওয়ার কি হুকুম ছিল।
এখানে খুব ভাল ভাবে মনে রাখা দরকার যে, সাহাবায়ে কেরাম হুযুর (সাঃ)-এর সর্ব প্রথম ছাত্র ছিলেন। তাদের সামনেই ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। হুযুর (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ থেকে তারাই সর্ব প্রথম সরাসরি হাদীস শুনেছেন। তারাই ছিলেন সেসব হাদীসের সর্ব প্রথম লক্ষ্য বস্তু। তারা হুযুর (সাঃ)-এর যিন্দেগী অতি নিকট থেকে দেখেছেন। তার প্রতিটি সুন্নাতকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করেছেন। যে কোন হাদীসের মর্ম ও ব্যাখ্যা সাহাবায়ে কেরামই সবচেয়ে বেশী জানতেন, কারণ আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সমস্ত উম্মত থেকে সর্বদিক দিয়ে যাচাই বাছাই করে নির্বাচিত করেছিলেন। দ্বীনের প্রতিটি বিষয় সম্বন্ধে তারা রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নিকট থেকে বাস্তব প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর সর্ব প্রথম তারাই জান-মাল ও সময়ের কুরবানী দিয়ে দ্বীনের হেফাযত করেছিলেন।
সুতরাং তাদের সম্পর্কে এটা ধারণা করাও মস্ত বড় পাপ যে, তারা নিজেদের মনগড়া উক্তির মাধ্যমে রাসূলী সুন্নাতকে বদলে ফেলেছিলেন বা তারা রাসূলের আদর্শ বিরোধী কাজ করেছেন।(নাউযুবিল্লাহ) আজ যারা হযরত উমর (রাযিঃ) এবং হযরত আয়েশা (রাযিঃ)-এর সমালোচনা করে বড় রাসূল প্রেমিক সাজতে চান তারা এদিকটা একটু খেয়াল রাখবেন আশা করি। আল্লাহ না করুন সাহাবাদের সম্পর্কে আমরা যদি এমন ধারণা পোষণ করতে শুরু করি তাহলে সেটা কিন্তু তাদের উপর অপবাদ দেয়া হবে আর এই অপবাদের কারণে তাদের কোন কথা আর গ্রহণযোগ্য থাকবে না। এমতাবস্থায় পুরা দ্বীনের ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যাবে। তাই কথা বলার সময় খুব সাবধানে কথা বলা উচিত।
সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে নিয়ে আজ চৌদ্দশত বৎসর পর্যন্ত লাখো কোটি উলামায়ে কেরাম এসব হাদীসের যে মতলব বুঝে এসেছেন এবং ফতোয়া দিয়ে এসেছেন আজ এই কিল্লতে ইলমীর যুগে এরকম স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সেই সব হাদীসের উল্টা মতলব বুঝা এবং তা প্রচার করা আর যারা মানে না তাদেরকে গালমন্দ করা কত বড় ফেৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা কি আপনারা কখনও চিন্তা করে দেখেছেন? অধিকাংশ মা-বোনেরা আজ পরিপূর্ণভাবে পর্দা প্রথা পালন করছে না। খাছ পর্দা তো অনেক দ্বীনদার ব্যক্তিবর্গের বাড়ীতেও নেই, সেক্ষেত্রে এসব সংশোধনের চেষ্টা না করে মহিলাদের মসজিদে আর ঈদগাহে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনারা এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন?
শেষ কথাঃ
—————
এতক্ষণ যাবৎ আমরা যে আলোচনা করলাম তার দ্বারা কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেল, তা হচ্ছে-
(১) রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর এমন কোন হাদীস নেই যার মধ্যে স্পষ্টভাবে মহিলাদের নামায পড়ার জন্য মসজিদে বা ঈদগাহে যেতে বলা হয়েছে। মসজিদে যাওয়া সংক্রান্ত যেসব হাদীস পাওয়া যায় তাতে অত্যন্ত অপছন্দের সাথে শর্ত সাপেক্ষে এমনভাবে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে যাতে মহিলারা নিজেরাই মসজিদে যেতে অনুৎসাহিত হয়ে পড়ে।
(২) মহিলাদেরকে মসজিদে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সুন্নাতের স্পষ্ট বিরোধিতা।
(৩) মহিলারা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তাদেরকে নিষেধ না করা সুন্নাতে রাসূল ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং সাহাবায়ে কেরামের ইজমা একথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ঐ সুন্নাত সাময়িক এবং শর্ত সাপেক্ষে ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের কারণে এবং শর্ত না পাওয়ার দরুণ এখন নিষেধ করাটাই সুন্নাত।
(৪) মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা না দেয়া বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা সুন্নাতে রাসূলের বিরোধিতা ছাড়া কিছু নয়। পক্ষান্তরে মসজিদে যেতে নিষেধ করা আপাতঃ দৃষ্টিতে সুন্নাতে রাসূলের বিরোধিতা মনে হলেও বাস্তবে সেটাই সত্যিকারের সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ।
তথ্যসূত্রঃ
[1] মা’আরিফুল কুরআনঃ ৭-২০৮
[2] বুখারী শরীফঃ ১-১৫৯
[3] আইনী শরহে বুখারীঃ ৩/২৩১
[4] তিরমিযীঃ ২/১০২